scorecardresearch
 

ত্রিনয়না, মহামায়া থেকে মমতাময়ী ঘরের কন্যা মা দুর্গা

বৃষ্টি ভেজা বজ্রঘন আকাশ, সঙ্কটের ঝিরি কৃষ্ণমেঘ কাটিয়ে কাশবনের মিহি হাওয়ায় শরতের পূর্বাভাসে হৃদয় হিল্লোলিত হয়ে বাঙালির মনে প্রাণে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। উমা আসছেন মেনকার দুয়ারে। বাঁধ ভেঙে আসে আনন্দজোয়ার। নীল আকাশে পুজ্ঞ সাদা মেঘ, শিউলির গন্ধ, আলপনা, খালি পায়ে দুব্বা ঘাস মাড়িয়ে ঢাকে কাঠি পড়ে, শরতের বাতাসে ধ্বনিত হলো –

Advertisement
দেবদাস রজক দেবদাস রজক
হাইলাইটস
  • ত্রিনয়না, মহামায়া, কত্যায়নী, দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার প্রাদুর্ভাব এই ধরাধামে
  • প্রায় পাঁচশ বছর পূর্ব থেকে এই মহামায়া পূজিত হয়ে আসছেন বাংলাদেশের ভূমিতে
  • মহামায়ার আদি রূপের সৃষ্টির রহস্য সন্ধানে যেতে হয় মহাভারতের কাছে

বৃষ্টি ভেজা বজ্রঘন আকাশ, সঙ্কটের ঝিরি কৃষ্ণমেঘ কাটিয়ে কাশবনের মিহি হাওয়ায় শরতের পূর্বাভাসে হৃদয় হিল্লোলিত হয়ে বাঙালির মনে প্রাণে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। উমা আসছেন মেনকার দুয়ারে। বাঁধ ভেঙে আসে আনন্দজোয়ার। নীল আকাশে পুজ্ঞ সাদা মেঘ, শিউলির গন্ধ, আলপনা, খালি পায়ে দুব্বা ঘাস মাড়িয়ে ঢাকে কাঠি পড়ে, শরতের বাতাসে ধ্বনিত হলো –

“যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥

যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥“

--ত্রিনয়না, মহামায়া, কত্যায়নী, দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার প্রাদুর্ভাব এই ধরাধামে। ইতিহাস বলছে প্রায় পাঁচশ বছর পূর্ব থেকে এই মহামায়া পূজিত হয়ে আসছেন বাংলাদেশের ভূমিতে। মধ্যযুগের একাদশ-দ্বাদশ শতকেও কালীপুজোর সঙ্গে দুর্গাপুজোও হতে দেখা গেছেছিল। তবে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুর-মালদার জমিদার স্বপ্নাদেশে প্রথম পারিবারিক দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল। সেখানে অবশ্য মহামায়ার রূপ ছিল ভিন্ন, লোকমতে দেবীর রূপ ছিল গোলাকার চক্ষু যা প্রকট ও উজ্জ্বল এবং সাদা বাঘ আর সবুজ সিংহের ওপরে দেবীর অধিষ্ঠান। এরপর নদীয়ার তাহেরপুরের রাজা কংশনারায়ন অথবা মতান্তরে নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার ( ষোড়শ শতকে মুকুন্দ চক্রবর্তীর অভয়ামঙ্গল কাব্যে এর পরিচয় পায়) বাংলাদেশে প্রথম শারদীয়া বা শরৎ দুর্গাপুজো সংগঠিত করেন। এছাড়া আনুমানিক ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ কলকাতার ( বরিশার) সুবর্ণ রায়চৌধুরী সপরিবার কলকাতায় দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। তবে ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে জয়লাভের পর রাজা নবকৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর মাধ্যমে বিজয় উৎসব পালন করেছিলেন। সেই সময় থেকেই ব্রিটিশ বাংলায় এই পুজো ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে স্বাধীন ভারতে থিম পুজোর প্রেক্ষিতে দেখতে শুরু হয় মহামায়াকে।

