শাঁখ বাজবে মাঠে ঘাটে, পুকুর পারে,নতুন সন্ধ্যায়
তুমি আসবে নদী পথে, চাষীর বৌ তীরে অপেক্ষায়,
দেওয়া হবে আলপনা, তোমার পদচিহ্ন আঁকাআঁকি,
তোমাকে বরণ করে তবে ঘরে উঠবে শস্যের ঝাঁকি
পূর্বে দুর্গোৎসব। মধ্য ও পশ্চিম ভারতে নবরাত্রি, উত্তরে দশেরা। শারদোৎসবের আলোর রোশনাইয়ে ঢেকে যায় নগর থেকে গ্রাম। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে বাংলার মা- বৌরা আলপনা দিয়ে দেবীকে বরণ করে ঘরে তোলেন। অবিরাম পরিশ্রম করে দিন গুজরান করা খেটে খাওয়া মানুষগুলো কয়েকটা দিনের জন্য আনন্দস্রোতে ভাসিয়ে দেন তাদের সম্বৎসরের যন্ত্রণার দিনগুলোর স্মৃতি! তবু চারিদিকের এত হাসি-গানের মাঝে এই দেশেরই বুকে কোনো কোনো অঞ্চলে চলে শোক পালন। বেশ কয়েক দিন ধরে দুর্গার হাতে অসুরের মৃত্যুর শোক করেন ওঁরা। দেশের সিংহভাগ মানুষের আনন্দযজ্ঞের মধ্যেই বিষাদের সুর জেগে থাকে বহু আদিবাসি ও সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে।
এদেশের যাঁরা আদি বাসিন্দা তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস যে মহিষাসুর আসলে এক সাঁওতাল রাজা যিনি অনার্যদের হয়ে আর্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁকে কোনোভাবেই পরাস্ত না করতে পেরে আর্যরা এক ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেন। সাঁওতালরা নারীদের সম্মান করতেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন না। সেজন্য আর্য আক্রমণকারীরা দুর্গা নামে এক নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে পাঠান। সেই দুর্গা নামের নারীই মহিষাসুরকে হত্যা করেন।
তাই সারা দেশে যখন কোথাও দুর্গাপূজা, কোথাও নবরাত্রি,কোথাও বা দশেরার উৎসব চলছে সেই দিনগুলোতেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বহু জায়গায় বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে কেউবা পালন করেন দাঁশায় উৎসব, কেউবা করেন মহিষাসুরের পুজো, কেউ বা হুদুড় - দুর্গার জন্য শোকপালন।
দুর্গোপুজোর দিনগুলিতে আজও বাংলার বর্ধমান, পুরুলিয়া, বীরভূম ইত্যাদি জেলার নানা প্রত্যন্তে ও ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড় ইত্যাদি রাজ্যের বেশ কিছু অঞ্চলে 'হায়রে' 'হায়রে' ধ্বনি দিতে দিতে শাড়ি পরে পুরুষদের শোকাবহ নাচ দেখা যায়। এইসব জায়গায় দাঁশায় পরব এবং হুদুড় দুর্গা স্মরণ একই সঙ্গে পালিত হয়। কোনো কোনো পুরুষ শাড়ি বা ধুতি পরলেও এই উৎসবের সময় আদিবাসীদের পরনে থাকে রঙিন জামা-গেঞ্জি, মাথায় কাপড় ফেট্টির মতো বাঁধা, ময়ূর পালক গোঁজা। ধামসা, মাদল, সারিন্দা, করতাল, আড়বাঁশি সহযোগে নাচ আর গানের মাধ্যমে চলে শোকের প্রকাশ।
বেদে এবং পুরাণে যে অসুর ও রাক্ষসদের কথা আছে অনেক পণ্ডিতের মতে তাঁরাই হলেন এই ভারতভূমির আদি বাসিন্দা সাঁওতাল ও আদিবাসী, জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষজন। খেরওয়াল ও মুন্ডারি জনজাতিদের মধ্যে আজও "অসুর " নামে এক আদিবাসি গোষ্ঠীর লোকজন আছেন। এই অসুর গোষ্ঠীর জনজাতিরা অনেক আগে ছিলেন কামার। তাঁরা লোহা গলিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরিতে পারদর্শী। অসুররা উত্তর ও পূর্ব ভারতের বিভিন্ন স্থানে আজও বাস করেন। বিশেষ করে ঝাড়খণ্ডের লাটেহার, গুমলা, লোহারদাগা, খুন্তি, হাজারিবাগ জেলাতে আর পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলায় অনেক জায়গায় এঁদের বাস।
ঝাড়খণ্ডের অসুর জনজাতির মানুষদের মধ্যে ও মধ্যপ্রদেশের কোরকু উপজাতির মানুষদের মধ্যে মহিষাসুর পুজোর প্রচলন আছে। পুরুলিয়ার দু-একটি আদিবাসী অধ্যুষিত স্থানে আজও মহিষাসুরের পুজো উপলক্ষ্যে বড় মেলা বসে।
