দুর্গাপুজো বাঙালির সবথেকে বড় উৎসব। দেশ হোক বা বিদেশ, দুর্গাপুজোর এই সময়টা সব বাঙালির কাছেই খুব বিশেষ। আমরা বাঙালিরা কীভাবে যে এক দেবীকেও ঘরের মেয়ে করে তুলতে পারি সেটাই বরাবর আমাকে আশ্চর্য করেছে। মেয়ে আসছে বাপের বাড়ি। তার সঙ্গে তার পরিবার... কী মিষ্টি না ব্যাপারটা।
যাইহোক, দুর্গাপুজোর আনন্দটা সবার কাছে কমবেশি একরকম হলেও এই সময়টার স্মৃতি কিন্তু এক একদনের কাছে এক এক রকম। প্রত্যেকে এই সময়টা নিজের মতো করে সাজিয়ে তোলে। আমারও বেশ কিছু মনে রাখার মতো স্মৃতি আছে পুজো ঘিরে। ভাবলাম, তার মধ্যে একটা লিখে রাখলে মন্দ হয় না।
পুজোর স্মৃতি হলেও বিষয়টা একদমই পুজো কেন্দ্রীক নয়। আমি এই সময়টা বাড়িতে নিজের মতো করে কাটাই। পরিবারের সঙ্গে এক একবার বেরোই হয়তো রাতের দিকে। তবে ভিড় ব্যাপারটা ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ নয় সেই ছোটো থেকে। তার চেয়ে বরং ঘরের আলো নিভিয়ে বারান্দায় বসে রাস্তায় টুনি বাল্বের ঝিকিমিকি দেখে, বেলুন বিক্রেতাদের হরেক রকম ডাক শুনে, বাচ্চাদের খিলখিল হাসি, প্রেমিক-প্রেমিকাদের হাত ধরে কান ফিসফিস, বন্ধুদের উল্লাস ইত্যাদি প্রভৃতি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেই সময় কাটত আমার। তবে একটা বছর একদম অন্যরকম কেটেছিল।
সালটা ২০০২। বয়স ১০। বাবার সঙ্গে ষষ্ঠীর দিনে বিকেলে বেরিয়েছিলাম একটু। বাবাই জোর করে নিয়ে গেছিল। ওই যে বললাম বেরোতে ভালো লাগত না আমার। তাই বাবার কথায় বাধ্য হয়ে আশপাশের প্যান্ডেল ঘুরে দেখতে বেরিয়েছিলাম। বাড়ি ফেরার পথে একটা ক্যাসেটের দোকানে পুজোর গানের ক্যাসেট ঢুকল বাবা। আমাদের বাড়িতে হিন্দি গান শোনার কোনও চল ছিল না। তবে সেই বছর শাহরুখের দেবদাস রিলিজ হয়েছে। চারদিকে সেই নিয়ে হইহই চলছে। বেশিরভাগটাই সমালোচনা যদিও। সে যাইহোক, ছবির গান কিন্তু সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিল। দুর্গাপুজোর ব্যাকড্রপে ঐশ্বর্য, মাধুরীর সেই 'ডোলা রে ডোলা' যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দেশবাসীর মুখে মুখে। পুজোর প্যান্ডেলেও সেই সব গান।
এমনিতে ওই বয়সে হিন্দি গান শোনার কথা ভাবতেও পারতাম না। তবে কী জানি বাবাকে সেদিন 'দেবদাস'-এর ক্যাসেট কেনার কথা বলে ফেললাম। অন্য সময় বাবা কিনে দিত কিনা জানি না। তবে পুজোর আবহে বাবার মনটাও অন্যরকম ছিল। আর গানগুলো তো সত্যিই ভালো তাই দোনামনা করেও সেদিন সেই ক্যাসেট কিনে দিল বাবা। আর আমি ? আমার মনে হচ্ছিল স্বর্গ বোধহয় একেই বলে। প্রথম কোনও হিন্দি গানের ক্যাসেট আমার হাতে। তাও আবার একান্ত আমার। এখন মনে হয়, সেদিন যেন হিন্দি গান শোনার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন স্বয়ং মা দুর্গা।
দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি এসে পুরো পুজোটা ওয়াকম্যানে হেডফোন লাগিয়ে 'দেবদাস'-এর গান শুনেছিলাম। শুনেছিলাম বলা ভুল। যেন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে সময়টা কেটেছিল আমার। দরজা বন্ধ করে একটু নেচেও নিয়েছিলাম। পুজোয় লেখাপড়ার গল্প ছিল না। তাই দিনরাত কানে চলত, শ্রেয়া ঘোষালের 'ইশশশ...'। এখন ভাবলে হাসি পাই। এসব অনুভূতি আর নেই। আঙুলের ছোঁয়ায় এখন শুনে ফেলা যায় আফ্রিকার কোনও আদিবাসী গ্রামের ঘুমপাড়ানি গান। যেটা পাওয়া যায় না, সেটা হল ওই অনুভূতিটা। যেই অনুভূতি একুশ বছর পরেও আমায় দিয়ে এই লেখা লিখিয়ে নিয়েছে। ২০০২ সালে কেনা একটা ক্যাসেটের কভার ফটোটা মনে করিয়ে রেখেছে। কে জানে, এবছরের পুজোতে আবারও এমন এক অভিজ্ঞতা হবে কি না!