scorecardresearch
 

কী করে বলি, আনন্দে আছি পুজোর দিনগুলিতে?

নীল আকাশ যত দেখি ততই অতীত স্মরণ করিয়ে দেয়। শরতের এমন উন্মুক্ত আকাশ আমাদের পুরনো বাড়ির পাশে যে বিস্তীর্ণ মাঠ ছিল সেখানেই প্রথম দেখেছিলাম। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘেই তো অসুর আর দুগ্গা মায়ের যুদ্ধ দেখেছি ছোটবেলায়।

Advertisement
দেবদাস রজক, প্রাবন্ধিক দেবদাস রজক, প্রাবন্ধিক

পুজোর স্মৃতিকথা লিখতে বসেও যন্ত্রণার কথায় ঘুরে ফিরে আসে। এটাই তো আমার দুর্ভাগ্য। আশ্বিন-ভেজা গন্ধ, প্যান্ডেল, আলোকসজ্জা, ভোর আর কুয়াশায় মহালয়ার সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে বেজে ওঠা “আশ্বিনের শরতপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা” অথবা “জাগো, জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিণী। অভয়া শক্তি, বলপ্রদায়িনী তুমি জাগো, জাগো, তুমি জাগো...” -এই সঙ্গীতটুকু আজও হৃদয় ভারি করে তোলে, চোখ ছলছল করে। কেন জানি না এমন হয় বারবার? শুধু যে যন্ত্রণা থাকে এমন নয়, একটা আনন্দধারা বয়ে নিয়ে যায় দূর দূর অতীতের কাছে। শুভ্র-তুলো-মেঘ আর বেদনা মিলেমিশে থেকে যায় এই উৎসবের ভিতর।

নীল আকাশ যত দেখি ততই অতীত স্মরণ করিয়ে দেয়। শরতের এমন উন্মুক্ত আকাশ আমাদের পুরনো বাড়ির পাশে যে বিস্তীর্ণ মাঠ ছিল সেখানেই প্রথম দেখেছিলাম। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘেই তো অসুর আর দুগ্গা মায়ের যুদ্ধ দেখেছি ছোটবেলায়। সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধে...! দূর বারোয়ারি পুজোমণ্ডপ থেকে ঢাকের আওয়াজ, ঘণ্টাধ্বনি... শঙ্খ ধ্বনির ভেসে আসা, শিহরিত হয়ে উঠতাম।
 
খুব মনে পড়ে পটকা ফাটানোর জন্য একটি খেলনা বন্দুক ছিল আমার। বাবা যথেষ্ট দাম দিয়েই সেটি কিনে এনেছিলেন, যা ফি-বছর মা পুরনো বাক্স থেকে বার করে দিতেন। খেলনা বন্দুকটি আমি চালাতে জানতাম না। তার একটা দুঃখ বয়ে নিয়ে চলতাম পুজোর ক’টা দিন। আমার যত স্মৃতি পুরনো বাড়িটিকে ঘিরে। একান্নবর্তী। পাড়ার আরও মানুষের আনাগোনা লেগে থাকত বাড়িতে। হৈ চৈ। মিস্টি। নাড়ু। মা মাসিদের দেখতাম সন্ধের পর নিমকি আর নাড়ু তৈরি করার ঘটা। আমি ছোট-বয়সে কত বন্ধুকেই না পেয়েছি, দিনভর খেলা... খেলা আর খেলা...! সে অনেক আগের বাল্যদিনের স্মৃতিপট। হয়তো দামি কিছু পোশাক পেতাম না। মাঝারি দামের জুতো, অল্প দামের জামা, সে সব মনে হতো অমৃত, প্রসাদ। পাশের বাড়ির এক বাল্যবন্ধু, সে দামী দামী পোশাক পরত। তার একটি হলদে রঙের প্যান্ট আমাকে তীব্র আকর্ষণ জাগাত। ইচ্ছে করেই আমার সামনে বারবার সেই প্যান্টি-ই পরে আসত, বলত-
“দ্যাখ! আমার কতগুলি পকেট! এক... দুই... তিন... চার...”

Advertisement

সে গুণে শেষ করা যেত না। জাদুকরের প্যান্ট বুঝি। কী অসম্ভব জিনিস যা পকেটে রাখা যায়? ধনদৌলত, অর্থ, কড়ি নাকি নদী... নালা... গাছপালা... আকাশ... বাতাস... কী কী ভরা যেতে পারে ওখানে? আজও এতগুলি পকেট আমার হয়ে উঠল না। বাবা বলতেন-
“একদিন হবে দেখিস আমাদেরও...!”