এমন কী এই বাংলায় আজও কোথাও কোথাও ভাসানের সময় দেবীমূর্তিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার আগে দেবী দুর্গার সাথে মহিষাসুরকেও পুষ্পাঞ্জলি দেবার প্রথা আছে। আজকের ভারতবর্ষে বহুধা সংস্কৃতির সংমিশ্রণের এটি এক নিদর্শন।
এই অসুর প্রজাতির আদিবাসীরা দুর্গাপূজা বা নবরাত্রি উৎসবের দিনগুলোতে নিজেদের গৃহে বন্দী করে রাখেন, গৃহের সমস্ত জানালা বন্ধ করে দেন যাতে সামান্য আলোও বাইরে থেকে না আসে। তাদের বিশ্বাস যে আর্যরা তাদের রাজা হুদুড় - দুর্গা বা মহিষাসুরকে যেভাবে হত্যা করেছিল সেই একইভাবে তাঁদেরও হত্যা করতে পারেন। সেইজন্যই তাঁরা গৃহে স্বেচ্ছাবন্দী থেকে তাদের রাজার মৃত্যুর জন্য শোক পালন করেন।
সাঁওতালি মৌখিক সাহিত্য অনুযায়ী এই শরৎকালেই আর্য-অনার্যের লড়াইতে পরাজিত ও নিহত হন তাঁদের বীর পূর্বপুরুষ হুদুড় দুর্গা। দাঁশায় হল আদিবাসীদের প্রায় এক সপ্তাহব্যাপী উৎসব যা দুর্গোপুজোর সপ্তমীর দিন থেকে শুরু হয়। দাঁশায় পরবকে ঘিরেই হয় দাঁসায় নাচ। শুকনো লাউয়ের খোল দিয়ে তৈরি 'ভুয়াং' হল এই নাচের বাদ্যযন্ত্র। এই খোল এর ভিতরে তীর- ধনুক সহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র লুকানো থাকে। ভুয়াং ছাড়া “দাঁশায় দাঁড়ান ”হয় না। দাঁশায় দাঁড়ানে ভুয়াং একটি অপরিহার্য অঙ্গ ।
পুরুষরা শাড়ি পরে এবং মাথায় বাঁধে ময়ূরের পালক। অনেক সময় গলায়, হাতে, কোমরে স্ত্রীলোকের গয়না পরেও পুরুষরা দাঁশায় নাচে অংশ নেন। প্রত্যেক গানের আগে এবং মাঝে মাঝে দুঃখের আবহ তৈরির জন্য 'হায়রে', 'হায়রে' শব্দের ব্যবহার হয়।
এই দাঁশায় উৎসবের পেছনে একটি মিথ আছে। অনেক কাল আগে দুর্গা নামের এক আদিবাসী যুবতী আর দেবী নামের এক আদিবাসী যুবক একে অপরকে ভালোবাসত। তারা জঙ্গলে নির্জনে যখন দেখা করতে যেত সেইসময় একদিন আর্যরা তাঁদের দুজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আদিবাসীরা সেই খবর পেয়ে তাঁদের চিরাচরিত মাদল, ধামসা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এক গৃহ থেকে আরেক গৃহে ঘুরে ঘুরে তাঁদের খোঁজ করতে থাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। আজও এই উপজাতিদের বিশ্বাস যে সেই দুই প্রেমিক - প্রেমিকা বেঁচে আছে তাদের অজান্তে। তাই এখনও তাঁরা চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী নাচগান করে এই দুই প্রেমিক - প্রেমিকার খোঁজ করে থাকে।
কথিত আছে যে এই দুই অপহৃত যুবক যুবতীকে আর্যদের কবল থেকে ছিনিয়ে আনতে যুদ্ধে যান হুদুড় দুর্গা এবং আর্যদের হাতে নিহত হন। বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে সাঁওতাল সমাজের মানুষজনের একদিন সময় লেগে যায়। তাঁরা মহিলাদের পোশাক পরে, লাউয়ের খোলের মধ্যে তিরের ফলা, অস্ত্র ইত্যাদি লুকিয়ে রেখে হুদুড় দুর্গার খোঁজে বের হন। অতিবৃষ্টি তাদের অনুসন্ধানপর্বকে প্রলম্বিত করে। সাঁওতালি ভাষায় 'দাঁ'-এর অর্থ জল আর 'শায়' হল প্রশমিত হওয়া বা কমা। জল কমার অপেক্ষায় দেরি হয় এবং তাদের প্রিয় মানুষজনকে তৎক্ষণাৎ খুঁজে না পেয়ে 'হায়' 'হায়' শব্দ করে গান করে করে খুঁজতে থাকে।
