
বেনারসের ডায়েরি: প্রথম কিস্তি
একজন মানুষের যেমন অনেক গুলি নাম হয় ঠিক তেমন একটা শহরকেও অনেকে অনেক নামে ডাকে। যেমনটা আমার "কাশী"। কেউ বলে বেনারস,কেউ বলে বারাণসী,কেউ বলে কাশী। এই শহরের তিনটি রেল ষ্টেশনের নাম এখন তাই এই তিনটি নামে পরিচিত। তা বেশ! সেই কাশী শহর আমাকে বারবার টানে। কিসের আকর্ষণে, কেন এই শহরে বারবার আসি,তা কি আমি নিজেও জানি? এবার দুর্গা পুজো কাটাতে এসে গেলাম আবার কাশী,আবার রামকৃষ্ণ আশ্রমের অতিথিশালায়। কাল ষষ্ঠী, আজ পঞ্চমী। কাল রাত আটটায় শিবগঙ্গা এক্সপ্রেসে করে পৌঁছে গেলাম বারাণসী। ছটায় পৌঁছনোর কথা Before Time এ ট্রেন পৌঁছে গেছে। ভাগ্যিস Last Stop ছিল। আমি তো তখনও শুয়ে আছি। হুড়ুম-দুরুম করে উঠলাম। পারমিতা আমার আগে প্ল্যাটফর্মে নেমে গেছে। একটা জিনিস বারবার এখন দেখছি, যে রেলের যে পরিষেবা আমি জানি না, কেন আমার বারবার মনে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে। মাঝখানে যখন আনন্দবাজারে চাকরি করতাম, আমি বহুদিন রেলে যাতায়াত করিনি।
বেশির ভাগ সময়ই যাতায়াত করেছি বিমানে। কিন্তু এখন তো ট্রেনে অনেক যাতায়াত করছি। টয়লেট অনেক পরিষ্কার,অনেক আধুনিক প্রযুক্তি,এমনকী খাবার,কম্বল, তার মানে কী এই ট্রেন লেট করছে না? তার মানে কি এই যে ছোটোখাটো দুর্নীতি নেই? রেলে চুরি বন্ধ হয়ে গেছে? আমরা যখন ট্রেনে উঠলাম এবারেই একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটল। আমাদের কোচ নাম্বার ছিল এ-2। একেবারে শেষ কোচ বলা যেতে পারে। এসি 2 টিয়ারে আমি সবে বসেছি; জানালার ধারে পাশের যে আসন, সে লোকটি খুব চেঁচাচ্ছে,বলছে আমি আমার প্যাকট খাবার এখানে রেখে সবে নেমেছি,এসে দেখছি খাবারের প্যাকেটটা নেই। আসলে তখনও ট্রেন ছাড়েনি। আর চার-পাঁচটা ছেলেকে আমি দেখেছি হইহই করতে করতে তারা এই দরজা দিয়ে ঢুকে ওই দরজা বেড়িয়ে গেলো। তারা কিন্তু যাত্রী নয়। উল্টে একজন আরেকজনকে বলছিল - এ AC কা Compartment হ্যায়। এই AC Compartment তু কভি গ্যয়া হ্যায়? একজন আরেকজনকে বলছিল। কিন্তু আমি তো দেখিনি তো কী করে বলব যে এরাই নিয়েছে?
দিল্লিতে বহু বছর আছি। দিল্লিতে দুর্গা পুজোর সময় পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি দের হাবভাব দেখলে মনে হয় যেন দেশের প্রেসিডেন্টে বা প্রধানমন্ত্রী। এমনিতেই দিল্লিতে বাঙালি বলে নয়,বহু দিল্লিবাসীর মধ্যে জানিনা কেন মাথাপিছু আয় বেশী বলে হতে পারে। একধরনের অহংকার যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ে তাদের আচরণে। চিত্তরঞ্জন পার্কের যে পাড়াতে আমি থাকি সেখানেও বহু মানুষকে দেখি,(বলছি না যে সবাই) তারা কি গাড়ি চাপে মার্সিডিজ না BMW আর তাদের কার কতটা সম্পত্তি এইসব নিয়ে তারা এত মশগুল হয়ে থাকে, মনেহয় এটাই তাদের জীবনের পরম লক্ষ্য। আসলে টাকা পয়সা হলে মানুষের আচরণের মধ্যে একটা পরিবর্তন তো হয়। ওই যে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের একটা গল্প আছে--একটা লোক রামকৃষ্ণ দেখে বলছে, কী ঠাকুর, কেমন আছো? বলার ভঙ্গির মধ্যে কোথায় যেন কিছু একটা ছিল। ঠাকুর ভাগ্নে হৃদয়কে বলছেন --হ্যাঁরে হৃদে মনে হচ্ছে লোকটার টাকা হয়েছে রে! যে ভাবে কথা বলছে!! এই যেভাবে কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে টাকা হওয়ার একটা ব্যাপার ফুটে উঠছে। কী সাংঘাতিক অবজার্ভেশন!
এতোও Journalistic Observation কেও হার মানায়। কাশীতে এসে আনন্দ পাই তার কারণ এখানে রামকৃষ্ণ আশ্রমে পুজো হয় এবং মা দুর্গার নয়নাভিরাম প্রতিমা দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। খুব ঘরোয়া পুজো এবং মানুষেরা যাঁরা আসছেন তারা অনেকই আমাকে চেনে না। ফলে আমাকে নিয়ে খুব একটা টানাটানি নেই। আর আমার কিছু দেখানোর বা প্রমাণ করার নেই। যে সন্ন্যাসী মহারাজরা চেনেন, তাঁরা আমাকে একান্তই নিজের মানুষ মনে করেন। আমি কী দামী জামা পরলাম বা পরলাম না সেটা তাদের কাছে কিছু যায় আসে না। তো এই কারণেই এখানে আসতে ভাল লাগে।
কাশীতে বেশ কয়েকটা জায়গায় দুর্গা পুজো হয় বাইরে। সেসব পুজো দেখার যে খুব একটা আগ্রহ আছে তেমন নয়। কেননা এবারে আমি পুরোপুরি ফোকাসড হয়ে আছি এখানকার পুজো। এমনকী আমি যদি বাবা বিশ্বনাথ দর্শনেও না যাই;(পারমিতা দেখে এসেছে) তাতেও আমার কিচ্ছু যায় আসে না। তার কারণ আমি আশ্রমিক পরিবেশটির অতিথিশালায় আছি। আর ভাল করে পুজোটা উপভোগ করতে চাইছি,দেখতে চাইছি কী ভাবে ঘট স্থাপন হয়, কীভাবে কুমারী পুজো হবে? এখানে কিন্তু কুমারী পুজো হয়। এবং কাশীর আশ্রমের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য --এই আশ্রমে কিন্তু "মা সারদা" নিজে এসেছিলেন। মা সারদা এসেছিলেন শুধু নয়; তিনি এখানে দশটা টাকা দিয়ে ছিলেন। সেই সব নিয়ে অনেক গল্প আছে। সেই সব নিয়ে অনেক কথা বলবো পরে। এই আশ্রমের অনেক বৈশিষ্ট্য আছে এবং এই আশ্রমে দুর্গাপুজো কী ভাবে হয় সেটাই অবজার্ভ করাই আমার সবচেয়ে বড় কাজ।
চলবে...
Disclaimer: এই প্রতিবেদন লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও মতামত। bangla.aajtak.in এর দায় নিচ্ছে না।