মাইকে ভাইয়ের ঘোষণা, 'আমার দাদা ঠাকুরের অস্ত্র চুরি করেছে'

আমি তখন নবম শ্রেণি, আমি তখন শাড়ি নয়তো পাঞ্জাবি। সবে সবে শিখছি হাতে হাতে চিঠি পৌঁছে কীভাবে লজেন্স আদায় হয়। কীভাবে প্যান্ডেলের এক কোণ থেকে আরেক কোণে চোখের ত্যারচা চাউনি দিয়ে পাড়ার দাবার কিস্তিমাত হয়ে যায় বীরপুরুষটির।

Advertisement
মাইকে ভাইয়ের ঘোষণা, 'আমার দাদা ঠাকুরের অস্ত্র চুরি করেছে'দুর্গাপুজো

এই যে ঢাকের মাথায় কাশফুল গুঁজে যে বাবাটি শিয়ালদা কিংবা হাওড়া স্টেশনের বাইরে, তার কোমরে ঘুন্,সি হাফপ্যান্টে তাপ্পি, লিকলিকে ছেলেটিকে হাতে কাঁসর ধরিয়ে বলছে, জোরসে বাজা! তার কাঁসরের আওয়াজ পুজো কমিটির হোতাদের কান ছাপিয়ে কৈলাশে মা দুর্গার কানে পৌঁছবেই কত্তা। তবেই তিনি আসেন। ঝরে পড়া শিউলি সকালের মন কেমন গন্ধে মিশে থাকে সেই রোগা লিকলিকে ছেলেটির ক্যাপ-বন্দুক কামনা। তার খোকাবাবু লালজুতো বাসনা। যেমন থাকে আমাদের সমস্ত নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্তদের। আমাদের সমস্ত বেকারদের মায়ের কাছে চেয়ে নেওয়া উৎসবের দিনের এগরোল চাউমিনের হাতখরচ। তারপর বাকি সমস্ত বছর আমরা সেই মাকে আর সময় দিয়ে উঠতে পারি না। সেমেস্টার আর এক্সেল শিটের চাপে। মায়ের অধিকার সংরক্ষণে তখন গালভরা মাদার্স ডে থেকে ‘নারী শক্তি বন্দন অধিনিয়ম’ অব্দি, নানা বজ্র আঁটুনির ফস্কা গেরো।
 
আমি তখন নবম শ্রেণি, আমি তখন শাড়ি নয়তো পাঞ্জাবি। সবে সবে শিখছি হাতে হাতে চিঠি পৌঁছে কীভাবে লজেন্স আদায় হয়। কীভাবে প্যান্ডেলের এক কোণ থেকে আরেক কোণে চোখের ত্যারচা চাউনি দিয়ে পাড়ার দাবার কিস্তিমাত হয়ে যায় বীরপুরুষটির। আমাদের তখনও সেসব নিয়ে অতোটা আগ্রহ নেই। তখন সবে ফাইনাল এক্সামে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপের রচনায় লিখে এসেছি ‘দূরকে করিলে নিকট বন্ধু’। আর তারপরেই নতুন হাতে পাওয়া মাইক টেস্টিং হ্যালো হ্যালো। সমস্ত পাড়াবাসি পরকে নিকট করে জানাচ্ছি সবাই শীঘ্র পুজোমণ্ডপে আসুন, এক্ষুনি বোধন শুরু হবে। পুজোর শুরুর সেই দিন থেকেই আমরা ছোটরা মনে মনে ঠিক করে নিতাম, এবার মা দুর্গার চক্রটা আমি নেবোই। তারপর ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমীর হ্যাংলামি আর যাবতীয় বায়না পুষিয়ে দশমীর সকাল থেকেই একদম পুজোমণ্ডপে আমাদের কচি ব্রিগেডের ধর্না সমাবেশ। সারাদিন ধরে নানা প্ল্যানিং এবং ভাগ বাটোয়ারা। কিন্তু আমাদের সেসব প্ল্যান প্রোগ্রামের ওপরেও আছে ওপরমহলের ইচ্ছে। তাঁদের নতুন আসা বাড়ির লোকের আধুরি খোওয়াইশ- ‘এবার কিন্তু মায়ের চক্রটা আমায় এনে দেবে, ঠাকুরের সিংহাসনে রাখবো’। ফলে আমরা যতই চক্রপাণি সাজার প্ল্যান করি না কেন, আমাদের প্ল্যানের প্ল্যানচেট করে দেবেই সেইসব কানুনের থেকেও লম্বা হাতের মালিক ভুতুড়ে দাদারা। 

Advertisement

তা একবার হল কী, প্যান্ডেলের বাঁশের মাচার পিছন দিয়ে কোনও ভাবে ঠাকুরের সেই চক্রটা ঝেড়েছি। কিন্তু ঘটনাটা ওরকমই এক দাদার চোখে পড়ে গেছে এবং ফলস্বরূপ বাওয়াল। তারপর সেই ভুতুড়ে দাদাটি কী করল! সে আমার ছোট ভাইটির হাতে মাইক তুলে দিল। ভাইও ক্যাপ বন্দুকে কাশ্মীর বর্ডার খেলে ক্লান্ত। এখন মাইক হাতে অমায়িক নেতা হওয়ার সুযোগ ছাড়বে কেন! সেই দাদার শেখানো বুলি বলতে হল ভাইকে। মাইকে অ্যানাউন্স হল পাড়া জুড়ে ‘আমার দাদা ঠাকুরের অস্ত্র চুরি করেছে’। সেইদিন বুঝতে পেরেছিলাম দিওয়ার সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের হাতে লেখা ‘মেরা বাপ চোর হ্যায়’ আসলে কোথায় খোদাই হয়ে গেছিল। সে-ই সম্ভবত শেষ। তারপর আর ঠাকুরের অস্ত্র চুরি করিনি, আর সেভাবে প্যান্ডেলেও যাইনি। পুজো এলেই এই ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। সঙ্গে মনে পড়ে যায় নিষ্ফল আক্রোশে সেদিন অকারণে ভাইকে মেরেছিলাম। পুজো বিষয়টা তারপর থেকে নানাভাবে ধরা দিয়েছে আমার কাছে। পাড়ার পুরনো বামপন্থী কাকুটাকেও বিসর্জনের দিন বলতে শুনেছি ‘দ্যাখ কেমন কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে মায়ের মুখটা’। কিন্তু দেওয়াল লিখনে সদ্য শেখা বস্তুবাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের সূচনা সেদিন থেকেই হয়ে গেছিল আমার, যেদিন পুজো প্যান্ডেলে ভাইকে দিয়ে বড় দাদাটি আমাকে বলিয়ে নিয়েছিল চোর।

Disclaimer: এই প্রতিবেদনটি লেখকের নিজস্ব মত। bangla.aajtak.in এই লেখাটির দায় নিচ্ছে না। 

POST A COMMENT
Advertisement