
বেনারসের ডায়েরি: পঞ্চম ও শেষ কিস্তি
সন্ধিপুজো
দুর্গাপুজোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হল সন্ধি পুজো। মহাষ্টমী এবং মহানবমীর সন্ধিক্ষণে এই পুজো হয় বলে একে ‘সন্ধি পুজো’ বলা হয়। মহাষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট এবং মহানবমীর প্রথম ২৪ মিনিট অর্থাৎ ৪৮ মিনিট ধরে চলে সন্ধি পুজো। ১০৮টি পদ্ম এবং ১০৮টি মাটির প্রদীপ সন্ধি পুজোর ক্ষেত্রে দরকার পড়ে। সন্ধি পুজোয় দেবী দুর্গাকে পুজো করা হয় চামুণ্ডা রূপে।
যখন মহিষাসুরের সঙ্গে দেবী যুদ্ধ করছিলেন, সেই সময় চণ্ড ও মুণ্ড দেবীকে আক্রমণ করেছিল। চণ্ড ও মুণ্ড ছিল মহিষাসুরের দুই সেনাপতি। তাদের দেবী দুর্গা বধ করেছিলেন। সেই থেকে দেবীর নাম হয় চামুণ্ডা। চণ্ড ও মুণ্ডকে যে সন্ধিক্ষণে দেবী বধ করেছিলেন, তাকে স্মরণে রেখেই সন্ধি পুজোর আয়োজন করা হয়।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে এখানে পুজো হয়। এই পুজো সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে সন্ধিপুজো শুরু হয়েছে। কুমারী পুজো যেমন চোখের সামনে দেখা যায় কুমারীকে। সন্ধিপুজোকে তো দেখা যায় না,কাকে বলে সন্ধিপুজো। বোঝার চেষ্টা করছি। আরেকটা কথা হচ্ছে,এখানে কোনও পশু হত্যা তো হয় না। রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম দিন থেকেই মায়ের নিষেধ। কোন পশুবলী না হয়। তার ফলে চালকুমড়ো বিরাট করে মাটির উপর বসানো হয়েছে। চালকুমড়ো কাটা হবে। সেটাই এখানকার বৈশিষ্ট্য।
নবমীর ডায়েরি
আজ শুভ নবমী। ভক্ত নিবাস থেকে চলেছি ঠাকুর মন্দিরের দিকে। একটা করে দিন চলে যায়। পুজোর চারটি দিন কী দ্রুত অশ্বের মতো ধাবমান। এক ভক্ত বলছিলেন, চারটি দিন কীভাবে কেটে যায়, তারপর যেন বছরটা যেন কাটতেই চায় না। এবার যাব কেদার ঘাটে। কেদার ঘাটে কেদারেশ্বর মহাদেব। গঙ্গার দিকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাঁদিকে বিরাট নীলকণ্ঠেশ্বর মহালিঙ্গ। গঙ্গা দর্শন এবার কেদার মন্দির থেকে। আসলে,কেদারের একটা পৃথক তাৎপর্য আছে। সেই তাৎপর্য হল, এখানে স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন শুধু নয়,এই গর্ভগৃহে সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে সঙ্গে ছিল তার কতিপয় গুরুভাই এবং পূর্বাশ্রমের ভ্রাতা মহেন্দ্র লাল দত্ত। মহেন্দ্র দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় সেই সমাধিস্থ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য বর্ণনা করেছেন। এরপর স্বামীজি এসে যখন গাড়িতে বসলেন তখনও মুখ একই রকম গম্ভীর। ভাবের হেরফের তখনও হয়নি। বেশ কিছুক্ষণ ঘোড়ার গাড়ি চলার পর আস্তে আস্তে অবয়ব স্বাভাবিক হল। তখন তিনি দক্ষিণী ভাষার অনুকরণে কিছু কথা বলতে লাগলেন। যার মধ্যে রসিকতাও ছিল। আসলে স্বামীজি দেহ রাখার কয়েক মাস আগে এই সফর। তখন এক সাধু এসেছিলেন তাকে দর্শন করার জন্য এবং সেই সাধু এসেছিলেন কেদার মঠ থেকে। দক্ষিণ ভারতের সাধু তামিল মঠে দক্ষিণ ভারতে পরিভ্রমণের সময় যেতে পারে নি। তাই অনুরোধ করেছিলেন বারাণসীর মঠে এসে ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করেন । স্বামীজি সেই অনুরোধ স্বীকার করে গেছিলেন । কেদার ঘাটের পাশে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ স্পর্শধন্য বাড়িটি আছে। যে বাড়িতে ছিলেন।