
বেনারসের ডায়েরি চতুর্থ কিস্তি
সপ্তমীর ডায়েরি
আজ মহা সপ্তমী। ভোর সাড়ে তিনটেয় ঘুম ভাঙল। তখনও রাতের আকাশ বিদায় নেয়নি। একটু পরেই ভোরের আল ফুটতে লাগল। বারাণসী ভারতের পূর্বাঞ্চলে। তাই সূর্যদেব দিল্লির থেকে তাড়াতাড়ি উদয় হন। কোথাও একটা মোরগ ডেকে উঠল এবং বারবার সে বলতে লাগল ওঠো,সকাল হয়ে গেছে। স্নান সেরে নুতন পাঞ্জাবী পায়জামা পরে এখন আমি হাঁটতে হাঁটতে চলেছি ভক্তের আলয় থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরে। সেখানে ভোর পাঁচটায় মঙ্গল আরতি। তারপর শুরু হবে মা দুর্গার পুজো। মেয়েরা ফল কাঁটতে শুরু করেছে। পারমিতা আমার আগেই স্নান সেরে ফল কাটার প্রমীলা বাহিনীর কর্মযজ্ঞে সামিল হয়েছে। সকাল সাড়ে আটটায় পুষ্পাঞ্জলী। আসলে রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোয় যেন দুর্গা পুজোটাকে দেখতে পারছি। কলকাতা বা দিল্লির পুজোয় উৎসব থাকে পুজো দেখতে পাই না। যেমন এখানে মন্দিরের সামনে একটা বেলগাছ ছিল। সেই বেলগাছে মায়ের আমন্ত্রণ এবং বোধনের পালা শুরু হত। তারপরে বাইরে সব সরঞ্জাম নিয়ে গিয়ে বোধনের পুজো করতে গিয়ে একবার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় একটু অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছিল বলে,এখন অদ্বৈত আশ্রমের ভিতর যেখানে হনুমানজির মন্দির,সেই মন্দিরে মায়ের আহ্বান ও বোধন হয়। বেলগাছের একটা বড় ডাল কেটে ওখানে স্থাপন করা হয়। আসলে বেলগাছ রামকৃষ্ণ মিশনে খুব তাত্পর্যপূর্ণ। এক প্রবীণ সাধুর মুখ থেকে শুনছিলাম, মা সারদার মাতা একটা বেলগাছের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং সেই বেলগাছের একটা পাতা তার শরীরে এসে পড়ে। এবং তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস সেই বেলপাতা সেই বেলগাছ থেকে মা সারদা তাঁর শরীরে জন্ম নেন। মানুষের বিশ্বাস বেলপাতার মধ্যে কোথাও একটা Spirituality এবং পুজোর ভাব লুকিয়ে রয়েছে। যেমন কলাগাছ, দুদিকে থাকে মাকে বরণ করে নিয়ে যাবার জন্য এবং মা এসেছে। নানা রকম প্যান্ডেল হতে পারে কিন্তু কলাগাছ দুটো না থাকলে মা কী করে প্রবেশ করবেন?
রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের দুটি দিক। একটা অদ্বৈতবাদ আরেকটা হচ্ছে সেবাশ্রম। Home of Service। সেবাশ্রম হচ্ছে হাসপাতাল। সেখানে রোগী বলা হয় না, বলা হয় নারায়ণ সেবক। অদ্বৈত আশ্রমে হনুমানজির মন্দিরাঞ্চলেও একতলায় লাটু মহারাজ স্থাপন করেছিলেন। লাটু মহারাজ কিন্তু এখানে অনেকদিন ছিলেন। সেই গল্প না হয় আরেকদিন করব। আজ সপ্তমী সকলের ভাল কাটুক। কাল অষ্টমী। কাল এখানে কুমারী পুজো হবে।
মঙ্গল আরতি শেষ হয়ে গেল। মঙ্গল আরতির প্রসাদে ছিল মাখন আর মিষ্টি। খুব সামান্য নিলাম, ঠাকুরের পরমামৃত নিলাম। মন্দির প্রদক্ষিণ করলাম। তারপর এখন আমাদের আশ্রমের গেটের বাইরে আছে নন্দলাল গুপ্তাজি,তাঁর একটা চায়ের দোকান। বহু বছর ধরে নন্দলালের বাবা ছিল। নন্দলাল রামকৃষ্ণ মিশনের খুব ঘনিষ্ঠ। এখন নন্দলালের বিনা চিনির স্পেশাল চা খেতে চললাম।
কাশী শহরের ঘুম ভাঙে অনেক আগে। একটা ঘুম ভাঙ্গানীয়া সকাল। কাশী আমাকে কেন টানে জানি না। হয়তো পিতৃপুরুষেরা এখানে ছিলেন; এটাই হয়তো আমার শিকড়। আমার বাবার জন্ম এলাহাবাদে। ঠাকুরদাদা সব এই শহরেই ছিলেন। এখনও আমার পিতৃব্য অর্থাৎ বাবার খুড়তুতো ভাই এখানেই থাকেন। এই ব্যক্তিগত প্রেক্ষিত ছাড়াও আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে এই আশ্রমে আমার ঠাকুরদা শেষ জীবনটা কাটিয়েছিলেন বৃদ্ধাশ্রমে। তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশন তো এখন আর গৃহী মানুষকে সন্ন্যাস দেয় না। তিনি পুরী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী হয়েছিলেন হরিদ্বারে গিয়ে একটা বিশেষ গুরুর কাছ থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। তারপর এখানে এসে বাকি জীবনটা কাটিয়ে ছিলেন। ঠাকুরদাদাকে দেখতে আসতাম মাঝেমাঝে। আর যে ঘরটাতে বৃদ্ধাশ্রমের একতলায় দু নম্বর ঘরে; সেখানে তিনি দেহ রেখেছেন,আমি একবার এসে সেই ঘরটাতে ছিলাম। এখানে এলে মনে হয় দিল্লিতে আর ফিরেই যাব না,এখানেই থেকে যাই। এ এক অসাধারণ নির্জনবাস। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে আমাকে রাস্তার মানুষ চিনতে পারে না এবং চিত্তরঞ্জন পার্কের বাজারে গেলে এভাবে মোবাইলে কথাও বলা যায় না। প্রতি মুহূর্তে মানুষ বিরক্ত করে। এখানে সে সমস্ত কিছু নেই। এখানে আমি একেবারেই যাকে বলে 'নিরীহ প্রজা'। উলুখাগড়া। এটার একটা অসম্ভব মজা আছে। নিজের সঙ্গে নিজে কাটানো যায়।
স্বামীজির একটা খুব সুন্দর কথা পড়লাম। তিনি বলেছেন জ্ঞান ধনের থেকে অনেক বেশি উত্তম। অনেক শ্রেয়,তার কারণ ধন সম্পত্তি তোমাকে রক্ষা করতে হয়। আর জ্ঞান তোমাকে রক্ষা করে। অসম্ভব সুন্দর কথা এইটি। আরেকটা কথা হচ্ছে --সত্য কো হাজার তারিকা সে বাতা যাসাক্ তে হ্যায় ফিরভী হরেক সত্যই হোগা। অর্থাৎ সত্যকে নানান রকমভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। অনেক Interpretation হয়। আসলে সত্য কিন্তু এক।
নবপত্রিকা আসলে কী? দুর্গাপুজোয় কেন কলাবউকে স্নান করানো হয়?
দুর্গাপুজোয় সপ্তমীর অনুষ্ঠান শুরু হয় নবপত্রিকা বা কলাবউকে স্নান করানোর মাধ্যমে। পুজোর দিনগুলোয় নবপত্রিকাকে দেখা যায় কাপড় দিয়ে ঢাকা অবস্থায় গণেশের পাশে থাকতে। সপ্তমী থেকে দশমী, এই চার দিন তাঁরও পুজো হয়। নবপত্রিকার বিসর্জনেও আলাদা নিয়ম রয়েছে। কিন্তু, কী এই নবপত্রিকা? নবপত্রিকা শব্দের অর্থ নয়টি গাছের পাতা। তবে, দুর্গাপুজোর নবপত্রিকাতে থাকে নয়টি উদ্ভিদ। সেগুলো হল কদলী বা কলা, কচু, হরিদ্রা বা হলুদ, জয়ন্তী, বিল্ব বা বেল, দাড়িম্ব বা ডালিম, অশোক, মানকচু ও ধান। যাকে একসঙ্গে সংস্কৃতে বলা হয়, ‘রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ। অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।’
অনেকে নবপত্রিকাকে মনে করেন গণেশের স্ত্রী। কিন্তু, তা একেবারেই নয়। হিন্দু লোকাচারে স্ত্রী থাকেন স্বামীর বাঁ দিকে। কিন্তু, নবপত্রিকা থাকে গণেশের ডান দিকে। দেবীপুরাণে কিন্তু নবদুর্গার কথা থাকলেও নবপত্রিকার কোনও উল্লেখ নেই। মার্কণ্ডেয় পুরাণেও নেই। কালিকাপুরাণে আবার সপ্তমীতিথিতে পত্রিকা পূজার কথা থাকলেও নবপত্রিকার উল্লেখ নেই। তবে, কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্রের নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ আছে। তাই গবেষকরা মনে করেন, নবপত্রিকার পুজো আসলে শস্যদেবীর পুজো। যেখানে শস্যকেই বধূরূপে দেবীর প্রতীক হিসেবে পুজো করা হয়। আর, সেই থেকেই এসেছে কলাবউ স্নানের প্রথা।
কাছেপিঠে কোথাও নামাজ পড়া হচ্ছে। নামাজের সুরও ভেসে আসছে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে। এখানে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাধারণ জীবনযাত্রায় কোন সংঘাত দেখি না;কোন ভেদ দেখি না। ভেদাভেদ সৃষ্টি করে রাজনীতি।
রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের অতিথিশালার নাম 'ভক্ত নিবাস'। ভক্ত নিবাসের প্রধান ফটকের মুখেই একটা বড় শিউলি ফুলের গাছ। সবসময়ই আসতে যেতে পাচ্ছি শিউলি ফুলের গন্ধ। শিউলি ফুলের গন্ধ তো ভুলেই গেছিলাম। আমাদের শহুরে জীবনে শিউলি ফুল আর কোথায়? বিভূতিভূষণ বন্ধ্যোপাধ্যয়ের রচনায় বিশেষত সম্প্রতি বিভূতিভূষণ বন্ধ্যোপাধ্যয়ের স্মৃতিকথা,তার আত্মজীবনী মূলক একটা বই পড়লাম সেখানে তার গ্রাম জীবনে শিউলি ফুলের যে বর্ণনা! সেটা অনবদ্য। সেটাই মনে পড়ে যায়। এখন ভক্ত নিবাস থেকে হাঁটতে হাঁটতে শিউলি ফুলের গন্ধ নিয়ে যাচ্ছি ভোজন কক্ষে। সকাল সাতটার ঘন্টা।এখন চা এবং প্রাতরাশ।বৃদ্ধাবাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। এই বৃদ্ধাবাসে আমার ঠাকুরদা ছিলেন। বৃদ্ধাবাসের নাম 'গোধূলি'।