কিন্তু কবে? যে ক’টি পকেট আছে তাতে জীবনের ভাঁড়ার শূন্য। 
        

বাবা চলে গেলেন মৃত্যুবছরে। পুরনো বাড়ি ভেঙে গ্যাছে অনেক দিন। বিশ্বকর্মা পুজোর পর আর ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়নি‌ পাড়ার ছাদগুলিতে। এখন অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ভিতর গেমিং দৃশ্য। দিন রাত চলে মিসাইল আর হত্যার কাহিনি। পুজোয় আর এবাড়ি ওবাড়ি ছোটাছুটি করতে দেখি না কাউকেও। প্রতিযোগিতার খেলা। এগিয়ে যাচ্ছে সময়, এগিয়ে যাচ্ছে জীবন...! আমার পুরনো বাড়ির মতো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে ঐতিহ্য, দালান, উঠোন আর আমাদের সাদাকালো অথচ অপূর্ব রৌদ্রমাখা দিন। পদে পদে সব না পাওয়ার এক বেদনা ছিল তখন। কিন্তু অতৃপ্তি ছিল না, ছিল নৈকট্য আর বেঁধে বেঁধে থাকা...। বাবার সঙ্গে চলতে চলতে মাঠ-ঘাট-রাস্তা সব পেরিয়ে যেতাম...! সে সব ভেঙে গেছে কবে। ভাঙতে ভাঙতে এখন তো শুধুই অস্তিত্বের লড়াই। বৃহৎ থেকে... ক্ষুদ্র হতে হতে আরও ছোট, আরও ছোট...। ঈশ্বর বিশ্বাস ভেঙে গ্যাছে আজ। খড়ির আলপনার ওপর পা দিয়ে মন্ডপে ঢুকে যাচ্ছি এখন। গুগল মিটে পুজো সেরে পাড়ি দিচ্ছে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, টোকিও। সময় কোথায় আজ কাশফুলের ভিতর দিয়ে আলপথ ধরে হারিয়ে যাওয়ার? শুধু ছেঁড়া ছেঁড়া অতীত দেখে কষ্ট হয়, দেখি পুরনো বাড়ির উঠোনে বাবা নতুন সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর হাত বাড়িয়ে ডাকছেন –
“আয় খোকা আয়! চল পার্কের পিছনে ওই নির্জন খোলামাঠে তোকে শিখিয়ে দিই কী করে চলতে হয়?”

এই তো জীবনের গাড়ি কতদূর চলে এসেছে। কত চড়াই উতরাই পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু চালাতে পারলাম কই এমন সাইকেল? জীবনের ফাঁকে ধুলো জমা হয়, সেই ধুলোর ঢিপি শুধুই উঁচু হতে থাকে। পেরোতে পারি না... পেরোতেই পারি না...!
         
তারপরও একটা ইচ্ছে জেগে ছিল। স্বপ্নের স্মৃতিরা গুছিয়ে নিচ্ছিল ধীরে ধীরে। হোক সে আর্টিফিশিয়াল, হোক সে থিম-সর্বস্ব জাঁকজমক যান্ত্রিক-সৌন্দর্য। তবুও তো একটা আনন্দপ্রবাহ বয়তে শুরু করেছিল। বাঙালির পুজো, বাঙালির আবেগ, কোথাও না কোথাও একটা মাটির গন্ধ লেগেছিল। কিন্তু থমকে গেলাম সেখানেও। কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ প্রকোপে গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গেল, কোটি কোটি মানুষের সলিল সমাধি দেখল এই পৃথিবী। রাশিয়া... আমেরিকা... চিন... ভারতের মতো দেশেও কত প্রিয়জনের দুর্বিষহ মৃত্যু ঘটে গেল। এর প্রভাব পড়ল আমাদের ঘরে ঘরে। হাহাকার আর যন্ত্রণা। মহামারীর ক্ষত দাগ এখনও বইতে হচ্ছে। জীবনের ভাগ্যরেখা পরিবর্তন হল, ভার্চুয়াল এক ছায়ার পৃথিবী তৈরি হল। বহু কোম্পানির উচ্ছেদ দেখলাম। অর্থনীতি আমেরিকার মতো দেশেও তলানিতে এসে ঠেকেছে...! এদেশেই বহু যুবক যুবতী বেকার হয়ে দিন গুণছে জীবনের। আকাশে শুধু কি অশনি সংকেত আজ? এ ঘা সেরে উঠতে সময় লাগবে কয়েক দশক। আমি কী করে বলি আনন্দে আছি পুজোর দিনগুলিতে? কী করে বলি-
                     
“যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মূলিনী
যা ধূম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী।...”

