
বেনারসের ডায়েরি: দ্বিতীয় কিস্তি
কাশীর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ভারতে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রথম প্রস্তর নির্মিত মন্দির কিন্তু এখানে। দ্বিতীয়ত, শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রথম মর্মর বিগ্রহ এই আশ্রমেই আছে। এই বিগ্রহের মডেল ষ্টুডিয়োতে গিয়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দজী সংশোধন করেছিলেন সঙ্গে স্বামী সারাদানন্দজী এবং গোলাপ মা ও স্বামী নির্বানন্দজী গিয়েছিলেন। তৃতীয়তঃ, এখানে শ্রীশ্রীঠাকুরের পাশে স্বামীজির ছবি বসিয়ে উভয়ের একসঙ্গে প্রথম পূজা প্রবর্তন করেন পূজনীয় স্বামী শিবানন্দজী মহারাজ। চতুর্থত, মা সারদা দেবী স্হুল শরীরে থাকাকালীন নিজ হস্তে,নিজ প্রতিকৃতি মন্দিরে স্থাপন করে পুষ্প প্রদান করেন এবং নিত্য পুষ্প প্রদান করার আদেশ দেন। সেই প্রতিকৃতি আজও মন্দিরে পূজিত। পঞ্চমত: এখানেই শ্রীমন্দিরে স্বামীজির পরিব্রাজক প্রতিকৃতি পূজিত হয়। ষষ্ঠত: শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের মধ্যে কেবল এই আশ্রমে মহাবীরের বিগ্রহসহ পৃথক মন্দির ও নিত্য পূজার ব্যবস্থা রয়েছে।
সবচেয়ে মজার গপ্পোটা আজ আশ্রমে বললেন পরাশর মহারাজ। পরাশর মহারাজ এখন অতিথিশালার ভারপ্রাপ্ত। প্রত্যকবার এলেই ওঁর সঙ্গে একটু গল্প গুজব হয়। তা আমাকে বললেন, আপনি এই বারবার দিল্লি থেকে বেনারসের আশ্রমে চলে আসেন,আপনি একেবারেই চলে আসুন। এখানে একটা ঠাঁই পেয়ে যাবেন। এখানেই থেকে যান না বাকি জীবনটা। আর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসুন। একসঙ্গে এখানে থাকুনষ। সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চলে আসুন। তারপর উনি বললেন -আপনি তো এখন অবসরপ্রাপ্ত। আপনার পিছুটান কোথায়? আমি বললাম অবসর পাচ্ছি কোথায়? অবসর নিতে চাইছি,কিন্তু সাংবাদিকতা পেশাটি এমনই যেন অবসর বলে কিছু হয় না। আমাকে তো ছাড়ছে না এই পেশা। এখন আমি আনন্দবাজার ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু, INDIA Today, AajTak Group-এ কাজ করছি। আরও কতো জায়গায় যে লিখছি, আর কতো জায়গায় যে বকবক করছি!
তখন উনি বললেন --ও! বুঝেছি, কম্বল আপনাকে ছাড়ছে না। আমি বললাম তার মানে? উনি বললেন আপনি কম্বলের গল্প জানেন না? না তো জানি না! একজন সাধু তার চেলাকে নিয়ে গঙ্গার ঘাটে বসে আছে। (মনে করুন দশাশ্বমেধ ঘাটে)। হঠাৎ দেখল, আর একটা সাধু সে জলের মধ্যে ভাসছে আর ডুবে যাচ্ছে আর চিৎকার করছে আর একটা বিরাট ভারী কম্বল, সেটাকে জড়িয়ে ধরে আছে, আর বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। সাধুটি বললে,তুমি প্রথম তো কম্বলটা ত্যাগ কর;তাহলে দেখবে তুমি এমনিতেই ভেসে যাবে। তখন তুমি পাড়ে চলে আসতে পারবে। আগে তো সেটা ত্যাগ করো। তখন সেই সাধুটা বলছে -----ম্যায় তো কম্বল ছোড়না চাতা হ্যু,লেকিন এ কম্বল মুঝে নেহি ছোড় রাহা হ্যায়। পরে দেখা গেল আসলে ওই কম্বলটি, কম্বল ছিল না; ওটা ছিল একটা ভাল্লুক। গল্পটা এখানেই শেষ।এরপরে কি হলো সেটা জানার চেষ্টাই করবেন না।