কুমারী পুজো
কাশীর রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপুজো কিন্তু সুপ্রাচীন। এই দুর্গাপুজোতেও কিন্তু কুমারী পুজো হয়। উনিশো তেরো সাল থেকে আবার নিয়মিত দুর্গা পুজো শুরু হয় এবং আজও সেটা চলে এসেছে। কাশীর দুর্গাপুজোর একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দুর্গা পুজোর প্রত্যেক সন্ধ্যায় কালী কীর্তন। এই আশ্রমের সচিব অসাধারণ তার গায়কী এবং তিনি প্রতিদিন কালী কীর্তন শোনান সপার্ষদ। কুমারী পূজা মানে অনেক প্রস্তুতি। বাঙালী টোলা থেকে এবার একটি মেয়ে আসছে। সেই বালিকাকে কীভাবে নির্বাচন করা হয়,সে এক লম্বা প্রক্রিয়া। তবে কাশীর কুমারী পুজোর গল্প করার আগে আমাদের বেলুড় মঠের কুমারী পুজো ও মাতৃবন্দনার যে ইতিহাস তা খুব দ্রুত খুব সংক্ষেপে জেনে নেওয়া ভাল। বেলুড় মঠের দুর্গাপূজার অন্যতম আকর্ষণই হচ্ছে কুমারী পুজো। স্বামীজি একাধিক কুমারীকে পূজা করেছিলেন। বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজা। এ বিষয়ে একটা সুন্দর বিবরণও পাওয়া যায়। স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে 'মা' ,শ্রীশ্রী মা তেরোশো আট সালে উপস্থিত ছিলেন। সেটাই ছিল মঠের প্রথম দুর্গাপূজা। মায়ের অনুমতি নিয়েই সব ব্যবস্থা হয়েছিল। খুব সুরম্য মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছিল,খুব সুন্দর প্রতিমা স্থাপন হয়েছিল। মায়ের উপস্থিতিতে সবাই খুব উৎসাহ পেয়েছিল। আর মায়ের নির্দেশে দেবীপূজায় পশুবলী বন্ধ ছিল। অর্থাৎ বেলুড় মঠের দূর্গাপূজায় কোন পশুবলীর পরম্পরা নেই। স্বামীজির অনুরোধে গৌড়ীমা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিষ্যা কুমারী পূজার আয়োজন করে ছিলেন।পাদ্মঅর্ঘ্য ;শঙ্খ গলয় বস্ত্রাদি সহযোগে স্বামীজি স্বয়ং নয়জন অল্প বয়স্কা কুমারীর পূজা করেন। এই সকল জীবন্ত প্রতিমার চরণে অঞ্জলি এবং তাদের হাতে মিষ্টান্ন দক্ষিণাদি প্রদান করে স্বামীজি তাদের ভুমিষ্ট হয়ে প্রণাম করেন। একজন কুমারী এতই অল্প বয়স্কা ছিলেন এবং পূজা কালে এতই ভাবাবিষ্ট হয়ে ছিলেন যে তার কপালে রক্ত চন্দন পড়াইবার সময় স্বামীজি শিহরিত হয়ে বলেছিলেন --আহা দেবীর তৃতীয় নয়নে আঘাত লাগে নি তো? "সারদা রামকৃষ্ণ" সন্ন্যাসিনী দূর্গাপুরী লিখিত এই বইটিতে রয়েছে। এই বইটিতে আরও বলা হয়েছে মাও ওই কুমারীদের এয়ো রাণী পূজা করেন। আজকাল বেলুড় মঠে মহাষ্টমী পুজোর দিন পাঁচ থেকে সাত বছরের একটা কুমারীকে দেবী জ্ঞানে পূজা করা হয় এবং সালাঙ্কারা বেনারসী শাড়ী পরিহিতা জলজ্যান্ত কুমারীকে সাক্ষাত মাদুর্গার পূজা করে সকলের মধ্যে মাতৃভাবের সঞ্চার করা হয়েছিল। সেই পূজা দেখতে খুব ভীড়ও হয়েছিল। স্বামীজির কুমারী পূজার কিছু আশ্চর্য কাহিনি বলার আগে এই কুমারী পূজার তত্ত্বগত দিকটি আলোচনা করছি। দুর্গাপুজোর সঙ্গে কুমারী পুজোর বিধান সম্ভবত তান্ত্রিক মতে। দেবী দুর্গা স্বয়ং সম্পূর্ণা,পরমানন্দ স্বরূপিনী;তিনি কারও গর্ভজাত নন। অসুর নিধনের জন্যে দেবগণের পুঞ্জীভূত তেজ থেকেই তার জন্ম। তাই তিনি স্বয়ং সিদ্ধা। "গৃহদ্ধর্ম" পুরাণের মতে দেবী চণ্ডিকা এবং কুমারী কন্যা রূপে দেবতাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কন্যারূপেন দেবনাম ব্রত দর্শনং দদৈ। আবার তন্ত্র মতে সকল কুমারীই দেবীর প্রতীক। তন্ত্র সারে পাই,কুমারী যোগিনী সাক্ষাৎ কুমারী পর দেবতা। মহাষ্টমীতে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হলে,মহানবমীতে কুমারী পূজার বিধান তন্ত্রসারেও আছে। কুমারী পূজা খুব ফলদায়ী এবং তন্ত্রসারে বলা হয়েছে যে কুমারী পূজা ছাড়া সম্পূর্ণ ফলদায়ী হয় না। কুমারী