কয়েকদিন ধরেই খবর আসছিল, পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে জামবনির বুড়িশোলের জঙ্গলে পুলিশের সঙ্গে মাওবাদীদের গুলির লড়াই চলছে। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর। নিউজ রুমের প্রাইম টাইম ডিবেট চলছে। হঠাত্ ব্রেকিং নিউজ! এনকাউন্টারে খতম কিষেনজি। মোস্ট ওয়ান্টেড মাওবাদী নেতার মৃত্যুটা ছিল মাত্র আধ ঘণ্টার একটি গুলির লড়াইয়ের নির্যাস।
জঙ্গলমহলে শান্তি
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল লক্ষ্য ছিল, পাহাড় ও জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরানো। বেসিক্যালি, জঙ্গলমহলে মাওবাদী দমনের ব্যাপক অভিযান কিন্তু তার আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২০০৮ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে ল্যান্ডমাইন হামলার পর থেকেই। লালগড় একটা সময় মাওবাদী মুক্তও ঘোষণা করে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী যৌথ ভাবে। জঙ্গলমহলে ব্যাপক পুলিশি অভিযানে খানিকটা 'গো-স্লো' পদ্ধতি অনুসরণ করা শুরু হয় মে মাসে সরকার বদলের পরে। কিন্তু পুলিশ ও সিআরপিএফ মরিয়া ভাবে খুঁজে যাচ্ছিল একজনকেই। তাঁর নাম কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেনজিকে।
জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরাতে মাওবাদীদের অস্ত্রত্যাগ করার আহ্বান জানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও ভোটের আগে মমতার মুখে বারবার শোনা যেত, 'মাওবাদী বলে কিছু নেই।' মাওবাদীদের দাবি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন সুজাত ভদ্ররা। পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম-সহ জঙ্গলমহলে পুলিশি অভিযান খানিক কমানো হল। যদিও পুলিশ ও সিআরপিএফ মুভমেন্ট বজায় থাকল।
কিন্তু একাধিক আলোচনার পরেও কোনও লাভ হয়নি। ২০১১ সালের ৩ নভেম্বরে তিনটি খুন করল মাওবাদীরা। এর মধ্যেই দুজন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাও ছিলেন। ব্যস, শান্তি প্রক্রিয়ায় ইতি। ফের জোর কদমে অভিযান শুরু হল জঙ্গলমহলে। যার ফল, কিষেণজি খতম।
কিষেণজি ও জঙ্গলমহল
আজ বছর দশেক পরে হঠাত্ কেন কিষেণজির প্রসঙ্গ? আসলে কয়েকদিন পরেই জঙ্গলমহলে ভোট। সেই জঙ্গলমহল, সেই লালগড়! কিষেনজি বলতেন, 'লালগড় দ্বিতীয় নকশালবাড়ি।' মাত্র ১০ বছরে কী ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তন। ২০১৯ সালের লোকসভায় জঙ্গলমহলের সব বিধানসভা কেন্দ্রেই লিড বিজেপির। জঙ্গিলমহলের রাজনৈতিক পালাবদল বা পট পরিবর্তনে কিষেনজি একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
মাওবাদী নেতা কিষেনজি জীবনের ৩০টা বছর স্রেফ লুকিয়ে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত লড়াই করে কাটিয়েছেন। অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার কোটেশ্বর রাও ভারতে মাও আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন। ১৯৮০ সালে পিপল ওয়ার গ্রুপ তৈরি দিয়ে শুরু। পরে তা সিপিআই(মাওবাদী)-দের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়।
কিষেণজি কেমন দেখতে, তা একসময় সাধারণ জানতই না। পিঠে একে ৪৭, গলায় ও মাথায় গামছা জড়ানো একটিই ছবি। কিন্তু নিজের মুখ না দেখালেও যথেষ্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে যথেষ্ট গল্প করতেন।
অপারেশন গ্রিনহান্ট
২০০৯ সালে শুরু হয়েছিল অপারেশন গ্রিনহান্ট। ২০১০ সালে শিলদায় সিআরপিএফ ক্যাম্পে হামলায় ২৪ জন জওয়ানের মৃত্যু হল। ওই ঘটনার পরে কিসেনজি মিডিয়াকে বলেছিলেন, 'দিস ইজ আওয়ার অপারেশন পিস হান্ট।' অপারেশন গ্রিন হান্টের পাল্টা জবাব। একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে কিষেনজি বলেছিলেন, 'আমি সহজেই কাউকে মারতে পারি না। আমি নরম মনের মানুষ। ক্ষমাই করতে চাই।'
বলা বাহুল্য, নিজের দাবির সঙ্গে হামলার ঘটনাগুলি খাপ খেতো না। ১৯৯০ সালেই বিহার চলে গিয়েছিলেন কিষেনজি। সাতের দশকে ছাত্র আন্দোলন দিয়ে কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেনজির রাজনৈতিক জীবনের শুরু। আইন পড়ার সময় নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্র আন্দোলনের জেরেই প্রথম ৭৭ সালে গ্রেফতার হন তিনি।
সিপিআই (মাওবাদী)-র তরফে তেলেঙ্গানা ও দণ্ডকারণ্যের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। নয়ের দশকের শেষের দিকে প্রথম জঙ্গলমহলে আসেন । বেলপাহাড়ির পুকুরিয়া গ্রামে প্রথম শুরু করেন সংগঠন তৈরির কাজ। শুরুর দিকে নাশকতার পথে না গিয়ে জনসংযোগ বাড়ানো কাজেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন এই মাওবাদী নেতা।
যৌথবাহিনীর হাত থেকে অন্তত চারবার নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন কিষেণজি। ২০০৯ সালের অক্টোবরে অতীন্দ্র নাথ দত্ত অপহরণের সময় লক্ষ্মণপুরের জঙ্গলে যৌথবাহিনীর টার্গেটের মধ্যে এসে গিয়েছিলেন কিষেনজি। কিন্তু সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও ২০১০-এর মার্চ মাসে হাতিলোটের জঙ্গলে যৌথবাহিনীর গুলির মুখে পড়েন। সেসময় তাঁর পায়ে গুলি লাগে। তারপর থেকে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। আত্মগোপন করেই সংগঠনের কাজ চালাচ্ছিলেন।