
রসিক দাদাঠাকুর শরত্ পণ্ডিত এমএলএ-এর একটি জব্বর সংজ্ঞা বলেছিলেন, 'পরের কাছে ভাতা মেলে৷ ভাড়া মেলে৷ এ মেলে৷ ও মেলে৷ তা মেলে৷ সব মেলে৷ তাই এমএলএ৷'
পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে দাদাঠাকুরের এই সুরসিক কথাটির সঙ্গে মেলানো যাবে না। আদ্যান্ত সত্ নেতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। কথা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে নিয়ে। ১৯৯০ সালে মৃত্যুর সময় তাঁর সম্পত্তি বলতে ছিল, চার জোড়া ধুতি পাঞ্জাবি ও এক আলমারি ভর্তি বই।
আরও পড়ুন: নেহরুকে বিধান রায় লিখলেন, 'ভেবেচিন্তে দেখলাম, বাঙালিদের তিনটে সমস্যা...'
অনেকে তাঁকে বলেন, 'আরামবাগের গান্ধী'। ১৯৬২ সালের ১ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের প্রয়াণ। খাদ্যমন্ত্রী ও প্রবীণ গান্ধীবাদি স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রফুল্লচন্দ্র সেন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রফুল্ল মুখ্যমন্ত্রিত্বের সঙ্গে খাদ্য দফতরও নিজের হাতেই রাখেন।
প্রফুল্ল সেন ১৮৯৭ সালে ১০ এপ্রিল জন্মেছিলেন খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে। ছোটবেলাতেই চলে আসেন দেওঘর, সেখান থেকে এন্ট্রান্স পাশ করার পর কলকাতায়। ফিজিক্স অনার্স নিয়ে স্নাতক হন স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে। উচ্চ শিক্ষার জন্য বিলেত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু কলকাতায় মহাত্মা গান্ধীর ভাষণ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় তরুণ প্রফুল্লের। স্বদেশি আন্দোলন ও সত্যাগ্রহের জন্য বেছে নেন আরামবাগকে।
আরও পড়ুন: জ্যোতিবাবুকে ফোন করে গনিখান বললেন, 'আপনি আমার গাড়িতে কর্মসূচিতে যাবেন'
প্রফুল্ল সেন যখন মুখ্যমন্ত্রীর পদের দায়িত্ব নিলেন, তখন বাংলাজুড়ে ব্যাপক খাদ্য সঙ্কট। বহু মানুষ খেতে পাচ্ছে না। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য মজুত করে ব্ল্যাক করতে শুরু করল। এ হেন ভয়ঙ্কর খাদ্য সঙ্কট মেটাতে প্রফুল্ল সেন প্রথম চালু করলেন রেশন ব্যবস্থা। চালকল মালিকদের বাধ্যতামূলক ভাবে লেভি সিস্টেমের আওতায় আনলেন।
যার নির্যাস, সত্ প্রফুল্লের উপরে খেপে গেল মজুতদাররা। তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকারের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে লাগল। বামদলগুলি প্রচার করা শুরু করল, জোতদারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রফুল্ল সেন নাকি স্টিফেন হাউস কিনে নিয়েছেন। এ হেন পরিস্থিতিতে বাংলার মানুষকে ফুড হ্যাবিট বা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করার পরামর্শ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন। ১৯৬৫ সালে বিধানসভায় ভাষণে তিনি বললেন, 'মহালানবিশের রিপোর্ট অনুসারে মাথা পিছু মানুষের ১৮ আউন্স খাদ্য প্রয়োজন। কিন্তু আমার মতে ১৬ আউন্স হলেই চলে। আবার অনেকের মতে ‘যত পাই তত খাই’। বাইরে থেকে সাড়ে সাত লক্ষ টন খাদ্য আনা সম্ভব। আমাদের চাহিদা অনুসারে ৮০-৯০ ভাগ ধান সংগ্রহ করতে যদি পারা যায় তাহলে শহরাঞ্চলে মানুষকে কিছু কম খাইয়েও সমস্যা সমাধান করা যাবে। ১৯৬৬ সাল অত্যন্ত সংকটজনক হবে। খাদ্যের ঘাটতি হবে ২২ লক্ষ টন। সুতরাং কলকাতার মানুষকে ১২ আউন্সের বদলে ১০ আউন্স হিসাবে মাথা পিছু চাল দেওয়া হবে। আমি আগেই বলেছি বর্তমান সংকটকালে খাদ্য অভ্যাসের পরিবর্তনের প্রয়োজন।'
প্রফুল্ল সেন পরামর্শ দেন, 'ভাতের সঙ্গে রুটি, আলু, কাঁচকলাটাও খেতে হবে। সবগুলিতেই ফাইবার, আয়রন, কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। তোমরা ভাতের সাথে সাথে কাঁচকলা, পটল, বেগুন, কুমড়ো সিদ্ধ খেয়ে পেট ভরাতে পারো।'
তুমুল খাদ্য আন্দোলনের জেরে আরামবাগের মতো নির্বাচন কেন্দ্রে ১৯৬৭-র ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা কংগ্রেস সভাপতি অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে পরাজিত হন প্রফুল্ল সেন। কলকাতার কোনও বাজারে না কি সে দিন কাঁচকলা পাওয়া যায়নি। দ্বিগুণ দামে কাঁচকলা বিক্রি হয়েছিল!
১৯৮৪ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হেভিওয়েট সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারানোর পরে প্রবীণ প্রফুল্ল সেনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। জীবন সায়াহ্নে একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে সবার অলক্ষে তখন দিন গুজরান করছেন প্রফুল্ল সেন। ১৯৯০ সালে চলে গেলেন।