শুনলাম সেই বাড়িটি,বাড়ির মালিক বিক্রি করে দিয়েছেন। যে ঘরটিতে ঠাকুর ছিলেন সেই ঘরে ঠাকুরের পাদুকা জোড়া রয়েছে। সেই পাদুকা ঠাকুরের কিনা,সেই নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস সেই পাদুকা টি সেখানে আছে। এই বাড়িটা র সেই ঘরটার ভবিষ্যত্ কী হবে,সেইটা জানার চেষ্টা করব।
কাশীতে দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথনের সুযোগ এসে গেছে অনেকটাই। এবার অভ্যাস,শৃঙ্খলা,সংস্কার এসব নিয়ে নানান ভাবনা চিন্তা কাজ করছে। ছোটবেলায় যখন নরেন্দ্রপুরে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম তখন আমাদের সারাটা দিন ছিল খুব রুটিনবদ্ধ। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমরা ফিজিক্যাল ট্রেনিংয়ে যেতাম। তারপর শুরু হত প্রার্থনায় যোগ দেওয়া। প্রাতরাশের ঘন্টা বাজতো,যেতাম ভোজন কক্ষে। খুব সকালে ন'টার সময় স্কুলে চলে যেতাম। ফিরে আসতাম দুপুর বেলা। স্নান করে খাওয়াদাওয়া সেরে আবার স্কুলে যেতাম। বিকেলবেলা এসে খেলতে যেতাম। লাইব্রেরি যাওয়া এবং সন্ধ্যাবেলা আবার আরতি,তারপর স্টাডিকক্ষে গিয়ে একযোগে পড়াশোনা,তারপর ঘরে ফিরে একটু গল্প গুজব করেই খাওয়ার ঘণ্টা বাজতো। তারপর নৈশভোজ। তারপর শুয়ে পড়ার ঘণ্টা বাজতো এবং কোন কোন ঘরে লাইট জ্বলছে তা দেখার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত আমাদেরই কোন ছাত্রের থাকত। সে-ই ঘুরে বেড়াতো আর বলতো এখন লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পর। লুকিয়েও পড়াশোনা করা যাবে না। এই যে শৃঙ্খলা,তখন কিন্তু এটা ভাল লাগতো না এবং তখন বিশৃঙ্খলা প্রয়োজন। শৃঙ্খলাকে অমান্য করাও প্রয়োজন আছে বলে মনে হত। যৌবনে মার্ক্সবাদের প্রভাব এল এবং সমাজের যে নৈরাজ্য;সেই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কোথায় একটা বিদ্রোহ বিপ্লবের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়েছিল। বিদ্রোহ বিপ্লব মানেই হল একটা বিশৃঙ্খলা। একটা Status quo সেটা কী ভালো! সেটা যদি একটা শোষণের সমাজ হয়;সেটাকে রক্ষা করা সেটা তো শাসকের স্বার্থে ;শোষকের স্বার্থ। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর চারদিকে বলতে গেলে দরকার Disorder. জর্জ বার্নার্ড শ র একটা বিখ্যাত উক্তি -Disorder is beginning of justice.কিন্তু এইটা যেমন একটা দিক।এখন আমার মনে হয় অভ্যাসের দাস আমরা। যা অভ্যাস করবো তাই হবে। যদি মনে হয় মিষ্টি খাওয়া উচিত নয়,কিন্তু দীর্ঘ দিনের লালিত অভ্যাস থেকে বেরোতে পারছি না। অভ্যাসের জন্যে চাই একটা রুটিন,একটা শৃঙ্খলা। এর প্রয়োজনীয়তা কী নেই!
