ঠাকুরমার ঝুলি বা ঠাকুরদাদার ঝুলিতে আমরা অনেক রূপকথার গল্পই পড়েছি। যেখানে এমন অনেক হ্রদ বা নদী আছে, যেখানে নামলেই প্রাণীকুল পাথরে পরিণত হয়। এ গল্প পড়ে শিউরে উঠে মা-দিদিমাদের কোলে মুখ লুকায়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার।
কিন্তু তা বাস্তবের মাটিতে যদি হতো কোনওদিন, এমন নদী বা হ্রদের খোঁজ মিলত, তাহলে কী ভয়ঙ্কর ব্য়াপারই না হতো, তাই না ! কিন্তু যদি ধরুন এমন সত্যিই থেকে থাকে। একবার ঢুঁ মেরে আসবার সাহস আছে কী !
এমন হাড়হিম করা লেক কিন্তু সত্যিই আছে। উত্তর আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার নেট্রন লেক এমনই এক বাস্তব বিস্ময়। এই হ্রদে পা দেওয়া মাত্রই পাথর হয়ে যায় পশুপাখি।
বিষয়টি শুনে রূপকথার গল্প মনে হলেও কোনও রূপকথা নয়। বাস্তবে পৃথিবীতে রয়েছে এমন একটি হ্রদ। সেখানে পাখি, বা জন্তু জানোয়ার এলে তারা আর জীবন্ত ফিরতে পারে না। মূহূর্তে হয়ে যায় পাথর।
এই হ্রদে পাখিগুলোকে নামতে হয় না। এর ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ই হ্রদের জলে পড়ে যায় তারা। কীভাবে জানেন? ওই হ্রদে জলের পরিবর্তে লাভা থাকায় সূর্যের রশ্মি হ্রদ থেকে বেশি পরিমাণ প্রতিফলিত হয়।
ফলে পাখিগুলো যখন ওপর দিয়ে উড়ে যায় তখন তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তীব্র আলোর ঝলকানিতে বিভ্রান্ত হয়েই হ্রদেই পড়ে যায় বাদুড় বা পাখিগুলো। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক পাখির মৃত্যু হয়।
কেউ যদি অতি কষ্টে ডাঙায় উঠেও পড়ে, তার কষ্ট আরো বাড়ে। লেকের জলের সোডা আর লবণ লেগে যায় পাখি বা প্রাণীটির শরীরে। যা শুকোনোর সঙ্গে সঙ্গে শরীর টেনে ধরতে থাকে। আস্তে আস্তে পাথরে পরিণত হয় ওই লবণ আর সোডা। একসময় পাখিগুলোর শরীর পূর্ণাঙ্গ চুনাপাথরের মূর্তির রূপ নেয়।
আফ্রিকার তানজানিয়ার উত্তর প্রান্তে রয়েছে হ্রদটি। এটি একটি নোনা জলের হ্রদ। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ২২ কিলোমিটার।আমাজন নদীর জল এসে পড়ে আশপাশের বেশ কয়েকটি উষ্ণ প্রস্রবনের জলে পড়ে। ফলে বিভিন্ন খনিজ সমৃদ্ধ হ্রদটির জল।
২০১১ সালে নিক ব্রান্ডট নামে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার নেট্রনের সামনে গিয়ে চমকে গিয়েছিলেন। সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল অসংখ্য পশুপাখির দেহ। এগুলি দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনও পাথরের মূর্তি সাজিয়ে রাখা। এর পিছনের রহস্য জানতে শুরু হয় গবেষণা।
জানা যায় সোডিয়াম কার্বনেট এবং সোডার পরিমাণ অত্যাধিক বেশি যে এটা তাদের জলে প্রচুর সোডিয়াম কার্বনেট যুক্ত লাভা দিয়ে প্রায় ২৬ লক্ষ বছর আগে তৈরি হয়েছে নেট্রন হ্রদের তলদেশ। পরীক্ষায় জানা গিয়েছে, জলের অস্বাভাবিক ক্ষার ত্বককে পুড়িয়ে দেয়। পশুপাখির পক্ষে যা অসহনীয়।
বছরের বেশিরভাগ সময় এর জলের তাপমাত্রা থাকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দ্রুত বাষ্পীভূত হয়ে যায় আর তলদেশ। পরে থাকে জলের মতন লাভা।সোডিয়াম কার্বনেট এর জন্য হ্রদের জলে জন্ম নেয় সায়ানোব্যাকটেরিয়া নামে অনুজীব।
এই অনুজীবের শরীরে লাল রঞ্জক থাকে। ফলে হ্রদের জল লাল রঙের হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন এই রঙে আকৃষ্ট হয়ে পশুপাখির নামে কিন্তু জলের অতিরিক্ত ঘুমের জন্য সেগুলো মৃত্যু হয়।
জল ক্ষারধর্মী হলেও এই নদী পূর্ব আফ্রিকার ফ্লেমিঙ্গোদের সবচেয়ে বড় একটা প্রজননকেন্দ্র। জননের সময় প্রায় ২৫ লক্ষ ফ্লেমিঙ্গো দেখতে পাওয়া যায়। কারণ এই গভীর জলে পাওয়া যায় প্রচুর নীলাভ সবুজ শৈবাল শৈবাল খেয়ে বেঁচে থাকে এবং বংশবৃদ্ধি করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা হ্রদের পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে। কারণ বহু পশুপাখির জীবাশ্ম মিললেও একটিও ফ্লেমিঙ্গো খুঁজে পাওয়া যায়নি।