Advertisement

সারা বিশ্বজুড়ে আকাশে বাতাসে শুধুই মৃত্যুর গন্ধ পাই। এই তো কিছুদিন আগেও তুরস্কোর লিবিয়াতে প্রকৃতির ভয়াবহ দানবনৃত্য দেখলাম। তীব্র ভূমিকম্পে প্রায় ষাট হাজার মানুষের মৃত্যু। সম্প্রতি আফগানিস্তানেও হাজার হাজার প্রাণ গেল ওই ভূমিকম্পেই। সিকিস- কালিম্পঙে হড়পা বানে ভেসে গেল বহু মানুষ! তারপরও বলব, শিউলির সুবাস আর ধূনচির গন্ধে মন উদাস হয়?
                    
না, হয় না। পৃথিবীতে এখন কাল-অসুখ। পুঞ্জ মেঘের বদলে দাবানল দেখি। আকাশে আকাশে বারুদের ধ্বংসবার্তা। পৃথিবীর অসম্ভব হৃদয়রোগ সেরে ওঠার আগেই কালো-ধোঁয়ার মতো আগুনের ফুলকি দেহে গেঁথে দিল বুলেট। দীর্ঘ দেড় বছর ধরে রাশিয়া, ইউক্রেনের যুদ্ধ। এখনও থামেনি। নিভৃতে প্রহর গুনছে সারা বিশ্ব। বারুদের কালো দাগ। মৃত্যু, রক্ত, ষড়যন্ত্র, কুটনীতি আমাদের ধরণীর বুকে ক্ষতচিহ্ন রেখে দিচ্ছে। এযেন এক আমূল পরিবর্তনের সময়। আবার অতিসম্প্রতি আরও এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধের খবরে স্তম্ভিত হতে হচ্ছে পৃথিবীকে। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে জেরুজালেম আর গাজা’র অধিকারকে কেন্দ্র শুরু হল প্যালেস্টাইন আর ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধের দামামা। ধীরে ধীরে এ যুদ্ধ ভয়াবহ রক্তক্ষয়ের আকার নিচ্ছে আর ক্রমশ সমগ্র পৃথিবী নীল থেকে নীলতর হয়ে উঠছে। হামাস বাহিনী, কোথাও তালিবান জঙ্গিগোষ্ঠী সীমান্ত শাসন করছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, গোটা ইউরোপ মহাদেশ ইসরাইলের পক্ষ নিয়েই যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগামবার্তা দিতে চলেছে। আকাশে এখন কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে। নীলকন্ঠ নয় এযেন শকুনের মৃত্যুধ্বনি।

ভয়াবহ সংকেত। এ কোন বিশ্বকে আমরা আগামীতে দেখতে চাইছি? শরতের আকাশে চারিদিকে এখন অশুভ অসুরের আঁতাত। শুধু ধ্বংস ধ্বংস ধ্বংস আর রক্তের কালো-স্পট আমাদের ঘাস আর ফুলের ওপর ছড়িয়ে পড়ছে। চন্দ্রযানে চেপে প্রজ্ঞা পাড়ি দিয়েছে সুদূরে চাঁদের দেশে। কতদূর যেতে পারব আমরা? কতদূর আমাদের মানবতার ধারাকে বয়ে নিয়ে যেতে পারব? মহাবিশ্বের কাছে এই মানব সভ্যতার ইতিকথা হয়তো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি রেখে যাবে কোটি কোটি আলোকবর্ষ পরেও। তখন আমার দেশ, আমার সেই পুরনো বাড়ি, আমার বাল্যবেলার পুজো-মন্ডপ, ঘ্রাণ, বাবার কিনে দেওয়া খেলনা বন্দুক, শরতের আশাবরী রাগ হয়তো ব্রহ্মান্ডের অজানা কোনও গ্যালক্সিতে নিভৃতে বিরাজ করবে। সেদিনও শরতের আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘে অসুর ও দুগ্গা-মায়ের যুদ্ধ দেখবে আমার-ই মতো কেউ একজন বালক, আর দূর থেকে ভেসে আসবে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে সেই মায়াবী সঙ্গীত –

                       আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক-মঞ্জীর;
                      ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;
                      প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।
                      আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে 
                      রূপলোক ও রসলোকে আনে নব ভাবমাধুরীর সঞ্জীবন।
                      তাই আনন্দিতা শ্যামলীমাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃণ্ময়ীতে আবাহন।
                      আজ চিৎ-শক্তিরূপিনী বিশ্বজননীর শারদ-স্মৃতিমণ্ডিতা 
                      প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।

Advertisement