একটা ছোট্ট বেড়ার ঘর। দুটো সুপুরি গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় সদ্য বিধবা হওয়া বছর তিরিশের এক মহিলা সেলাই মেশিন চালাচ্ছেন। মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দ। সালোয়ার কামিজের ওপর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে সেলাই সূচ। হ্যারিকেনের আলোতে মিশছে শেষ বিকেলের সূর্য। মেশিনের সেই ঘড়ঘড় শব্দের সঙ্গে মিশে রয়েছে একটা ছেলের চিৎকার করে মুখস্ত করা ভূগোল বই। কালপুরুষ, বৃহস্পতির কক্ষপথ, আমাজনের কালো জল, জলঙ্গির কাদামাটি। ছেলেটার মন নেই পড়াশুনোয় একটুও। ভূগোলের ফাঁকে উঁকি মারছেন মহীষাসুর। জানলার তারগুলো বর্ষার জলে খসে পড়ছে, ক্লাস ফোরের ছেলেটা সেই জানলা ভেদ করে দূরে দেখতে পাচ্ছে পাশের বাড়ির পাতকুয়োর উপর ফিঙে পাখিদুটো ল্যাজ নেড়ে বলছে 'কীরে, পুজো তো চলে এল। আর কত পড়বি? তোর বন্ধুরা সব ক্যাপ বন্দুক কিনে ফেলেছে।' ফটাশ ফটাশ শব্দ হচ্ছে গলিরাস্তার মোড়টায়।
আমরা যারা গত দশকের খড়কুটো আঁকড়ে ধরেই কাটিয়ে দিলাম, মানে ইংরেজিতে যাদের নাইন্টিজ বলে, তাদের কাছে পুজো মানে এগুলোই। আমার এক বন্ধু বলে, মানুষের জীবন খানিকটা এই শরত্কালে উঠোনে বিছিয়ে থাকা শিউলির মত। সে গন্ধ বিলোয়, শরত-হেমন্তকে দায়িত্ব নিয়ে মিলিয়ে দেয়, তবু তার ঝড়ে পড়াতেই জন্ম জন্মান্তরের মুগ্ধতা। গোটা পাড়াজুড়ে একটু রাতের দিকে কিংবা ভোরবেলা বেরোলেই গন্ধ মম করছে, নিয়ম করে কতগুলো বাচ্চা মেয়ে শিউলি কুড়িয়ে কচুপাতায় মুড়ে নিত। সেই কচুপাতার গায়ে জমা জল ভিজিয়ে দিত সেই কটকটি-চেপটি-ফুলঝুড়িদের জামা।
ষষ্ঠী এলেই, বিকেলের আলো শেষে সামনের মস্ত হাউজিং পেরিয়ে দেখা যায় হলদে বাল্ব। তখনও ফ্ল্যাটবাড়ি কাকে বলে জানতাম না। ফ্ল্যাট মানে সরকারি আবাসন, এটুকুই জ্ঞান এই বাংলা মিডিয়ামদের। আমাদের মফস্বলে তখনও কিছুকিছু জায়গায় চাষবাস হয়। বাঁশবাগান থেকে রাত বাড়লে শেয়ালের ডাক শোনা ছিল রোজকার বিষয়। তেমন একটা জায়গায় দাড়িয়ে আমাদের বাড়ি লাগোয়া মস্ত সব হাউজিং। মা বলে জ্যোতিবাবু নাকি সেই আবাসনের উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। সেখানকার মানুষের পোশাক -আশাকে বেশ মার্জিত একটা ব্যাপার। বাগান করবার শখ। মুদি দোকান থেকে সসের বদলে কেচআপ। বেশিরভাগই সরকারি চাকুরে। ওদের দেখে ভিষণ রকমের হিংসে হোত। টিপ্পনি কেটে বলতাম তোমরা তো জেলখানায় থাকো। আমাদের মত বাড়ি আছে নাকি তোমাদের?