এবার Spirituality-র দিক থেকে যদি দেখি, সেখানে যদি আমি মনে করি আমি অখণ্ডবাদী,অদ্বৈতবাদকে বিশ্বাস করি;পৌত্তলিকতার প্রতি আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই;পুজো দিলাম কী দিলাম না, অঞ্জলির ফুলটা কোথায় গিয়ে পড়ল কী পড়ল না। শেষ পর্যন্ত জঞ্জালেই পরিণত হয়। মনের মধ্যে যে অঞ্জলি সেটাই সব থেকে বড়। সবই মানলাম কিন্তু ওই যে আসনে বসার একটা অভ্যাস। জপটা করতে বসার যে একটা অভ্যাস। তা না হলে তো শৃঙ্খলাটাও কোনদিনও জীবনে আসবে না । এই যে এত ভোরবেলা উঠে এখানে রোজ আসি!প্রথম দিন যে কষ্টটা হয়ে ছিল,এখন কিন্তু সেই কষ্টটা আর হচ্ছে না । আস্তে আস্তে অভ্যাসে হয়ে যাচ্ছে। এখানে সকাল বেলা মঙ্গল আরতি হয়। একটা নিস্তব্ধ,নিস্তরঙ্গ পরিবেশ। কেউ কারুর সাথে কথা বলছে না চুপচাপ। অনেকে গায়ে চাদর দিয়ে জপ করছে।যাতে জপ দৃশ্যমান না হয়। তারপর বেঞ্চিতে বসে আমরা আরতি দেখি এবং সেটার পর লাইন দিয়ে এক এক করে আরতির হোম মাথায় নেয়। আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঠাকুরকে কাছ থেকে দর্শন,প্রণাম করে,মন্দির প্রদক্ষিণ করে চরণামৃত ও প্রসাদ(মাখন ও মিষ্টি) গ্রহণ করে। সন্ন্যাসীরা আগে যায় তারপর গৃহীরা যায় তারপর স্বেচ্ছাসেবকরা যায়। এত ভোরবেলাতেও এখানে কিন্তু খুব কম লোক বলা যাবে না। এখানে মূল প্রশ্নটা হচ্ছে;এই যে শৃঙ্খলা। যেমন চরণামৃত নিয়ে হাত ধুলাম, এই হাত না ধুলে কি আমার ভক্তি কমে যেত? সিঁড়ি দিয়ে উঠে হনুমানজির মন্দিরে গেলাম যেটা লাটু মহারাজ স্থাপন করেছেন। সেই ঘরে গিয়ে প্রণাম করলাম, পুরনো সব ছবি দেখলাম। রোজই দেখি। সেখানে জগন্নাথের ছবিটি খুব আকর্ষণ করে। তারপর বেরিয়ে এসে চা খেতে খেতে এইসব ভাবছি। ভাবছি, এই যে শৃঙ্খলা, খাবার সময় এখানে ডাইনিং হলে কেউ চীৎকার করে কথা বলে না। এই যে খাবার শুরু করার আগে আমরা যে ব্রক্ষ্মকে অর্পণ করি - ব্রক্ষ্মা পরমং;ব্রক্ষ্মা হবি; ব্রক্ষ্মা জ্ঞানৌ; ব্রক্ষ্মা নহুতম;ব্রক্ষ্মভৈ তেন;গন্তব্যম ব্রক্ষ্মা কর্ম সমাধিনাম। হরি ওঁ তৎসৎ। এই যে ব্রক্ষ্মকে অর্পণ করে আহার গ্রহণ করছি,এইগুলি সবই কিন্তু নিয়ম।