Advertisement

এতো গেল দুর্গাপুজোর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, তবে মহামায়ার আদি রূপের সৃষ্টির রহস্য সন্ধানে প্রবেশ করতেই হয় মহাভারতের যুগে। দেবী দুর্গার সৃষ্টির রহস্য বাঙালিকে চিরকাল মোহময় ও আকৃষ্ট করে তুলেছে। কিংবদন্তি আছে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বেদসংকলন, মহাভারত, পুরাণ, ব্রহ্মসূত্র রচনা করেছিলেন (মতান্তর রয়েছে)। ঋগ্বেদে দুর্গার পূর্ণরূপের কোনো পরিচয় পাওয়া না গেলেও ঋগ্বেদে ‘দেবীসূক্ত’কে দেবী দুর্গার সূক্ত বলেই মনে করা হয়েছে। দেবী দুর্গা নির্গুণ অবস্থায় এই জগৎ সংসারে বিরাজমান। সেখানে দেবীর জন্ম নেই আবির্ভাব আছে, একে বলা হয় ‘প্রাকত্ব'। এখানে এই দেবী সমস্ত দেবতাদের ত্বেজপুজ্ঞের সমষ্টি স্বরূপ। এখানে ‘দুর্গা' শক্তিদেবী রূপে বর্ণিত আছেন। তিনি ‘সপ্তশতী'-তে রূপান্তরিত অর্থাৎ এই মহাশক্তি ব্রহ্মার ব্রহ্মত্ব, শিবের শিবত্ব,

বিষ্ণুর বিষ্ণুত্ব ইত্যাদি শক্তির সমষ্টি হলেন এই দেবী। ‘দুর্গা’ নামের মধ্যেই নিহীত ‘দুর্গা’ নামের মাহাত্ম্য। দুর্ (সং)+ গম(ধাতু)= দুর্গা। যে দেবী ‘দুর্গম' নামক অসুরকে বধ করেছিলেন তিনিই দুর্গা। ‘শব্দকল্পদ্রুম’ গ্রন্থে বলা হয়েছে--

“দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা

দুর্গা বা প্রকীর্তিতা”

অর্থাৎ যিনি দুর্গ বা দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেন তিনিই সর্বদা দুর্গা নামে পরিচিত হবেন। ‘পূজা বিজ্ঞান’ গ্রন্থে স্বামী প্রমেয়ানন্দ ‘দুর্গা' শব্দটি এই ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—

“দৈত্যনাশার্থবদনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ

উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো দেবসম্মত।“

‘দ' শব্দটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, ‘গ’ শব্দটি পাপ নাশ করে এবং আ-কার শত্রু নাশ করে। অর্থাৎ দৈত্য-বিঘ্ন-রোগ-পাপ-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই হলেন ‘দুর্গা’।

প্রাচীন ভারতীয় সাধনায় স্ত্রীদেবতার যে প্রভাব ছিল তার স্বীকার করতেই হয়। অবৈদিক যুগেও স্ত্রীদেবতা, নারীশক্তির প্রভাব ছিল। ‘বেদসংকলন’-এ অম্ভৃণ ঋষি কন্যা বাক, রাত্রিসূক্ত, ভূবনেশ্বরী দেবী, কেনোপনিষদে উমা-হৈমবতীর কথা, সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্রে ভদ্রকালী, হিরণ্যকেশী গৃহ্যসুত্রে ভবানী দেবী, শুক্ল যজুর্বেদে বাজসনেয়ী সংহিতায় অম্বিকা(রুদ্রের ভগ্নি) ইত্যাদি নারী দেবতার নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে প্রথম ‘তৈত্তিরীয় আরণ্যকে’ (উপনিষদ) ‘দুর্গা' নামের সন্ধান পাওয়া গেছে। এখানেই প্রথম রুদ্রর পত্নি রূপে দুর্গাকে দেখা হয়—

“তামগ্রিবর্ণাং তপসা জুলন্তীং বৈরোচনীং”

--আবার 'তৈত্তিরীয়ে’র অন্তর্গত যাজ্ঞিকা উপনিষদে দুর্গাগায়ত্রী মন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়—

“কাত্যায়নায় বিদ্মহে, কন্যাকুমারীং

ধীমহি তন্নো দুর্গিঃ প্রচোদয়াৎ”