আজকের ইএমআই জীবনে এসব ভাবনা কল্পনাতীত, যেখানে হোম লোনের গণ্ডি পেরিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনে বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার করাটাই একপ্রকার জীবনের সেলিব্রেশন।
সে যাই হোক। আমাদের ভাঙাচোরা দরমা বেড়ার ঘরের জানলা দিয়ে পঞ্চমী থেকেই দেখা পাওয়া যেত সেই হাউজিং এর পুজোর আলো। পড়ার ফাঁকে সে আলো দেখে নিয়েছি বহুবার। অন্যান্য পুজো প্যান্ডেলগুলো যখন সোনু - সানু - শান ছাড়া কিছুই বাজাচ্ছে না মাইকে তখন এই হাউজিংয়ের পুজোয় প্রথমবারের জন্য শুনলাম 'বয়স বারো কী তেরো রিক্সা চালাচ্ছে, আকাশে ঘুড়ির ঝাক ছেলেটাকে ডাকছে।' নচিকেতা গাইলেন নীলাঞ্জনা, শিলাজিত্ বলল 'তোদের ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা'। আমরাই সেই প্রজন্মের শরিক যাদের চোখের সামনে অরকেস্ট্রা শব্দটাই বদলে যেতে শুরু করল। বাঙালির পুজোর স্টেজে সেই প্রথম কিশোর কুমার ফ্লপ। চুল ঝাঁকড়া ছেলের দল গীটার হাতে জানিয়ে দিচ্ছে 'প্রিথিবীটা কিন্তু ছোট হচ্ছে, সে স্যাটেলাইট আর বোকাবাক্সের হাতে ক্রমস বন্দি হয়ে যাচ্ছে'। কেউ বলল ব্যান! কেউ বলল ব্যান্ড। জীবনমুখি গানের এক নয়া শব্দে মেতে ইলু-বিলু কিংবা নিতাইরা হারমোনিয়াম ছেড়ে গিটার ধরল, দশমির রাতে মাইকে বাজল জতুগৃহের অরজুন সিং, ভূমির বারান্দায় রোদ্দুর, চন্দ্রবিন্দুর এমনও বসন্ত দিনে বাড়ি ফেরো মাংস কিনে!
অষ্টমীর সকালে ঘটি বাড়িতে যখন লুচি-ছোলারডাল হচ্ছে, আমদের বরিশাল ফেরত বাড়ি থেকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে আজ আমাদের খাসির ঝোল। এভাবে পাড়ায় পাড়ায় চাইনিজ খাবারের কদর হয়নি তখনও। চাইনিজ মানে তখনও চাউমিন অনলি! তাতে বেশি করে সস আর শশা পেঁয়াজ দিয়ে পনেরো টাকায় ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর! তখনও উত্তর কলকাতায় ঠাকুর দেখতে গিয়ে মামলেট খাওয়া যেত। রীতিমত ডিমের ঝুড়ি নিয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির রাস্তাটায় কারা যেন বসত। সাদা কাগজে লাল আলতায় লেখা থাকত "ডিমের মামলেট, ডিম সেদ্ধ, ডিমপাউরুটি' সেসব ডিমের মামলেটে লঙ্কা কুচি চিবিয়ে জল চেয়ে খেতে হয়েছে আশুতোষের মিষ্টি দোকান থেকে। দশটাকা দিয়ে জলের বোতল কেনার কথা জাস্ট ভাবা যেত না।
বুড়িমার দু বান্ডিল ক্যাপ শেষ হয়ে যেত পরদিন সকালেই। পরদিন ফের আসত পুজো পাব্বনীর টাকায়। বুড়িমার ক্যাপের গায়ে সিংহের ছবি দেওয়া সেসব ক্যাপ আমাদের ঘুনসী জড়ানো হাফপ্যান্টের 'পকেট মে রকেট' যাকে বলে। সারাদিন ধরে ফটর ফটর শব্দে যখন পাড়ার লোক অতিষ্ট, তখন পাড়ার রাগী কারতিক কুন্ডু বলতেন, 'আমাগো পাড়ার হগল ছ্যামরারা একগুইঠা হইয়া বোমাবাজি ফুটাইত্যাছে!'
এই আমাদের ছেলেবেলা। এই আমাদের পড়ে পাওয়া নব্বই দশকের হলদে সবুজ দুগ্গা পুজো।
সেই বর্ষার জলে ক্ষয়ে যাওয়া জানলার শিক থেকে দেখতে পাওয়া হলদে আলোগুলি, সেই সুমনের গান আমায় তাড়া করে ফেরে বহুদিন। নেই সেই জানলাটা, পেল্লাই ইট-কাঠ- পাথরে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। নেই বাঁশের গায়ে জড়ানো লাল-নীল সব সুতো। আবাসনের সেই পুজোর হলদে আলো আজকাল আর দেখতে পাওয়া যায়না। ইয়াব্বড় পাঁচিল তৈরি হয়েছে সীমানা বরাবর।ফিঙে পাখি দেখিনি কতদিন। শিউলি ফোটেনি বাবাইদাদের বাড়িতে। আমরা বড় হয়ে গেছি, এখন মামলেটকে অমলেট বলি!