হিন্দি ছবি খুবসুরত-এ দেখেছিলাম রেখা বাড়ির শৃঙ্খলা ভাঙাচ্ছে। তাসের দেশ অচলায়তন তৈরি করে, সেটাও আরেক দিক। সেখানে কানুন কানুন।কানুনকে ভাঙ্গার গান ছিল। ওটা তাসের দেশ অচলায়তনের প্রভাব আছে।বাঙালি পরিচালক বাসু চ্যাটার্জির ছবি ছিল। এই যে দুটো দিক!একটা নিয়ম ভাঙ্গা আরেকটা হচ্ছে নিয়মকে রক্ষা করা। আসলে আমার মনে হয় যে এর মধ্যে জীবনে দরকার একটা ভারসাম্য।অর্থাৎ ভারসাম্য রক্ষা করে শুধু শুকনো নিয়মের মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছি।মহাষ্টমীতে সন্ধিপুজোর সময় চালকুমড়ো বলিদান ঠিক করে হচ্ছে কিনা? মাকে তিন রকমের ফলের রস(বেদনা; মৌসম্বী; আখের) দেওয়া হচ্ছে কিনা নিয়ম মেনে। সেটার জন্য নিয়মনিষ্ঠ হওয়া সেটা একটা জিনিস। আরেকটা জিনিস হচ্ছে একদমই নিয়ম না মেনে। আমি জুতো পরেও তো মন্দিরে যেতে পারি। এখন কথা হচ্ছে সেটা ধুলোর জন্য নয়,কোথায় একটা শ্রদ্ধার সম্পর্ক আছে। মন্দিরে যেমন লেখা থাকে না জুতো এবং অহংকার দুটোই খুলে আসো। এই যে Symbolism র একটা প্রয়োজনীয়তা আছে। সন্ন্যাসী হলে গেরুয়া পোশাক পরতে হয়।জিন্স পরে যদি ঠাকুরের ঘরে যাই কেউ কিছু বলবে না
কিন্তু সব কিছুরই একটা Symbolism থাকে। সেটাই জীবনের একটা নত্ব-সত্ব জ্ঞান তৈরী করে। সেই ব্যাকরণটাই হচ্ছে একটা মর্জিন পথ। অর্থাৎ কোন কিছুই অতিরিক্ত হওয়া উচিত নয়।
প্রত্যকবছর শ্রী শ্রী মা দুর্গার আগমনী উপলক্ষে দেবীপক্ষে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের নানান কেন্দ্রে শ্রী মহিষাসুরমর্দিনী স্রোত্রম গীত হয়ে থাকে। স্তোত্রটি শ্রী রামকৃষ্ণ কবীর লেখনী প্রসূত।সুর বৈচিত্র্যে এবং ছন্দ মাধুর্যে অনন্য। প্রতিটি ছত্রে ছত্রে স্তবকে স্তবকে ভক্ত হৃদয়ের অদ্ভুত একটা স্তবগান প্রেরণা দেয়। এই স্তোত্র গীতের সাথে আরো দুটো স্তোত্র যথা স্বামী বিবেকানন্দ স্বরচিত অম্বা স্তোত্রম এবং শঙ্করাচার্য বিরচিত ভবানীষ্টোকম। একই সঙ্গে এই উপলক্ষে মঠ ও মিশনের শক্তি সঞ্চারে সঞ্চারিত করে এই স্তোত্র পাঠ হয়। এই স্তোত্র অনেক আদি। কারণ মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্রম এতো অতীতে যেমন অম্বা স্তোত্রম সেটা স্বামীজির লেখা। শঙ্করাচার্যের ভবানীষ্টোকম স্বামী গম্ভীরানন্দজী সম্পাদিত উদ্বোধন কার্যালয়ে স্তবকুসুম অঞ্জলিতে প্রকাশ করে ।সব মিলিয়ে এই সমস্ত স্তোত্র গুলো দুর্গাপুজোর সময় বেশী বেশী করে শোনা যায়।আজকে এখানেও সব স্তোত্র উপভোগ করছি। এই যে চন্ড মুন্ডকে সন্ধি পুজোর সময়ে বধ করা। শাস্ত্রে বলা আছে এই সময় নিবেদিত প্রাণ মনটাকে উৎসর্গ করে;সেটাই যথার্থ বলিদান।বলিদান হচ্ছে আত্মসমর্পণ;আত্মত্যাগ। ছাগু বলির মতো নিজেকেও বলি দেওয়া যায় মানে ইগোকে বিসর্জন দেওয়া যায়। সেটাও কিন্তু এক ধরনের বলিদান। এই বলিদানের প্রতিজ্ঞা নিচ্ছি যে দুর্গাপুজোর সময় আত্ম অহংকারকে বলিদান দিচ্ছি। এই যে সন্ধিপুজোর সময় অষ্টমী শেষ হয়ে গিয়ে নবমী পড়ে গেল তার যে মাহাত্ম্যকথা সেটাও আপনাদের জানাবো।