এখানে বলা প্রয়োজন যে সাঁওতাল সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে যারা চর্চা করেন তাঁদের কেউ কেউ আবার মনে করেন যে হুদুর দুর্গার মৃত্যুর আগে থেকেই দাঁশায় উৎসব প্রচলিত ছিল। দাঁশায় এবং হুদুর দুর্গা নিয়ে অন্য একটি মতও নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রচলিত আছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে হুদুড় দুর্গা ছিলেন সাঁওতাল সমাজের রাজা। এই বীর যোদ্ধার রাজত্বে চাইচম্পা নামক স্থানে সাঁওতালদের মধ্যে সুখ ও সমৃদ্ধি বিরাজ করত। এরই মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটে আর্যদের। তারা সাঁওতালদের রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাঁর রাজত্ব দখল করতে গিয়েও হুদুর দুর্গার বীরত্বের কাছে হার মানে। এরপর তারা চক্রান্তে সামিল হয় এবং সাঁওতালরাজকে পরাস্ত করার রাস্তা খুঁজে বার করে তাঁকে হত্যা করে।
আরেকটি আখ্যান অনুযায়ী দাঁশায় হল খরা-কবলিত দশা থেকে উদ্ধারের উদ্দেশে বৃষ্টির জন্য প্রকৃতি-বন্দনার গান। "হায় হায়" শব্দের প্রয়োগ এখানে খরা-জনিত কষ্টের সূচক। আবার সাঁওতালি ভাষায় "দাঁশায়" একটি মাসের নাম। এই মাসটি বাংলায় শরৎকালের সমসাময়িক ( ইংরেজিতে সেপ্টেম্বর - অক্টোবর মাস)। দীর্ঘ খরা বা অনাবৃষ্টির পর জলের আশায় প্রকৃতি দেবীকে পূজা ও সন্তুষ্ট করে আহ্বান করাই দাঁশায় উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। আর "হুদুড়" শব্দটা মেঘের সাথে তুলনা করার জন্য ব্যবহার করা হয়। আবার অনেকের মতে হুদুড় এক কিংবদন্তির চরিত্র মাত্র, তাঁর ঐতিহাসিকতার কোনো যথাযথ প্রমাণ নেই।
আদিবাসিদের মধ্যে কিছু কিছু জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস যে মহিষাসুর আসলে ছিলেন হুদুড় দুর্গা অর্থাৎ সাঁওতাল রাজা যিনি অনার্যদের হয়ে আর্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁকে কোনোভাবেই পরাস্ত করতে না পেরে আর্য আক্রমণকারীরা দুর্গা নামে এক নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে পাঠান। সেই দুর্গা নামের নারীই মহিষাসুরকে হত্যা করেন।
প্রচলিত রীতি অনুসারে সাঁওতাল প্রজারা তাদের রাজার হত্যাকারীকে প্রত্যাঘাত করতে পারেনি। শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার্থে পুরুষরা স্ত্রীলোকের পোশাক পরে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। সেই থেকে তাদের কল্পিত বীর পূর্বপুরুষ হুদুড় দুর্গার মৃত্যুদিন আদিবাসী সাঁওতালদের কাছে শোক জ্ঞাপনের দিন। 'হায়রে', 'হায়রে' ধ্বনিতে যে গান তাঁরা করে থাকেন দাঁশায় উৎসবের সময় তার উৎস এখানেই।
প্রকৃতির মাঝে যাদের আবাস, প্রকৃতির সন্তান আদিবাসী ও জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষেরা তাই প্রকৃতিরই পূজারী। সূর্য যেমন তেমন গাছ, পাহাড় এসবই তাঁদের দেবতা। প্রকৃতির সাথে একাত্ম জীবনযাপনের সমন্বয়ে বেড়ে উঠেছে যে সহজিয়া সমাজ ও সংস্কৃতি, বহিরাগত কর্তৃত্বমূলক সংস্কৃতির চাপে আজ তা বিলীন হবার পথে। যুগে যুগে এভাবেই বৃহৎ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে নিষ্পেষিত হয়েছে খণ্ড সংস্কৃতি। ভারতের বেশীরভাগ অঞ্চলেই আজ প্যান ইন্ডিয়ান কালচারের আক্রমণাত্মক আগ্রাসনের কাছে পিছু হটতে হটতে দেয়ালে পিঠ থেকে গিয়েছে জনজাতি গোষ্ঠীগুলির নিজেদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের। আজকাল বেশিরভাগ আদিবাসীরাই দাঁশায়ের বদলে দশেরার উৎসবে মেতে উঠছে এটা নির্মম সত্য। কিন্তু দুঃখশোকের ঘটমানতাকে সংগীত ও নৃত্যের সাহচর্যে উৎসবে রূপান্তরিত করতে পারেন যে সরল অথচ অভাবী মানুষজনেরা, তাঁদের জীবনবোধকে প্রণাম। সেই জীবনবোধের ধারাটি বিলুপ্ত হলে সেটা আমাদের সভ্যতার সংকটকেই ঘনীভূত করবে।
(মতামত লেখকের একান্তই নিজের, আজতক বাংলা এর দায়ভার নেবে না)