জমে উঠেছে ভোটরঙ্গ। নবান্ন দখলে করতে ঘনঘন প্রচারে আসছেন মোদী-শাহরা। ব্যান্ডেজ বাঁধা পা নিয়েই জেলা সফর করছেন তৃণমূলনেত্রী। তাপমাত্রার থেকেও অনেক বেশি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রাজ্যে নির্বাচনী উষ্ণতা। আর এই ভোটে শাসক শিবিরের বিরুদ্ধে বিরোধী শিবির অন্যতম অস্ত্র করেছে আমফান দুর্নীতিকে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তৃণমূলকে নিশানা করছেন এই নিয়ে। আর এই আবহেই আগামী পয়লা এপ্রিল ভোট হতে চলেছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গোসাবা, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ ও সাগরে। এই চার বিধানসভার মানুষই সবচেয়ে বেশি দেখেছিল ঘূর্ণিঝড় আমফানের রুদ্রমূর্তী। তারপর দশমাস কেটে গিয়েছে। এবার জনাদেশ নেওয়ার পালা রাজনৈতিক দলগুলির। আমফান বিধ্বস্ত চার বিধানসভার ভোটাররা এবার কী উত্তর দেবে তা শাসক শিবিরের কাছে কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ।
২০২০ সালের ২০শে মে চোখের সামনে ধ্বংস দেখেছে সাগর
আমফান নাড়িয়ে দিয়ে গেছিল শহর কলকাতাকে। মেট্রো সিটি হওয়ার পরেও বিদ্যুৎ-জলহীন ভাবে দিন কাটাতে হয়েছে শহরবাসীকে। কলকাতার নানা প্রান্তে ভেঙে পড়েছিল বিশাল বিশাল গাছ। এই অবস্থায় সাগর, কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা ও গোসাবার মত উপকূলীয় জায়গাগুলির পরিস্থিতি কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আমফানের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল গোটা অঞ্চল। যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে ছিল প্রাণহানিও। সুন্দরবনের কাকদ্বীপ, সাগর, পাথরপ্রতিমা, গোসাবা জুড়ে কেল ছিল শুধু ধ্বংসের ছবি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সাগর ও পাথরপ্রতিমায়। এই দুই অঞ্চলে ঝড়ের গতিবেগ ছিল রাজ্যে সর্বোচ্চ। লক্ষাধিক বাড়ির টিন, অ্যাসবেস্টস ও খড়ের চাল উড়ে গিয়েছিল। প্রচুর গাছ ভেঙেছিল বা উপড়ে পড়েছিল। নদী ও সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছিল একাধিক গ্রাম। বাঁধ ভেঙে নোনা জল ঢুকে জলবন্দি হন বহু মানুষ। পুকুরে নোনা জল ঢোকায় মাছ মরে ভেসে উঠেছিল। পানের বরজের ৯০ শতাংশ ধূলিসাৎ হয়। কয়েক হাজার বিদ্যুতের খুঁটি উপড়েছিল। ভেঙেছিল ট্রান্সফর্মারও, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎহীন ছিল চার বিধানসভা এলাকাই। মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । সাগরের কচুবেড়িয়া, নামখানার হাতানিয়া–দোয়ানিয়া নদীর জেটি–সহ একাধিক জেটি ভেঙে গিয়েছিল।
আয়লার থেকেও আমফানের তীব্রতা ছিল বেশি
২০০৯–এর ২৫ মে আয়লা আছড়ে পড়েছিল সুন্দরবনে। লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আয়লা। প্রবল শক্তিশালী সেই ঝড়ের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়ায় দক্ষিণ ২৪ পরগনা। ১১ বছরের মাথায় আমফানের জেরে ফের বিপর্যস্ত হতে হয়েছিল গোটা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাকে। রাষ্ট্রসংঘ জানিয়েছিল আমফানের তীব্রতা আয়লার থেকেও বেশি ছিল। আমফানের সর্বোচ্চ বেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার। অনেক বেশি এলাকা জুড়ে তাণ্ডবও চালিয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় স্থায়ী হয়েছিল ২ ঘণ্টার বেশি। আবহ বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, সাম্প্রতিক অতীতে এমন মহাশক্তিধর এবং ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় দেখা যায়নি।
আমফানের ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি বিরোধীদের প্রধান অস্ত্র
ঘূর্ণিঝড় আমফানে যাদের ঘর ভেঙেছে তাদের ২০,০০০ টাকা করে দেবে রাজ্য সরকার। নবান্নে এমন ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টাকা যেন নিরপেক্ষভাবে বণ্টন হয় সেজন্য একটি টাস্ক ফোর্সও গঠন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অভিযোগ ওঠে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে আমফানের ক্ষতিগ্রস্তরা বাড়ি তৈরির টাকা পাননি। কিন্তু সেই টাকা গেল কোথায়? ত্রাণ বন্টনে রাজ্যের সর্বত্রই তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দুর্নীতির ভূরি ভুরি অভিযোগ ওঠে। জেলায় জেলায় শুরু হয় বিক্ষোভ। পরিস্থিতির চাপে পড়ে পদক্ষেপ করতে কার্যত বাধ্য হয় সরকার। শোকজ কিংবা বহিষ্কার করা হয় শ'খানেক তৃণমূল নেতা-পঞ্চায়েত-প্রধানকে। আমফানের ত্রাণে দুর্নীতিকে এবার শাসক শিবিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র করেছে বিরোধীরা। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বাংলায় ভোট প্রচারে এসে বারবার আমফান দুর্নীতি নিয়ে বিঁধছেন তৃণমূলকে। শাসক শিবিরের দুর্নীতিকে কটাক্ষ করে তৃণমূলের নাম দিয়েছেন, ট্রান্সফার মাই কমিশন। মোদীর কথায়, আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকা থেকেও কমিশন নিয়েছে তৃণমূল। দুর্যোগের সময়ও দুর্নীতি বন্ধ করেনি ওরা। তৃণমূল পার্টি অফিসে টাকা জমা দিলে তবে ক্ষতিপূরণ মিলেছে। ক্ষয়ক্ষতি না হলেও এভাবে টাকা পেয়েছেন অনেকে।
লোকসভা ভোটের ফলে এগিয়ে তৃণমূল
মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৭টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ ও সাগর। গত লোকসভা ভোটের নিরেখে এই তিনটি বিধানসভাতেই এগিয়ে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটেও এখান থেকে ফুটেছিল ঘাসফুল। কিন্তু এবার কী হবে তা নিয়ে চিন্তা বড়াছে দলের আন্দরেই। চলুন দেখে নেওয়া যাক চারটি কেন্দ্রের পরিস্থিতি।
পাথরপ্রতিমা
পাথরপ্রতিমা বিধানসভা আসন থেকে ২০১৬ সালে বিধায়ক নির্বাচিত হন সমীরকুমার জানা। তিনি ভোটে হারিয়েছিলেন কংগ্রেসের ফণীভূষণ গিরিকে । বিজেপি সেবার ছিল তৃতীয় আসনে। যদিও গত লোকসভা ভোটে পাথরপ্রতিমা বিধানসভা ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা তৃণমূলের পরেই উঠে আসে বিজেপি। এবারও তৃণমূল প্রার্থী করেছে সমীরবাবুকে।
কাকদ্বীপ
কাকদ্বীপ থেকে ২০১৬ সালের ভোটে জিতেছিলেন মন্টুরাম পাখিরা। তিনি মন্ত্রীও হন। সেবার তিনি জেতেন ১,০৪,৭৫০ ভোট পেয়ে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের রফিকউদ্দিন মোল্লা পেয়েছিলেন ৭৯,৮৩১টি ভোট। সেবারও অনেক ভোট কম পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। কিন্তু কাকদ্বীপ বিধানসভা ক্ষেত্রে বিগত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের পরে দুইয়ে ছিল বিজেপি। তৃণমূল প্রার্থী পেয়েছিলেন ১,০৬,২৩০টি ভোট। বিজেপি প্রার্থী পেয়েছিলেন ৮০,৭৪৭টি ভোট। এবারও মন্টুরাম পাখিরাই লড়ছেন তৃণমূলের হয়ে। ভোটে জিকলে কাকদ্বীপকে পুরসভা করা হবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তৃণমূল।
সাগর
২০১১ ও ২০১৬ সালে সাগর বিধানসভা আসন থেকে জিতে বিধায়ক হন তৃণমূল কংগ্রেসের বঙ্কিমচন্দ্র হাজরা। সাগর বিধানসভা ক্ষেত্রও লোকসভা নির্বাচনে লিড দিয়েছিল তৃণমূল প্রার্থীকেই। তিনি পেয়েছিলেন ১,১৯,০৭০ ভোট, দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিজেপি প্রার্থী পান ৮৭,০৫৮ ভোট। এবারও বঙ্কিমবাবুকেই টিকিট দিয়েছে তৃণমূল।
গোসাবা
৯টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত গোসাবা ব্লক। এই ব্লকের 14টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও বাসন্তী ব্লকের ২ টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত গোসাবা বিধানসভা কেন্দ্র। ২০১১ ও ২০১৬ সালে গোসাবা বিধানসভা ছিল তৃণমূলের দখলে। এবার জয়ী হলে হ্যাট্রিক করবেন তৃণমূলের জয়ন্ত নস্কর। এদিকে সুন্দরবনের এই বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ভোট ময়দানে বিজেপির হয়ে নেমেছেন বরুণ প্রামাণিক ওরফে চিত্ত। অন্যদিকে ময়দানে রয়েছেন আরএসপি প্রার্থী অনিল মণ্ডলও। তাই লড়াই যে হাড্ডাহাড্ডি হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
একুশের ভোটের ফ্যাক্টর
লোকসভা ভোটের নিরিখে সব ব কটি বিধানসভা ক্ষেত্রেই তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও লোকসভা ভোটের পর আমফান সব ওলটপালট করে দিয়েছে। ত্রাণ নিয়ে বিপুল দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় মানুষ। তারমধ্যে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একুশের ভোটের হাওয়ায় দলের ভাঙন অব্যাহত। আর তাতেই গত ৫ বছরে বামেদের পেছনে প্রধান বিরোধী আসনে উঠে এসেছে বিজেপি। আবার বিভিন্ন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত আসনে আব্বাস সিদ্দিকীও কয়েক বছর ধরে প্রভাব বাড়িয়েছেন ভালোই। এবার তিনিও বাম ও কংগ্রেসের সঙ্গে শরিক হয়ে নেমেছেন ভোট যুদ্ধে। ফলে ভোট ভাগাভাগি হলে অনেক আসনের ফলাফলই ওলটপালট হয়ে যেতে পারে।