পুষ্প দ্বারা পূজিত হলে তার ফল পর্বতসম। যিনি কুমারীকে ভোজন করান তার দ্বারা ত্রিলোকের তৃপ্তি সাধিত হয়। কুমারী সম্বন্ধে এসব প্রশস্তি থেকে বোঝা যায় কুমারী দেবী ভগবতীর এক স্বাত্বিক রূপ। অর্থাৎ সাধককে শুদ্ধ মনে সাধককে দেখা দেয়। কিভাবে একটা কুমারীকে বাছা হয় তন্ত্রসারে বলা আছে এক থেকে ষোলো বছর বালিকাদের নির্বাচিত করা হয়। অবশ্যই তাদের ৠতুবতী হওয়া চলবে না। আর একেক বছর কুমারীদের একেক রকম নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। একেবারে বছরের কন্যাকে বলা হয় সন্ধ্যা, দুই বছরে সরস্বতী;তিনি বছরে ত্রিধা মূর্তি;চার বছরে কালিকা;পাঁচ বছরে সুভগা; ছয় বছরে উমা;সাত বছরে মালিনী;আট বছরে কুব্জিকা;নয় বছরে কাল সুন্ধরভা; দশ বছরে অপরাজিতা; এগারো বছরে রুদ্রানী; বারো বছরে ভৈরবী;তেরো বছরে মহালক্ষী;চোদ্দ বছরে পিঠনায়িকা। পনেরো বছরে শ্বেত্রগা ;ষোল বছরে কুমারীর নাম অম্বিকা।এই সমস্ত তথ্য স্বামী দেবেন্দ্রানন্দের "বেলুড় মঠের কুমারী পূজা" শীর্ষক পুস্তিকা থেকে আমি আহরণ করছি।
স্বামীজির কুমারী পুজা করার ব্যাপারে অনেক আশ্চর্য কাহিনি জানা যায়। তার মানস কন্যা নিবেদিতা এবং আরও কয়েক জনকে নিয়ে কাশ্মীর ভ্রমণ কালে তিনি একজন মুসলমান মাঝির শিশুকন্যাকে কুমারী পুজো করেন। যা দেখে নিবেদিতা সহ অন্যান্য পাশ্চাত্য শিষ্যা রাও বিস্মিত হন। পরিব্রাজক অবস্থায় আরও কিছু শিশুকন্যাকে কুমারী পূজা করার কথা জানানো যায়। এর মধ্যে খুবই আশ্চর্যজনক বিষয় উত্তর প্রদেশের গাজীপুর বিখ্যাত রায় বাহাদুর গগনচন্দ্র রায়;(উনি রবীন্দ্রনাথের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন।) শিশু কন্যা মণিকা রায়কে কুমারী রূপে পুজো করেন।
এই তথ্যটি পাওয়ার সূত্র হল, দেশ প্রত্রিকার উনিশো নব্বইয়ের বাইশে সেপ্টেম্বর। এই লেখকের বেলুড় মঠে ' দুর্গা পূজা' শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার পর বহুজন কৌতুহলী হয়ে এই পুজো নিয়ে লেখক ও দেশ প্রত্রিকায় চিঠি লেখেন। লেখক হলেন স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ। সেই সময়ে নিউদিল্লি থেকে সুবল গাঙ্গুলী একটা চিঠিতে আশ্চর্য তথ্য প্রকাশ করেন। এবং চিঠিতে দেশ প্রত্রিকার উনিশো নব্বইয়ের দশই নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তার একটি অংশ হলো --দেশ বাইশে সেপ্টেম্বর সংখ্যায় নব্বই বছর আগে বেলুড় মঠের দুর্গাপূজা শুরু হওয়ার ইতিহাস সম্বন্ধে স্বামী দেবেন্দ্রানন্দজীর সুলিখিত প্রবন্ধ থেকে বহু তথ্য জানা গেল। বেলুড় মঠে স্থাপনের বহু আগে থেকেই স্বামীজি দুর্গাপূজা ও কুমারী পুজো নিয়ে আগ্রহ ছিল। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের তিরোধানের পর অপরিচিত পরিব্রাজক হিসেবে যখন নরেন্দ্রনাথ উত্তর ভারত ভ্রমণরত তখন গাজীপুরে (বেনারসের কাছে) বিখ্যাত রায় বাহাদুর গগনচন্দ্র রায়ের বালিকা কন্যা মণিকা রায়কে কুমারী পুজা করেন বলে লিখিত আছে। পরবর্তীকালে এই মণিকা রায় লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম Vice Chancellor (1923) ডঃ জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর স্ত্রী মণিকা চক্রবর্তী হিসেবে পরিচিতা হন। দিলীপ কুমার রায় তার ইংরেজি "যোগীকৃষ্ণ প্রেম" উনিশো আটষট্টি এই গ্রন্থে লিখেছেন যে এই মহিলা প্রকাশ্য পার্টিতে মদ এবং সিগারেট খেতেন। তার আধ্যাত্মিক জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কেউ জানতেন না। দিলীপকুমার রায়ের গ্রন্থে লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর অধ্যাপক ডোনল্ড নিক্সন মণিকা দেবীর আসল পরিচয় পান। উনিশো আটাশ সালে তার কাছে দীক্ষা নিয়ে যোগী কৃষ্ণপ্রেম হিসেবে সর্বভারতে পরিচিত হন। সেই ব্রিটিশ যুগেও Vice Chancellor স্ত্রী মণিকা দেবী স্বামী-পুত্র সংসার সব ত্যাগ করে বৃন্দাবনে দীক্ষা নিয়ে যশোদা মা হিসেবে পরিচিতা হন। আলমোড়া থেকে আঠারো মাইল দূরে দূর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে আশ্রম স্থাপন করে জীবনের শেষদিন গুলি কাটান। তার মানসপুত্র কৃষ্ণপ্রেম উনিশো পঁয়ষট্টি ওই আশ্রমে যশোদা মায়ের সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজায় নিযুক্ত হন। কিছুদিন আগে আলমোড়া গিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিপূত বিশাল গৃহ বিখ্যাত বিজ্ঞানী ----??