scorecardresearch
 

বাংলাদেশে পুজোয় হামলা : তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও একটা অংশ এখনও পশ্চাৎমুখী

অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শেষ ঔপনিবেশিক শক্তি পাকিস্তানের সামরিক শাসন, স্বৈরাচার এবং সাম্প্রদায়িকতারই পুনঃপ্রবর্তনের অনেক আয়োজন চলে। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিস্ময়কর উল্লম্ফনের যুগেও পশ্চাৎমুখী একটি প্রজন্মই গড়ে তোলা হয় যারা আসলে পেঁচার মতো, ওড়ার সময়ও পেছনে তাকায়। এভাবে গেলো শতকের মৌলবাদ এই সহস্রাব্দে এসে জঙ্গিবাদে পরিণত হয়।

Advertisement
বাংলাদেশে হামলা নিয়ে খালেদ হামিদী বাংলাদেশে হামলা নিয়ে খালেদ হামিদী
হাইলাইটস
  • মুজিবুর রহমান যে চার মূল নীতির ভিত্তিতে দেশ শাসন করতে শুরু করেন
  • ধর্মনিরপেক্ষতা তার মধ্যে অন্যতম
  • আরেকটি নীতি ছিলো সমাজতন্ত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে চার মূল নীতির ভিত্তিতে দেশ শাসন করতে শুরু করেন ধর্মনিরপেক্ষতা সেগুলোর অন্যতম। আরেকটি নীতি ছিলো সমাজতন্ত্র। সেইসাথে উদার মানবতাবাদী শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশেছিলো। শোনা যায়, তাঁর এই স্বপ্ন এবং উল্লিখিত সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যবিরোধী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের স্থানীয় সশস্ত্র অনুচরেরাই তাঁকে সপরিবার হত্যা করে। বাংলাদেশকে প্রায়ই ফিরিয়ে নেওয়া হয় প্রাগুক্ত চার নীতির বিপরীত মেরুতে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শেষ  ঔপনিবেশিক শক্তি পাকিস্তানের সামরিক শাসন, স্বৈরাচার এবং সাম্প্রদায়িকতারই পুনঃপ্রবর্তনের অনেক আয়োজন চলে। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিস্ময়কর উল্লম্ফনের যুগেও পশ্চাৎমুখী একটি প্রজন্মই গড়ে তোলা হয় যারা আসলে পেঁচার মতো, ওড়ার সময়ও পেছনে তাকায়। এভাবে গেলো শতকের মৌলবাদ এই সহস্রাব্দে এসে জঙ্গিবাদে পরিণত হয়। যাই হোক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা এই জঙ্গিবাদ কঠোর হস্তে দমন করেন। তাদের নেতাদের, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও কার্যকর করেন। তবুও তারা নিশ্চিহ্ন না হওয়ায় এবারের দুর্গাপূজার মণ্ডপে হামলা কেবল নয়, সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার তাদের পূর্বসূরীদের অপরাধগুলোরও পুনরাবৃত্তি ঘটায় শিশুধর্ষণ, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে। এ বড় মর্মান্তিক এবং ক্ষমার অযোগ্য। আমাদের সরকার অপরাধীদের আটক করছে। 

প্রশ্ন জাগে, গত শতকের চল্লিশের দশকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই সাম্প্রদায়িকতা এই উপমহাদেশে সক্রিয় থাকে কীভাবে? সেই বিশের দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখে মর্মাহত কাজী নজরুল ইসলাম সমালোচনামুখর হয়ে ওঠেন, একাধিক গদ্যে, কবিতায়। তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথেও এ-বিষয়ে আলাপ করেন। সাম্প্রদায়িকতা যে মানুষকে পশুতে পরিণত করে সে-বিষয়ে উভয়েই নিশ্চিত হন। নজরুল বলেন, শিং ও লেজযুক্ত পশু অনেক কম হিংস্র, লেজওয়ালা অথচ শৃঙগহীন বাঘ-ভালুকের চেয়ে। তিনি আক্রমণকারী মৌলবাদীদের শিং ও লেজ ভেতরে থাকা হিংস্রতম প্রাণীর সাথে তুলনা করেন। এদের উদ্ভব কীভাবে হলো মর্মে প্রশ্নও তোলেন। কিন্তু উত্তর সন্ধানের দায়িত্ব কি বর্তান আমাদের ওপর? তবে অবশ্যই স্বীকার্য, লেজ ভেতরে থাকার কথা রবীন্দ্রনাথই প্রথম বলেন সেই আলোচনায়। হিন্দু-মুসলমান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বলেন: 'দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্ত ভেতরের ন্যাজ কাটবে কে?' (সূত্র: নজরুলের গদ্য 'হিন্দু-মুসলমান')