আধ্যাত্ম রামায়ণ
আধ্যাত্ম রামায়ণ এটা কিন্তু বিশেষ রামায়ণ। যেটার মধ্যে রামায়ণের দর্শন নিহিত আছে । রামায়ণ তো নানা রকমের আছে ।বাল্মীকি রামায়ণ,বশিষ্ঠ রামায়ণ, আনন্দ রামায়ণ,অগস্ত রামায়ণ(সংস্কৃতে),কম্বা রামায়ণ(তামিলে),তুলসীদাস রামায়ণ(হিন্দিতে),কৃত্তিবাসী রামায়ণ (বাংলায়),এজুথাচন আধ্যাত্ম রামায়ণ(মালায়লি ভাষায়)।সুতরাং এই সমস্ত রামায়ণগুলি কিন্তু রামকৃষ্ণ, রামায়ণের কাহিনি। কিন্তু কবি ও ভক্ত যে রামায়ণ তার থেকে বাল্মীকি রামায়ণ থেকে যেমন অনেক পরিবর্তন আসে এবং বিভিন্ন রামায়ণ তার আঞ্চলিক নানা রকমের Flavour যুক্ত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক রামায়ণ এই সমস্ত রামায়ণগুলি থেকে যে দর্শন,সেই দর্শনের বাল্মীকি রামায়ণ থেকেই নেওয়া এবং আরো যে আঞ্চলিক রামায়ণ তারও কাছ থেকে নেওয়া।সাধারণত রামায়ণে যুদ্ধ অনেক বড় হয়ে ওঠে। সুন্দরকান্ড জনপ্রিয়তা এবং ভক্তের আকর্ষণের আর একটা বড় কারণ রাভা এবং হনুমানের সম্পর্ক এবং কথোপকথনের একটা নির্যাস আছে। এখানে একটা দর্শন নিহিত আছে। আধ্যাত্ম রামায়ণ কিন্তু রামের যে আধ্যাত্ম চেতনা সেইটা গুরুত্ব দিয়ে সেই দর্শনকে তুলে আনা হয়েছে। সুতারং বলা হয় যে বৈদিক যে Study এবং সেটার মধ্য থেকে রামায়ণকে বিশ্লেষণ করা এটাও আধ্যত্মবাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে নবমীর দিনে যে বিশেষ পুজো হয় সেটাও নজর কাড়া। তার কারণ নবরাত্রির প্রত্যেকটা দিনের দেবীর একটা রূপ আছে এক একটা নাম আছে। নবমীর দিনে মা 'বিপদনাশিনী' এবং সেখানে মায়ের কাছে আমারা বিপদমুক্ত হওয়ার প্রার্থনা করি। রামকৃষ্ণ মিশনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এখানে তো অন্য অনুসঙ্গকে যতটা গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তার থেকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয় নিষ্ঠা করে পুজো। রামকৃষ্ণ মিশনের যে পুজো হয়, সে পুজো মিশনের ব্রহ্মচারী এবং সন্ন্যাসীরা করেন। এখানে আমার একটা বিষয় জানার ছিল--এই পুজোটা ব্রাহ্মণরা করেন না কী আব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীও তার পূর্বাশ্রমে তিনি যদি অব্রাহ্মণ হন তাহলেও তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের পর পুজো করতে পারেন কিনা? এই প্রশ্নের জবাব হল পারেন। তার কারণ গোটা রামকৃষ্ণ মিশনের আড়াইশোটা শাখা। চারদিকে কত রকমের পুজো! শ্রীরামকৃষ্ণের পুজো তো সন্ন্যাসীরা অব্রাহ্মণ হয়েও করতে পারেন। স্বামীজি নিজে তো ব্রাহ্মণ ছিলেন না এবং তিনি যখন সন্ন্যাস ধর্ম দেন তার গুরুভাইদের,তখন প্রত্যেককে পৈতে পরিয়েছিলেন এবং প্রথাটা হচ্ছে যে সন্ন্যাস গ্রহণের পর সেই পৈতে আর মাথার শিখা (মানে মাথার টিকি)এবং একটা দণ্ডি গঙ্গাজলে বিসর্জন দেওয়া হয় এবং ব্রহ্মচারী থেকে তারা সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তবে বেনারস এবং কতগুলো জায়গায় এখনও ব্রাহ্মণ দ্বারা দেবীর পুজো হয়। এই যে সিদ্ধান্তটা এখানে পুজোটা ব্রাহ্মণরা করবেন সেটাও কিন্তু বেলুড় মঠের যারা Trusty তাদের বৈঠক হয় এবং তাদের অনেক আলোচনা হয়েছিল। কতগুলো কেন্দ্রে ব্রাহ্মণদের দ্বারা ঠাকুরের পুজো হবে এরকম একটা অলিখিত সিদ্ধান্ত হয়ে রয়েছে। যাইহোক,এখানে জাতপাতের বিষয়টা নেই। এখানে ব্রাহ্মণত্ব জাতের বিষয় নয়। কিন্তু ব্রাহ্মণ যিনি হবেন তাকে জানাতে হবে শাস্ত্র,শ্লোক এবং মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্র এবং তাকে পন্ডিত হতে হবে। অনেক বেঞ্চি পাতা আছে।আশ্রমে পূজো হচ্ছে মায়ের,বসে বসে পুজো দেখতে দেখতে কেটে যায়। তারপর হোম হলো। হোম ভারী সুন্দর লাগে। হোমের গন্ধ,হোমের টিকা পড়ানো।একটা অসাধারণ আমাদের সংস্কৃতি এবং হিন্দু ধর্মের সঙ্গে যুক্ত।আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির একটা অনন্য রূপ।এরপর সন্ধ্যাবেলায় কালী কীর্তন হলো। বেনারস রামকৃষ্ণ মিশনের সচিব কল্যাণ মহারাজ অসম্ভব ভালো কাল কীর্তন করলেন।কীর্তন শুনতে নেশার মতো লাগছিলো। অন্তত কুড়িখানা কীর্তন গাইলেন। কীর্তন তো আমারা জানি মুক্তি আন্দোলনের সাথে যুক্ত।আমরা জানি এটা পাঞ্জাবেও হয়েছিল সুফি আন্দোলনের মধ্যেও কীর্তনের বৈশিষ্ট্য ছিল। চৈতন্যদেব কীর্তনকে জনপ্রিয় করেন কিন্তু চৈতন্যদেবের কীর্তন মূলত বৈষ্ণব ধর্মের উপরে তৈরি এবং 'হরেকৃষ্ণ হরেরাম' একই কথা ষোলো বার গান গাওয়া বা একটা পদ সৃষ্টি করা। কিন্তু কালী কীর্তন কি ভাবে এলো? বৈষ্ণব কীর্তন আর কালী কীর্তনের মধ্যে তফাৎ আছে। কালী কীর্তনের ইতিহাসটা কিন্তু আলাদা। সেখানে রামপ্রসাদের ভূমিকা আছে,ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভূমিকাও আছে। অসম্ভব ভালো লেগেছে এই কালী কীর্তন। এই কালী কীর্তন সন্ধ্যা সাতটা থেকে ন'টা পর্যন্ত হয়েছে। তারপর আমরা খেতে গেলাম ডাইনিং হলে। এভাবেই কেটে গেল নবমীর দিনটা।