আর মর্মার্থ হচ্ছে ভাল্লুকের মতো একটা কম্বলকে আমি জড়িয়ে আছি কিন্তু এই কম্বলটা আমাকে ছাড়তে চাইছে না। এই কম্বল হলো আমার অহংকার;এই কম্বল হলো আমার মায়া;আমার বাসনা-কামনা,বড় হওয়ার কতো আকাঙ্ক্ষা। আমরা মুখে বলি আমরা ছাড়তে চাইছি; ছাড়তে চাইছি। আসলে কি আপনি ছাড়তে চাইছেন? আমরা তো স্বগুণ মায়ার লোক না! আমরা নির্গুণ সত্যের কথা আলোচনা করি,উপনিষদের কথা বলি। কিন্তু জ্ঞান দেওয়া কি আমাদের শোভা পায়?আপনি আচরি ধর্ম।আমরা বুঝেও তো বুঝি না! এই যে ঠাকুরের আরতি যে হয়,তাতে আছে খন্ডন করো, বন্ধন করো,বন্ধন বন্দি তোমায়। সেখানে আছে নির্গুণ গুণময়। ঠাকুরকে বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। 'নির্গুণ' আবার 'গুণময়' মানে? মানে হচ্ছে সাধক যিনি তার কাছে তিনি নির্গুণ,তিনি ঈশ্বর,তিনি নির্গুণ ব্রহ্মের সমান। কিন্তু আমারা যারা রক্ত মাংসের গৃহী মানুষ অনেক আমাদের মায়া,অনেক আমাদের মোহজাল। আমরা তাই আমাদের মায়া দিয়ে ইশ্বরকে যখন দেখি তখন ইশ্বরও সগুণ হয়ে যায়। নির্গুণকে ছোয়া যায় না আর ঠাকুরকে মনে করি রক্ত মাংসের একজন মানুষ। তিনি সগুণেরও ইশ্বর আবার নির্গুণেরও ইশ্বর। এবং সেই কারণে তিনি সাধকেরও ইশ্বর আবার আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্যেও তিনি ইশ্বর। পরাশর মহারাজের এই কম্বলের গল্পটা এই সফরের সব থেকে বড় সংগ্রহ বলা যেতে পারে।
অদ্বৈত আশ্রমের অফিস ঘরে আজ এসেছেন প্রদীপ মহারাজ। মাস ছয়েক হলো এসেছেন। এর আগে গুজরাতের বরোদাতে রাজকোটে। তিনি বললেন শিবাজীর এত শক্তিশালী কি করে হয়েছিল জানেন? তার এত বড় তরবারি ছিল, কিন্তু ভারী সেই তরবারি! তার কারণ,সেই সময়ে মুসলিম শাসকরা আক্রমণ করেছিল তখন তা রুখবার জন্য তাকেও শক্তিশালী হতে হয়েছিল। এবং মোঘলদের সাথে থাকতে থাকতে তিনিও অস্ত্রধারী হয়ে উঠেন। তবে কিনা আমরা ভক্তের দল,সাধারণ মানুষ আমাদের অস্ত্র থেকে দূরে থাকা উচিত। কথা হচ্ছিল রাজনীতি নিয়ে। কেন ওনারা রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চান;সেটা হচ্ছে অস্ত্র যার হাতে আছে তার সাথে বেশী বন্ধুত্ব না করাই ভালো। ফলে উনি বলেছিলেন ছোট বেলায় আমরা একটা সংস্কৃত শ্লোক পড়ে ছিলাম --নদীনাং স্রিংগি নদীনাং শৃঙ্গীনাং নখিনাং অস্ত্রধারনং। এই লাইনের মানে হচ্ছে নদীর একদম কাছে অর্থাৎ কুলের কাছে বসো না, বাণ আসতে পারে;ভেসে যেতে পারো। যার শিং আছে সেই জীবের কাছাকাছি থেকো না;শিং দিয়ে গুতো মারতে পারে। যার নখ আছে;আর যাদের হাতে অস্ত্র আছে তাদের কাছ থেকে দূরে থেকো।
কাশীর রামকৃষ্ণ মিশনে প্রথম দুর্গা পুজো শুরু হয়েছিল উনিশো আট সালে। তারপরে কয়েক বছর বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো, অর্থাভাবে করা যায়নি। তারপর আবার উনিশো তেরো সালে শুরু হয় এবং আজও হয়ে চলেছে। তখন থেকেই এখানে দুর্গা পুজোর সময় নিয়মিত কালী কীর্তন হতো। এবং সেটা রাজা মহারাজ শুরু করেছিলেন (স্বামী ব্রহ্মানন্দজী) ,এখনও হয়ে চলেছে। আজও সন্ধ্যায় আরতির পর কীর্তন হলো এবং সচিব কল্যাণ মহারাজ অসাধারণ কীর্তন করলেন। আগমনী সঙ্গীত হলো। এখন প্রতিদিন হবে শুধু। যেদিন সন্ধিপুজো সেইদিন হবেনা। কেননা সেদিন সময়টা পাওয়া যাবে না। আসলে খুব বড় একটা আদর্শ হচ্ছে দেবতাকে বুঝতে গেলে দেবতার সমান হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। দেবতার উচ্চ পথে থেকেই দেবতাকে বোঝা যায়।
চলবে...