-------সেনের গৃহ,যেখানে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি আছে আলমোড়ায় থাকাকালীন উদয়শঙ্কর উপহার দিয়েছিলেন সেই সব গ্রন্থ দেখতে গিয়ে ছিলেন স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ।স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতি ধন্য সেই সব গৃহ,সংরক্ষিত রাস্তা,সেই প্রস্তর যার উপর খুদিত অপরিচিত নরেন্দ্রনাথ অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। সেই সব দেখার পর সুদূর আশ্রমে গেছিলেন দেবেন্দ্রানন্দ। যশোদা মাতা খুবই কৃতিত্বের সাথে চালাচ্ছেন।
যশোদা মায়ের অতীত জীবন নিয়ে বেশি খবর রাখেন না। ওই স্থানে বসবাসকারী এক আইরিশ নাগরিক বর্তমানে ভারতের নাগরিক আমার কাছে সর্বপ্রথম শুনলেন যশোদা মায়ের জীবনের ইতিহাস। অত্যাধুনিক মণিকা চক্রবর্তী 'যশোদা মা' হিসেবে পরিবর্তনের পিছনে নিশ্চয়ই ছিল বাল্যকালে অপরিচিত পরিব্রাজক বিবেকানন্দের গাজীপুরের কুমারী পূজা। সাক্ষাৎ শিব ছিলেন স্বামীজি। তাঁর স্পর্শে ,তাঁর দৃষ্টিপাত কত যুগান্তকারী ঘটনা এ দেশে-বিদেশে ঘটে গেছে তা এখনও অজানা। যাইহোক,স্বামীজি চার-পাঁচ বার কুমারী পুজো করেন ১৮৮৯ সালের অক্টোবর মাসে ক্ষীরভবানীতে তিনি কুমারী পুজো করেছিলেন। ক্ষীরভবানী কাশ্মীরের একটা প্রাচীন দেবীপীঠ। এখানে একটা কুম্ভ আছে। এবং সেই কুম্ভের জলেই দেবীর কাল্পনিক পূজা করা হয়,নিবেদন করা হয় ক্ষীর বা পায়েস। যদিও বিবেকানন্দের কাশ্মীর ভ্রমণে সহযাত্রী মানসকন্যা নিবেদিতা এবং মিস্ -----??---- আর ছিলেন দুই গুরু ভাই। এই সময় প্রায়ই একাকী থাকতেন এবং ক্ষীরভবানীতে পূজো করতেন এবং পায়েসও নিবেদন করতেন। সেই সঙ্গে প্রতিবারই এক ব্রাহ্মণ শিশু কন্যাকে কুমারী জ্ঞানে পূজা করতেন। ভারতের অন্যতম শক্তিপীঠ কামাখ্যাতে গিয়েও স্বামীজি কুমারী পূজা করার কথা জানানো যায় সেখানকার পান্ডাদের পুরনো খাতা থেকে। সেখানকার প্রথা অনুযায়ী তিনি কুমারী পুজো এবং কুমারী ভোজন করান। পরিব্রাজক হিসেবে গাজীপুরের শিশু মণিকাকে কুমারী পূজার কথা আগেই বলা হয়েছে। সব শেষে বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপুজো উনিশো এক। নয়জন কুমারীকে পূজা করা এবং তাদের মধ্যে একজন কে দিয়ে পূজা করান। এই চারবার ছাড়া আরও কয়েক বার প্রথা অনুযায়ী কুমারী পূজা করেছেন। মোট কথা ঠাকুর শিষ্য নরেন্দ্রনাথ কোন উচ্চকোটির মহামানব ছিলেন তা নারী মাত্রকেই জগৎ জননী জ্ঞান করা এবং পূজো করার আন্তরিক আগ্রহ উপলব্ধি করা যায়। কুমারী বা রমণী মাত্রকে জগৎ জননী জ্ঞান করা। সেই সময়ে ঠাট্টা করে কালীমাতাকে বলতেন পুত্তলিকা। নির্মায়া,নির্মোহ বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর কাছে একম এবং অদ্বিতীয়ম ব্রক্ষই যখন হেয়। সেই বিবেকানন্দ কুমারী বা মাতৃপূজা করাটা কি আশ্চর্য জনক রহস্য জনক মনে হয় না? আসলে নিবেদিতাকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয় কিন্তু তিনি জানাতে চান নি। তিনি বলেছিলেন -That will die with me. আসলে, বিবেকানন্দের জীবনে এটাই মস্ত বড়ো জিনিস কুমারী পুজো;মাতৃ বন্দনা অদ্বৈতবান্দনার প্র্যাকটিকাল Demonstration. আমি যে সন্ন্যাসী,আমাকে বিয়ে করতে নেই,সকল রমণী আমার মাতৃসম। বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্মসভায় উপস্থিত হন। যুবক যখন উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন সকল আমার বোন ও ভাইরা।