দশমীর ডায়েরি:
আজ দশমী। সকালবেলা মায়ের পুজো এবং তারপর অঞ্জলি এবং মায়ের দর্পণ বিসর্জন। সেটাই আসল বিসর্জন। সবই সকালবেলা হয়ে যাচ্ছে। দর্পণ বিসর্জনের পর (এখানে গঙ্গায় বিসর্জন নিষিদ্ধ) কাছেই গৌরীকুণ্ডতে মায়ের মূর্তিকে বিসর্জন দেওয়া হয়। অনেক জায়গাতে মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয় না। যেমন, পাঁচ বছর, ১০ বছর নয়। ২৫৬ বছর ধরে বিসর্জন ছাড়া একই মাতৃপ্রতিমায় পুজো হয়ে আসছে পুরাতন দুর্গাবাটিতে। প্রতিমায় থাকা খড়, কাদা, বাঁশ, সুতো কোন কিছুই নষ্ট হয়নি। উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে এই অপরিবর্তিত দুর্গামূর্তিতে এবারও প্রথা মেনে পুজো হবে। নিত্য পুজো হলেও মা উমার আগমনে বারাণসীর পুরাতন দুর্গা বাটি বা দুর্গা বাড়ি নবরূপে সেজে উঠছে।
ঠাকুরদালানে চলছে চুনের প্রলেপ। ধুলো, আস্তরন সরিয়ে ঢাকে কাঠি পড়ছে। ঝাড়বাতি থেকে সরানো হচ্ছে ঝুল। যেন নতুন চেহারায় সেজে উঠছে বারাণসীর সবচেয়ে প্রাচীন বনেদি পরিবারের দুর্গাপুজোর (Durga Puja 2023) পরিমণ্ডল। এই পুজোর যোগ যে রয়েছে বাংলার সঙ্গে। হুগলির জনাই রোডের মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো বারাণসীতে চলে গিয়েছিল। কী কারণে ওই পুজো কাশীতে গেল, তা জানা নেই ওই মুখোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের।
সময়টা ১৭৬৭। সে বছরই বারাণসীতে ওই পুজো প্রথম শুরু হয়। উত্তরপ্রদেশের ওই শহরের মদনপুরা এলাকায় একচালার প্রতিমা গড়ে মাকে পুজো দেওয়া হয়। মহাষষ্ঠীতে বোধন হয়ে চারদিন ধরে সমস্ত নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে মায়ের পূজো চলে। তবুও দশমীতে ঘটে গেল অলৌকিক ঘটনা। মাকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য মাতৃপ্রতিমা তোলার চেষ্টা করলেন ওই পরিবারের সদস্যরা সহ অনেকেই। কিন্তু শত চেষ্টাতেও নড়ানো গেল না মায়ের মূর্তি। একেবারে পাথরের মতো বসে রইলেন দশভূজা। হইচই বেঁধে গেল ওই দুর্গাবাটিতে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র মদনপুরা, লাগোয়া বাঙালিটোলা সহ সমগ্র বারাণসীতেই। ভিড় বাড়তে লাগল দুর্গাবাটিতে।