--বস্তুত হিন্দু শ্রাস্ত্রে যে ‘দশমহাবিদ্যা'র কথা জানা যায় ( কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা) তারই সমন্বয় রূপ হলো ‘দুর্গা'। এই দশমহাবিদ্যার সঙ্গে আবার বৌদ্ধধর্মের পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের শক্তি পাঁচ দেবী, ( লোচনা, যামকী, পান্ডারা, আর্যতারা ও বজ্রাধাত্বেশ্বরী) তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষনীয়। অন্যদিকে বৌদ্ধদের দেবী ‘মারীচি' দুর্গার মতোই দশভুজা। গৌতমবুদ্ধ ‘মহাবস্তু'তে যে অভায়াদেবীর পদবন্দনা করেছিলেন, কেউ কেউ মনে করেন তিনিই দুর্গা বা চন্ডীকা। জাপানে ‘সপ্তকোটি বুদ্ধমাতৃকা চনষ্টী দেবী’ নামে যে দেবী পূজিত হন, তিনি অনেকটাই দেবী চন্ডীর মতো, বোঝা যায় জাপানি ‘চনষ্টী' এবং সংস্কৃত চন্ডী একার্থবাচী। চিনের ক্যান্টন শহরে বৌদ্ধ মন্দিরে শতভুজা দেবীমূর্তির রূপ পাওয়া যায়। আবার জৈনগণের দেবী সরস্বতীকে শুধু কলাবিদ্যার দেবী বলেই শ্রদ্ধা করেন না, তাঁকে বিশ্বরূপিনী ও সর্বশক্তিময়ী বলেও শ্রদ্ধা করেন সেখানেও

আমাদের ‘মহামায়া’র অস্তিত্বের চিহ্ন পাওয়া যায়। বাংলাদেশে দেবী চন্ডী বা দুর্গা ‘অভয়া’ (মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘অভয়ামঙ্গল') নামেও পরিচিত।

মহাভারতে ‘দেবীদুর্গা’, ‘বিন্ধ্যবাসিনী’, ‘মহিষাসুর বিনাশিনী’ নামগুলির উল্লেখ দেখেছি, এছাড়া দুর্গার বিকল্প নামেরও উল্লেখ আমরা দেখি- কুমারী, কালী, কাপালী, মহাকালী, চন্ডী, কান্তারবাসিনী ইত্যাদি, তবে শাক্ত ধর্মাবলম্বীদের কাছে আদরনীয় আনুমানিক তৃতীয়-চতুর্থ শতকে রচিত ‘মার্কন্ডেয় পুরাণে’ই ( কৃষ্ণদ্বৈপায়ন রচিত, মতান্তর আছে) প্রথম দেবী দুর্গার বিস্তারিত পরিচয় আমরা পাই। সেখানে ৮১ থেকে ৯৩ মোট ১৩টি অধ্যায়ে দেবী চন্ডীর সবিশেষ পরিচয় পেয়ে থাকি। এখানে সাতশ শ্লোকে দেবী মাহাত্ম্যের কথা উল্লেখ রয়েছে। ‘শ্রীশ্রীচন্ডী’ অংশটির মধ্যে বিধৃত আছে দেবী কর্তৃক মহিষাসুর, শুম্ভনিশুম্ভ, চন্ডমুন্ড, রক্তবীজ, মধুবৈটভ, দুর্গামাসুর প্রভৃতি অসুরের বিনাশ বর্ণনা এবং দেবী মহামায়ার মহাশক্তির মাহাত্ম্য। এরপর ষষ্ঠ শতাব্দীতে নাগার্জুনী গুহার এক শিলালিপি- ‘মহিষাসুর মস্তকে পদদ্বয় স্থাপনকারিনী’-তে দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় ( বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, দ্বিতীয় খণ্ড, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়)। এছাড়া বারাহীতন্ত্র, স্কন্দপুরাণ, দেবীপুরাণ, দেবীভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, কালিকাপুরাণ, বামনপুরাণ, বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ, হরিবংশ পুরাণ, বৃহদ্ধম পুরাণ ইত্যাদি পুরাণে দেবী দুর্গার মাহাত্ম্যোর কথা বর্ণিত আছে।

Advertisement

‘স্কন্দপুরাণে’বলা হয়েছে- “তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমখ্য মহাসুরম” অর্থাৎ রুরুদৈত্যের পুত্র দুর্গাসুরকে বধ করার উদ্দেশ্যেই দেবীর আবির্ভাব। এখনে তিনি দুর্গতিনাশিনী হয়েছেন। যিনি বাধা-বিপত্তি, রোগ-শোক, পাপ-ভয়, শত্রু-বিপদ থেকে রক্ষা করেন তিনিই ‘দুর্গা'।

‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে’র ‘প্রকৃতি' ( দেবী) খন্ডে প্রকৃতির সক্রিয় প্রভাবে ব্রহ্মান্ডের বিকাশ এবং পরমাত্মা কৃষ্ণের ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে দুর্গা তথা লক্ষ্মী, সরস্বতী, সাবিত্রীর আবির্ভাব ইত্যাদির বর্ণনা আছে। এখানে আমরা দেখি দুর্গাপুজোর প্রথম প্রবর্তক কৃষ্ণ, তারপর স্বয়ং ব্রহ্মা এবং তৃতীয়বার দুর্গার আরাধনা করেন মহাদেব।