মহাষ্টমী ও কুমারী পুজো ডায়েরি
আজ মহাষ্টমী। সকাল বেলা কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হয়েছে। সন্ধে সাতটা থেকে হবে সন্ধিপুজো। সকালবেলায় রামকৃষ্ণ মিশনে শঙ্করাচার্যের মঠ থেকে একজন প্রবীণ সাধু এসেছিলেন দন্ডী নিয়ে। দন্ডী হচ্ছে খুব পবিত্র। দন্ডী কখনও মেঝেতে রাখতে নেই,লম্বাভাবে রাখতে হয়,উনি হাতে ধরে ছিলেন। দন্ডী দিয়ে একে একে সব স্পর্শ করেছিলেন। বিভিন্ন ফলের পাত্রে মায়ের চরণে।সব মিলিয়ে ওনাদের একটা আচার অনুষ্ঠান দেখলাম। এবারের দুর্গা পূজার অষ্টমীর প্রভাতে। ভোর সাড়ে চারটা উনি এসেছিলেন সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ছিলেন। এরকম অনুষ্ঠান আমি আগে কখনও দেখিনি। আসলে প্রত্যেকটা ঘটনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অনেক ঘটনা। এই যে 'ভক্ত নিবাস'; কাশী রামকৃষ্ণ মিশনের প্রত্যেকটা ঘরে একটা পরিবার। কেউ এসেছে কলকাতা থেকে,কেউ এসেছে পশ্চিমবঙ্গের কোন গ্রাম থেকে,ঘাটাল,দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক থেকে। নানান পরিবার নানান শ্রেণির,নানান সমাজের, নানান পেশার।এখানে কিরকম মিলে মিশে এক। প্রত্যেকের জন্য একই ভোগের ব্যবস্থা।একই রকম নিয়ম মেনে, জুতো খুলে ভোজন কক্ষে প্রবেশ,মন্ত্রোচ্চারণ এবং প্রত্যেকটা কাজ একইরকম ভাবে সম্পন্ন করছেন নীরবে নিভৃতে। তবে দুর্গা পুজোর সময় আজ অনেক ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। এখন যেমন বিকেলবেলা নিউজিল্যান্ড এবং ভারতের ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। অনেকে দেখছেন, অনেক সাধুরাও দেখছেন। ব্যাট করছে নিউজিল্যান্ড। ভারত সবে একটা উইকেট ফেলতে পেরেছে। কি হবে?সেটা নিয়েও সাধুদের মধ্যে এই সামান্য একটু অবসরের সময়ে আলোচনা। সেই সব সাধুদের সাথে গল্প করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করছিলাম আপনারা ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলেছেন? সেই প্রবীন সাধু বললেন --ক্রিকেট? আমাদের ছোটবেলায় আমরা ডাংগুলি খেলতাম। তারপরে খেললাম ফুটবল। তখন তো ক্রিকেট ছিলই না। ডাংগুলির কথা বলতে কিরকম হঠাত মনে পড়ে গেল, আমাদের হাওড়ার পাড়াতে ছোটবেলায় দেখতাম সকলে ডাংগুলি খেলছে। আমি নিজে যে খুব একটা ডাংগুলি খেলেছি তা নয়। তারপর নরেন্দ্রপুরে গিয়ে ডাংগুলি খেলার সুযোগই পেলাম না। ডাংগুলির ব্যাপারটা আজকাল একেবারেই উঠে গেছে। গ্রামের ছেলেরা কি ডাংগুলি খেলে? খেলে না। সবাই কেমন বদলে যায়। ক'দিন বাদে এমন হবে! ডাংগুলি জিনিসটি কি? সেটা বুঝানোই কঠিন হয়ে যাবে। এভাবেই সময় বদলে যায়। নুতন সময়ের সঙ্গে নিজেদেরকে উপযোগী করে তুলি।
একটা প্রচলিত কথা আছে সাধুসঙ্গ। আমরা যে পরিবেশের মধ্যে থাকি সেই পরিবেশের মতো করে বড় হই। জীবনের ব্যাকরণ তৈরি করি। সেই ঠাকুরের কথামৃতে গল্প আছে না যে মেছনীর ফুলের গন্ধে ঘুম আসছিল না। আঁশ পুটলি নিয়ে শুলো তখন তাঁর ঘুম এল। আমরা যেরকম পরিবেশে থাকি সেরকমই তৈরি হয়ে যাই। এখন যেমন সময় সুযোগ পেলে একা একা গল্প করছি। আমি অথবা কোন প্রবীণ সাধু। কথা বলতে ভালো লাগে। অনেক পড়েছেন,অনেক জানেন,নিরহঙ্কার,বাস্তববাদী সাধু রামকৃষ্ণ মিশনে এখনো অনেক আছেন। নাম করে বলবো না। কেননা ,একেবারেই প্রচার বিমুখ সন্ন্যাসী। । বলছিলাম যে মনের একগ্রতা আনার জন্য কতটা জপ-ধ্যান কতটা জরুরী ।