তবে ওই রাতেই মুখোপাধ্যায় পরিবারের কর্তা দেবীর স্বপ্নাদেশ পেলেন, “আমি এখানে থেকেই কাশী বাস করব। আমাকে এখান থেকে সরানোর চেষ্টা যেন না করা হয়।” মুখোপাধ্যায় পরিবারের কর্তা ওই স্বপ্ন পাওয়ার পর আর মাকে সরানোর চেষ্টা করা হয়নি। মায়ের ওই প্রতিমাতেই বছর বছর ধরে পুজো হয়ে আসছে। কিন্তু মাটির তৈরি মূর্তি ২৫০ বছরের বেশি সময় ধরে কিভাবে অক্ষত রয়েছে তা জানা নেই মায়ের সেবাইত থেকে ওই মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যদের। এ যে অলৌকিক ঘটনা তা জানে এই প্রাচীন শহর। ফলে এই পুজোর মাহাত্ম্যই আলাদা।
এই শহরের সকল মানুষ জানেন, পুরাতন দুর্গা বাটির মা উমাকে ঘিরে এমন ইতিহাস। ওই পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, পুজোর সময় কেবল নতুন গয়না ও শাড়িতেই সেজে ওঠেন দেবী। ৫-৬ বছর পর মূর্তিতে শুধু রঙের প্রলেপ পড়ে এই যা।বর্তমানে ওই মুখোপাধ্যায় পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সোনালি মুখোপাধ্যায় পুজো নিয়ে একটি কথাও বলতে চাননি। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই ওই ঠাকুরদালানে থাকা একটি বড় নোটিশ বোর্ডের দিকে আঙুল দেখিয়ে দেন। সেই বোর্ডেই এই পুজোর কিছুটা ইতিহাস রয়েছে। দেবী দুর্গা ওই মুখোপাধ্যায় পরিবারের কর্তাকে স্বপ্নে বলেছিলেন, তাকে যেন ছোলা-গুড় দিয়েই পূজো দেওয়া হয়। ফলে পুজোতে ছোলা-গুড় থাকবেই।
মায়ের বর্তমান সেবাইত রীনা পাল বলেন, 'হুগলির জনাই রোডের এই পুজো বারাণসীতে যখন ১৭৬৭ সালে প্রথম শুরু হয়। সেই বছর দশমীতে মাকে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু এক ইঞ্চিও সরানো যায়নি এই মাতৃপ্রতিমা। মা স্বপ্নে জানিয়েছিলেন, তিনি কাশীতেই থাকতে চান। এরপর থেকেই চিরস্থায়ী হয়েছে মায়ের কাশীবাস। মায়ের নির্দেশ মতো ছোলা-গুড় দিয়ে পুজো করা হয়।'
বাংলার বনেদি বাড়ির পুজোর মতোই মুখোপাধ্যায় পরিবারের আত্মীয়রা পুজোর সময় দুর্গা বাটিতে পা রেখে উৎসবে মাতেন। হয় নানান অনুষ্ঠান। কাশীর এই ঠাকুরদালানে মহাষষ্ঠী থেকেই ভিড় উপচে পড়ে। মা দুর্গার পাশেই রয়েছে বিষ্ণুর কালো পাথরের মূর্তি। যা এক হাজার বছরের প্রাচীন। ২৫০ বছরের বেশি মাটির এই দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে বিষ্ণুর ওই মূর্তি দেখতেও বারাণসীর দুর্গাবাটিতে এইভাবে শেষ হয়ে গেল বিসর্জন। এটাই বিজয়া দশমীর কাহিনি। এরপর সন্ধ্যাবেলায় গুরুজনদের প্রণাম,কোলাকুলি,শুভেচ্ছা বিনিময়।আগামীকাল একাদশী। এই দিনে এখানে রামগান হয়। সেটাও খুব সুন্দর হয়ে থাকে। সেই রামগান শুনে আমরা দ্বাদশীর দিন রওনা দেব দিল্লির পথে।
শেষ।