'বেনারসের ডায়েরি' পর্ব ৩: চোখ ধাঁধানো ,লোক দেখানো পুজোর ভোগবাদী ছটফটানি নেই, এটাই রামকৃষ্ণ মিশনের মজা

আজ মহা ষষ্ঠী। ষষ্ঠীর দিন কাশীর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে ভোরবেলা সাড়ে তিনটের সময় উঠেছি। রামকৃষ্ণ আশ্রমের মুগ্ধ পরিবেশ। গাছ-গাছালি,তখন আকাশ অন্ধকার। মা দুর্গার ফল কাটা  শুরু হয়ে গেছে।

Advertisement
'বেনারসের ডায়েরি' পর্ব ৩: চোখ ধাঁধানো ,লোক দেখানো পুজোর ভোগবাদী ছটফটানি নেই, এটাই রামকৃষ্ণ মিশনের মজাবেনারসের ডায়েরি

বেনারসের ডায়েরি: তৃতীয় কিস্তি

পঞ্চমী ডায়েরি

আজ পঞ্চমী। মহাশক্তি মা দুর্গা স্কন্দমাতা রূপে আজ পঞ্চমীতে আবির্ভূতা --- দেবরাজ্যের সেনাবাহিনীর যিনি প্রধান শক্তি, স্কন্দ বা কার্তিক, সেই শক্তিমানের মাতা । সৃষ্টির আদিশক্তি। দেহ ও মনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সাধক নিজ অস্তিত্বের গভীর চেতনায় চলে যান .....       দেহবোধ বিলীন,  মনের চিন্তা-আবেগ নিস্তরঙ্গ। বুঝতে পারছেন, দেহ ও মন যেন দুই ঢাকনা যা অন্তর-চেতনাকে ঢেকে রেখেছিল এতকাল। এই স্তরে সাধক নিজেকে অনুভব করেন 'চেতন' শক্তিরূপে ‐-‐----------    আজ তিনি চিরশুদ্ধ-ব্রহ্মময় ।

ষষ্ঠীর ডায়েরি

আজ মহা ষষ্ঠী। ষষ্ঠীর দিন কাশীর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে ভোরবেলা সাড়ে তিনটের সময় উঠেছি। রামকৃষ্ণ আশ্রমের মুগ্ধ পরিবেশ। গাছ-গাছালি,তখন আকাশ অন্ধকার। মা দুর্গার ফল কাটা শুরু হয়ে গেছে। পারমিতা স্নান করে গেল দুর্গাপুজোর ফল কাটতে। পারমিতা খুব খুশি কারণ আশ্রমের সেক্রেটারি কল্যাণ মহারাজ পারমিতাকে ফল কাটার দায়িত্ব দিয়েছেন। বেশ কয়েকজন মহিলা মিলে ভোর সাড়ে চারটে থেকে ফল কাটা শুরু করবে। সাড়ে পাঁচটা থেকে পুজো শুরু হবে। ভোর পাঁচটায় হল অসম্ভব সুন্দর  ঠাকুরের আরতি। 

আমি এখন যাচ্ছি মঙ্গল আরতিতে যোগ দিতে, বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ আছে। এখনও আকাশের রং কালো। গাছেরা যেন এখনও ঘুমোচ্ছে। গোশালার পাশ দিয়ে যাচ্ছি। গরুরাও বোধহয় ঘুমোচ্ছে। কেননা দিনের বেলা খুব হাম্বা হাম্বা ডাক শুনতে শুনতে যাই। এটা অতিথিশালা থেকে মন্দির যাওয়ার পথ। বাঁধানো রাস্তা,স্ট্রিট লাইট জ্বলছে,কোন  অসুবিধা হচ্ছে না। এটাই রামকৃষ্ণ মিশনের এখানকার মজা। কোন বাহুল্য নেই, আতিশয্য নেই। চোখ ধাঁধানো ,লোক দেখানো পুজোর ভোগবাদী ছটফটানি নেই। নিজের মতো করে পুজো করে; দেখো,ঘট কী করে প্রতিষ্ঠা হয় দেখ,কীভাবে কুমারী পুজো হয় দেখো,কী ভাবে সন্ধিপুজো হয়। পুজো কাছ থেকে দেখাটাও খুব আনন্দের বিষয়। 

রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপুজো
রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপুজো

পুজোর যে প্রক্রিয়া সেই প্রক্রিয়াগুলি দেখা এবং জানা। অর্থাৎ পুরোহিত দর্পণ না পড়ে, প্র্যাকটিকাল ক্লাস। কালকে সন্ধ্যাবেলায় আরতির সময় "খণ্ডন-ভব-বন্ধন-জগ" শুনে নরেন্দ্রপুরের কথা মনে পড়েছিল। নরেন্দ্রপুরেও তো ঠিক এই ভাবেই প্রতি সকাল-সন্ধ্যা দলবদ্ধ হয়ে প্রার্থনা কক্ষে গাইতাম। স্বামী বিবেকানন্দের লেখা এই সঙ্গীত তার অসাধারণ সব কথা। যখন আরতি শুনছিলাম তখন হাতে গানটির পর্যালোচনা পুস্তক সর্বোজ্ঞানন্দের রচিত বইটি নিয়ে গান গাইছিলাম। হঠাৎ একটা শব্দ শুরুতে আছে ঠাকুর সম্পর্কে স্বামীজি লিখেছেন তিনি নির্গুণ গুনময়। তিনি নির্গুণ আবার গুণময় হয় কী করে? নির্গুণ তাই তিনি অখণ্ড ব্রহ্ম। তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম। আমাদের মায়া দিয়ে দেখি তাই তিনি সগুণ তখন তার মনে দেখতে পাই। 

Advertisement

হাঁটতে হাঁটতে হাসপাতালের কাছে এসে গেলাম। এই হাসপাতালের মুখটায় একটা অসাধারণ নটরাজের মূর্তি আছে। জানতে হবে এই নটরাজের মূর্তি কবে কীভাবে  প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। মহা ষষ্ঠীর সকালে স্বামী রঙ্গনাথানন্দজির একটা বই পড়ছি। বইটি পড়তে পড়তে একটা চিত্তাকর্ষক বিষয় আমাকে নাড়া দিল। সেটা হল, Sigmund  Freud সম্পর্কে বলা হয়, যে তিনি সব কিছুকে মানুষের 'Libido'   অর্থাৎ 'কাম' দিয়ে  ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কাম আছে এবং সেই কাম সৃষ্টির সুখের উৎস। শিল্পী যখন ছবি আঁকে তখনও সে কামের প্রকাশ ঘটে অন্যভাবে। Freud বলেছিলেন মনের তিনটি ভাগ আছে---সচেতন; অবচেতন এবং নির্জ্ঞান। Conscious, unconscious, Abstract mind। নির্জ্ঞান মন যেন জানতে পারি না,আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকে। এমনকী নির্জ্ঞান মনেও কিন্তু কামনা বাসনা (Libido) থাকে।

কিন্তু স্বামী রঙ্গনাথানন্দজি বলছেন, এই যে Freud র ডিক্স সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ, সেখানে যেন মনে হয় উনি সমস্ত কিছু কেই কাম দিয়েই বিশ্লেষণ করেছেন। অর্থাৎ স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী বলছেন,কাম মানুষের আছে,এটা যেমন সত্য। This is called  Biological Truth.কিন্ত Freud কখনও এই জৈব সত্যের জয়ধ্বনি দিয়েছেন সেটা কিন্তু অপব্যাখ্যা। আমাদের তো হিংসা আছে, লোভ আছে,কাম আছে মানুষের তো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু Sex Determinism অভিযোগ দেওয়া হয় Freud সম্বন্ধে। যেমন কার্ল মার্কস সম্পর্কে Economic Determinism অভিযোগ তোলা হয়। অর্থাৎ সব কিছুকেই তিনি Sex দিয়ে দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু রঙ্গনাথানন্দজি লিখছেন, উনি কিন্তু কখনও জয়ধ্বনি দেননি অর্থাৎ এটাই কাম্য, এটাই Desirable এমনটা কিন্তু কোথাও বলেননি। অর্থাৎ এটা Biological Truth কিন্তু আমরা কিন্তু অনেক Biological Truth কে সংস্কৃতি দিয়ে; আমাদের  মূল্যবোধ দিয়ে,আমাদের Ethics বা Morality দিয়ে উচিত অনুচিত দিয়ে সেটাকে উর্ত্তীণ হওয়ার চেষ্টা করি। সেটা না করে সেই যৌনতার মধ্যেই কামনা বাসনার মধ্যেই সিঁধিয়ে যাওয়া। সেটা থেকে আর উপরে উঠতে না পারা। সেটা কিন্তু আমাদের অক্ষমতা এবং সেটা কিন্তু Freud অপব্যাখ্যা। এভাবে কখনো ভাবিনি। স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী আমার যেন চোখ খুলে দিলেন এই রচনায়। অর্থাৎ জৈব সত্য। কিন্তু জৈব সত্য থেকে আরও বড় সত্যর দিকে অগ্রসর হতে হবে বা পৌঁছতে হবে। সেটাই হবে মানব সত্য।

চলবে...

POST A COMMENT
Advertisement