‘দেবী ভাগবত’ পুরাণে আমরা দেখলাম ব্রহ্মার মানস পুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করে বর লাভে সাফল্য হন।

বৃহদ্ধর্ম পুরাণ এবং কালিকা পুরাণে রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে মা দুর্গাকে পুজো করার কথা উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্র মতে দেবতারা যেহেতু শরৎকালে ঘুমিয়ে থাকেন, সেহেতু শরৎকালে দেবতাদের পুজো যথাযথ নয়, তাই এই দুই পুরাণে শারদীয়া দুর্গাপুজোকে ‘অকালবোধন’ বলা হয়েছে। দুই পুরাণে আছে রাম-রাবণের যুদ্ধে রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পুজো করার পরামর্শ দেন স্বয়ং রামচন্দ্রকে।

প্রতাপশালী রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত করতে শরৎকালেই শ্রীরামচন্দ্র কালিদহ সাগর থেকে ১০৮টি নীলপদ্ম সংগ্রহ করে দুর্গাপুজো সম্পন্ন করে কৃপা লাভ করেন। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন মূল বাল্মীকি রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক দেবী দুর্গার পুজো বর্ণনার ঘটনাটির উল্লেখ নেই। তবে প্রাকচৈতন্যযুগে পঞ্চদশ শতাব্দীর বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর ‘রামায়ণ পাঁচালী' গ্রন্থে রামচন্দ্র কর্তৃক ‘অকালবোধন’-এর কথা বর্ণনা করেছেন।

ডঃ সুকুমার সেন তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থের প্রথম খন্ডে বলেছেন-

“কেহ কেহ ঋগবেদের দশম মন্ডলের অরণ্যানী দেবীকে বাংলা চন্ডীমঙ্গলের উৎস বলিতে চাহেন। ঐ মন্ডলের ১৪৬ সূক্তে দেবীকে “মৃগাণাং মাতরম্” বলা হইয়াছে। ব্যাধের দেবী চন্ডীর সঙ্গে পশু-জননী বৈদিক অরণ্যানী দেবীর ভাব-ভাষাগত সাদৃশ্য আছে।“

--অরণ্যানী, চন্ডী, দুর্গা যাই বলা হোক না কেন আসলে সব রূপের একই রূপ ‘মহামায়া’, সেই তিনিই সতী, পার্বতী, মেনকার উমা, বাঙালির ঘরের মেয়ে, একদিকে তাঁর অসুরবিনাশিনী রূপ অন্যদিকে মমতাময়ী মা, গিরিরাজ-মেনকার ঘর আলো করে উমার আলতা পায়ে আগমনী হয় সপ্তমীর সকালে, আর নবমীর নিশিতে কৈলাসপতির আগমনে দশমীতে বিষাদের সুর বাঙালির হৃদয়-মনকে ব্যথিত করে, আবার অপেক্ষা একটা গোটা বছর, তাইতো শাক্তকবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য গাইতে পারেন-

ওরে নরমী নিশী, না হইও রে অবসান

শুনেছি দারুন তুমি, না রাখ সতের মান”

( বিজয়া পর্যায়)

স্বামী বিবেকানন্দ ‘দুর্গা'কে কন্যা বা ‘কুমারী” রূপেই দেখেছেন, এটা নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাগ্রত হওয়ার প্রতীক। শ্রী শ্রী পরমহংস রামকৃষ্ণদেব দেখলেন মানবতার এক বিরাট মূর্তি রূপে—

“মা সবারই মা

কাউকে ছেড়ে দিয়ে নয়

কাউকে বাদ দিয়ে নয়...”

--এই ‘মা’ই হলেন জগদ্ধাত্রী, বাসন্তীদেবী, চন্ডী, কালী, গৌরী, উমা। বাঙালির মনে প্রানে অনুভূতির আরাধ্যা দেবী। ‘লোকসাহিত্য' গ্রন্থের ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—

Advertisement

“বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তর বেদনা আছে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো... এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালীর হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।“

--তাই এই ‘মহামায়া’ একদিকে যেমন রুদ্রমূর্তি সংহারিনী রূপ অপরদিকে মাতা, কন্যার মরম যন্ত্রনার প্রতিমূর্তি, এই দুয়ের অভূতপূর্ব সমন্বয় শরতের নীল পুঞ্জমেঘের আকাশকে মোহময় করে তোলে... মায়াবী করে তোলে।

(মতামত লেখকের একান্তই নিজের, আজতক বাংলা এর দায়ভার নেবে না)

Advertisement