মনটাকে বশে আনা বড় কঠিন;আত্মসংযম;ইন্দ্রিয় সংযম। উনি বললেন সবচেয়ে প্রথম প্রয়োজন হচ্ছে শরীরের সংযম। মনের সংযম তো পরে হবে। মন তো বিক্ষিপ্ত হয়ে এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়ায়। দৃষ্টি এড়ায় যা না তারে বাঁধা। কিন্তু শরীরকে একটা আসনে উপবিষ্ট করে সবকিছু ভুলে গিয়ে বসে থাকার জন্য বসে থাকাও যদি প্র্যাকটিস করা যায় তাহলে সেটাও কিছু কম কথা নয়। অর্থাৎ আসন গ্রহণ করে,সেখানে একগ্রতা তৈরি করা,সেটা কিন্তু খুব সোজা কাজ না। যেমন একটি জপের মধ্যে দিয়ে মুক্তি লাভ। মা নাকি বলেছেন জপে মুক্তি। মনোযোগ দিয়ে আসনকে গ্রহণ করে থাকা সেটাও কম কথা নয়। একট গল্প বলছিলেন একজন ব্যক্তি খুব জপ-ধ্যান করতো। তাতে আরেক বন্ধু খুব ঈর্ষা হয়েছিল। কি করে তাকে কুপথগামী করা যায়। সেই তাকে বিপথগামী করার জন্যে সবরকম চেষ্টা করল। তখন একজন মহিলাকে ভাড়া করলো যাতে সে তার উর্জাশক্তির ভঙ হয় এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা। সে গেল এবং গিয়ে তাকে নানান ছলে কথা বলছে। আপনি কতক্ষণ জপ-ধ্যান করবেন?কখন উঠবেন। আমি সারা রাত জপ করবো। আপনি সারা রাত করেন! হ্যা,আমার শরীরের লোমকূপ যখন আর গোনা যায়না ,আমার শরীরের লোমকূপ গুনতে গুনতে ,যখন একটা সময় গোনা শেষ হয়ে যাবে তখন আমি ঘুমিয়ে পরবো। তখন এমন হলো সেই আসন থেকে বিযুক্ত করা গেল না বলে তাকে কিছুতেই ইন্দ্রিয় বাসনায় টেনে আনা গেল না। আসনের মধ্যে দিয়ে অভ্যাস তৈরী করা এটাও একটা বড় যোগসাধনার অঙ্গ। দুটি শব্দ। একটা হলো "জপাৎ সিদ্ধি"। মা বলেছেন জপেই সিদ্ধি। আসন সিদ্ধি। অর্থাৎ আসনে বসার অভ্যেস করতে সিদ্ধিলাভ করতে হবে।
কতরকম চরিত্র! শুধু তো অতিথিভিলা নয়! আমি সকলের সঙ্গে গল্প করছি। মজা পাচ্ছি। নিজেকে কালকূট কালকূট ভাব করছি। এই যে বাবলু Tea Stall .রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমের গেট থেকে বেড়োলেই গেটের দুদিকে দুটো চায়ের দোকান।একটা সুপ্রাচীন।পঞ্চাশ-পচাত্তর বছরের পুরনো। সেখানে বাবলু দোকানকরেএখন। তার বাবা সেই দোকান করেছিলেন। উনি এখন গত হয়েছেন ।এখন বাবলু আর বাবলুর ছেলে সেও এখন চা বানাচ্ছে। সেই দোকানটা অনেক সংগঠিত। অনেক জিনিস পাওয়া যায়। দাঁত মজার ব্রাশ পেষ্ট,চা,টি-ব্যাগ;মশা মারার গুডনাইট পর্যটক নির্ভর জিনিস পত্র বেশ পাওয়া যায়। বাবুলর সাথে গল্প করছিলাম। বাবলু কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনের থেকে দীক্ষা নিয়েছে। স্বামী ঋতা নন্দা যখন ছিলেন, তখন তিনি দীক্ষা দিয়ে ছিলেন। রামকৃষ্ণদেবের পূজা করে।Tea-stall এ রামকৃষ্ণদেবের ছবি। আসলে যেখানে আশ্রমেকে কেন্দ্র করে একটা হাসপাতাল চলে;গরীব মানুষের সেবা করে।লোকের কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশন বলার দরকার হয় না।বলে যে কোড়িয়া হাসপাতাল। কোড়িয়া হাসপাতাল কেন বলে? সেটা অনেকেই বলে এক কড়ি অর্থাৎ খুব কম পয়সায় হাসপাতাল ছিল বলে কোড়িয়া হাসপাতাল বলে। কিন্তু সেই হাসপাতালের চারদিকে অনেক ওষুধের দোকান হবেই।সেই সব দোকানের নাম 'রামকৃষ্ণ মেডিক্যাল স্টোর। সেটাও কিন্তু একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এছাড়া আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে জায়গা গুলো, যেখানে চায়ের দোকান বানিয়েছিল সেই সময়ের যে সন্ন্যাসী মহারাজ ছিলেন তাদেরকে বসতে দিয়েছেন। তারপর বসতে বসতে একটা হক তৈরী হচ্ছে;মামলা মকদ্দমা চলছে। মাসে মাসে সাত টাকা করে দিতে হয়;সেটাও কাছারিতে গিয়ে দিয়ে আসতে হয়। অধিকার নিয়ে সরকারের সাথে মামলা মকদ্দমা চলছে। অন্যদিকে নন্দলালের চায়ের দোকান।তার দোকানেটা অবশ্য ঠিক তার দোকানটা আনুষ্ঠানিক Structure না। কিন্তু রাস্তার উপরে চা, বিস্কুট, মঠ্ঠি বিক্রি হয়। বাংলা কথা বলতে শিখে গেছে। নন্দলালের মেয়ে প্রিয়া, রাস্তার উল্টো দিকেই তাদের বাড়ি। ছেলের নাম প্রত্যুষ।মেয়ের কালীপুজোর পর বিয়ে।