Advertisement
বাংলাদেশে হামলার প্রতিবাদ
বাংলাদেশে হামলার প্রতিবাদ

আরও পেছনে তাকালে ইয়োরোপের ক্রুসেড, মধ্যপ্রাচ্যের জিহাদ ইত্যাদিও সামনে চলে আসে। উল্লেখ্য হয়ে ওঠে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজেদের ভেতরকার হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও শোষণের কথাও। সেসব বিশ্লেষণে না গিয়ে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজস্ব শ্রেয়বোধের সংক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত টানা যায়। যেমন, মুঘল আমলের ভক্তিবাদী কবি 'ভক্ত সালবেগ' জগন্নাথদেবের উদ্দেশে প্রায় প্রাণপাত করে ওড়িয়া ভাষায় ভজন রচনা করেন। কিন্তু পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তাঁকে কোনোদিন প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে শোনা যায়। একই মন্দিরে সৈয়দ মুজতবা আলীরও প্রবেশাধিকার না মেলার গল্প শোনা যায়। তিনি টিকি রেখে মাথা মুণ্ডনপূর্বক কপালে তিলক এঁকে সাধকের পোশাকে সেই মন্দিরে গেলে তাঁকে সাদরে, রীতিমতো পাঁজাকোলা করে, বরণ করে নেওয়া হয়। মুজতবা আলী অনেকটা এমনই বলেন যে, তাঁর গায়ে চিমটি কেটেও পুরোহিতগণ আবিষ্কারে অক্ষম হতেন তিনি কোন সম্প্রদায়ের। তিনি এই সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে 'অদৃশ্য' বলে উল্লেখ করেন এবং পরিতাপ জানান এর জন্যেই যতো হানাহানি, কাটাকাটি হয় বলে। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে, হিন্দুদের এই অস্পৃশ্যতার বোধ সৃষ্টির পেছনে অবিরল উপনিবেশের যুগে ভারতবর্ষে সেই মুসলিম শাসকদের আগমনের ইতিহাসও হয়তো সক্রিয় থেকেছে। 

নিয়ান্ডারথাল পুরুষদের যুগ থেকে ধর্মচর্চা শুরু হলেও ঢের পরে তা সামন্তবাদের পৃষ্ঠপোষক ও পুঁজিবাদের আজ্ঞাবহ হয়ে ওঠে। পরিণত হয় অস্ত্রেও। কেননা সাম্প্রদায়িকতা শ্রেণীবৈষম্যকে বৈধতা দেয়, শ্রেণীশোষণকে আড়াল করে। মনে পড়ে, জঁ জ্যাক রুসোর বর্ণনানুযায়ী, কৃষিসভ্যতার গোড়া পত্তনের পরপরই আদিম সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে যায়, একে ভেঙে দেয়া হয়। এবং,  শোষণমূলক ব্যবস্থা রক্ষার্থে টিকিয় রাখা হয় সাম্প্রদায়িকতাকেও।

পুঁজিবাদের একটি রূপ বিষম কিন্তু উদার মানবতাবাদী সমাজ যা ম্যাকিয়াভেলির ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করার আন্দোলনের ফলে সম্ভব হয়। ধনতন্ত্রের দ্বিতীয় রূপ আগ্রাসী, আধিপত্যবাদী যা পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে প্রমাণিত এবং এই প্রপঞ্চেরই সহায়ক শক্তি সাম্প্রদায়িকতা যা   বাংলাদেশের মতো স্বপ্নিল দেশেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বেদখলের জন্যে যুগে যুগে মরিয়া হয়ে ওঠে। আমাদের বর্তমান অবিকল্প সরকারের বংগবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ব্যাহত করার অপচেষ্টাস্বরূপ সাম্প্রতিক অঘটনগুলো ঘটানো হয়। তাই আহতের-নিহতের অবর্ণনীয় বেদনা আমাদের মরমে এসে লাগে। এম. জোনায়েদের সাথে কণ্ঠ মেলাতে হয় (আমার  বন্ধু, যুক্তরাষ্ট্রে বসে তিনি এই কবিতায় লেখেন):
A festive ritual sinks into the darkness,
The past is dead, future is bleak,
What a mess, what a mess!

A faint voice is mourning in the heat of the night,
No one has the valor to fight!
The bell still tolls, the antique clock still ticks,
Some sunken eyes retire to bed,
No one thinks the blood is RED!
(M Zonaid;Oct. 20, 2021;
VA-USA)

তবু বলি, মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও এই উপমহাদেশের প্রায় দেশেও মৌলবাদীরা নানাভাবে তৎপর। পৃথিবীর সব দেশের সব ধরনের মৌলবাদই নির্মূল হোক। এই-ই আমার একান্ত চাওয়া। জাঁ পল সার্ত্র যে বলেন 'আশাই একমাত্র চালিকাশক্তি', সেই আশাই প্রকাশ করতে চাই এই বলে: আমাদের দেশগুলো কি সুইডেন, নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ডের মতো হয়ে উঠতে পারে না কোনোদিন, সমাজতান্ত্রিক না হওয়া সত্ত্বেও যে-তিন দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত না হওয়ায় জেলখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং গুটিয়ে ফেলার অবস্থায় উপনীত হয়েছে  চার্চ বা গীর্জাগুলোও?

Advertisement

(মতামত লেখকের একান্তই নিজের, আজতক বাংলা এর দায়ভার নেবে না)

Advertisement