এখানে যত সাধুদের আখড়া আছে সেই সমস্ত আখড়ার Coordinater থাকে। তাকে বলা হয় 'কোতোয়াল সাধু'। এটা একটা পদ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আখড়া থেকে কোতোয়াল সাধু হয়। বিভিন্ন আখড়ায় যখন ভান্ডারা হয় খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয় সাধুদের;তখন কোতোয়ালের দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন মঠ মিশনে গিয়ে জানান দেওয়া যে আজ অমুক জায়গায় ভান্ডারা হবে এবং আপনাদের মঠের পক্ষ থেকে একজন বা দুজন প্রতিনিধি উপস্থিত হলে বাধিত হবো। রামকৃষ্ণ মিশনের বুক Sell কাউন্টারে বসে আছি বামাপদ মহারাজের সামনে। হন্তদন্ত হয়ে কোতোয়াল সাধুজী আসলেন এবং বললেন কাল কেদার মঠে ভান্ডারা হবে।আপনারা কাউকে একজনকে পাঠাবেন এবং মহারাজ আপনি যাবেন। বামাপদ মহারাজ বললেন আমি যাব কি করে?আমাদের এখানে তো পুজো চলছে।আমাদের তো কোন যাবার ব্যাপার নেই। কোন একজন যেতে পারে তা দেখছি কি করা যায়! এটা হচ্ছে কোতোয়াল সাধুর ভূমিকা। এটাও কিন্তু একটা চিত্তাকর্ষক ঘটনা। আমি কিন্তু জানতাম না যে আখড়াদের মধ্যে একটা Coordinater আছে যার কাজ হচ্ছে সমস্ত আখড়ার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।
হাসপাতালের প্রধান মহারাজ আশীষ মহারাজ। ওনার অফিস ঘরে বিরাট একটা Aquarium আছে। বহু বছর থেকে দেখছি। সেই Aquarium এ নানান ধরনের সমস্ত মাছ আছে। জেলী ফিস এই নামটাই জানি আরও নানান ধরনের মাছ আছে।এমনকি ওখানে একটা কচ্ছপ আছে।খুব সুন্দর দেখতে। কুচকুচে কালো ছাই ছাই ডোরা কাটা। এবং মজার ব্যাপার কচ্ছপ আর মাছ একসাথে সহবাস করে এবং তারা খুব নিজে আনন্দে থাকে। খাওয়া দাওয়া যথেষ্ট হয়। এখানেই জন্ম,এখানেই অনেকের মৃত্যু হয়েছে।ওখানে Aquarium কাছে আমি গেলেই,একটু ঠুকঠুক করি ,মজার ব্যাপার ওরা সব এসে যায়,আওয়াজটা পায়।ওদের সংবেদন সংবহন হয়;ওরা আনন্দ পায়। যে আমার কেউ খোঁজ করছে; বা আমি আছি এক ধরনের Participation.একাকীত্ব বোধহয় দূর হয়। এগুলো সব মানুষের ভাবনা। প্রাণীকে দেখা। প্রাণী হয়ে প্রাণীকে দেখতে পাই না! আজকে যখন সকাল বেলা অষ্টমীর দিন পথি মধ্যে (পান্থ নিবাস থেকে মন্দিরে আসছি ভোরবেলা) হঠাৎই দেখলাম একটা বাজ পাখি। চিলের প্রজাতি এই বাজ পাখি। সে অত বড় নয়,পায়রা থেকে বড়,ধুঁকছে। আঘাত লেগেছে,মনে হচ্ছে যেন এখুনি মারা যাবে। তো আমি যখন হেঁটে হেঁটে মন্দিরে এলাম তখন দেখলাম আর যখন ফিরে যাচ্ছি পান্থনিবাসে তখনও দেখলাম ।খবর দিলাম একজন সুপার ভাইজার কর্মী ব্যবস্থা করলো।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়ে গেল। তবে তার চিকিৎসা তো এখানে হবে না। তার জন্য পশু চিকিৎসালয়ে পৌঁছে দিতে হবে। এখন খবর নিলাম, এখন আগের থেকে ভালো আছে। পশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রামকৃষ্ণ মিশনের ব্যবস্থাপনায় এটা হয়েছে।
এটাকেই বোধহয় বলে 'ইকো সিস্টেম'। আমরা কিন্তু নানা রকমের প্রাণী জগতের সঙ্গে সহবাস করি। জেলে যখন জহরলাল নেহরু ছিলেন উনি লিখেছিলেন না Animals in prison.বা ইন্দিরাকে যখন চিঠি লিখতেন তখন তিনি লিখতেন কত রকমের জেলের মধ্যে তিনি প্রাণী দেখে ছিলেন কারণ তখন তিনি সময় পেয়েছিলেন। কর্মব্যস্ততায় তো চোখে পড়েনি। এখন যেমন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কেন্ন্য ধীর গতিতে চলে;সেটাও আমার চোখে পড়ে,দাঁড়িয়ে দেখি। একটা কাঠবিড়ালিদের প্রথম দিন এসে দেখতে পাচ্ছিলাম না, তাই খুব মন খারাপ হচ্ছিল। ভাবছিলাম কাঠবিড়ালিগুলি সব কোথায় গেল? পরেরদিন প্রচুর কাঠবিড়ালি দেখতে পেলাম আবার মুখে করে কী আবার সমস্ত অনেক কিছু নিয়ে গিয়ে ঘর বানাচ্ছে। বিশেষভাবে জানতে পারলাম, এই সময় তাদের প্রসবের সময়। তারা এখন সন্তানের ঘরের ব্যবস্থাপনা করার জন্য তারা খুব সক্রিয়। কাঠবিড়ালি ছাড়াও অনেক রকম কুকুর আছে। তারা বিস্কুট খাবার জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সব বিস্কুট আবার তারা খাবেনা। Parle-G ছাড়া অন্য কোন বিস্কুট তারা পচ্ছন্দ করেনা। মারি গোল্ড দিলেও তারা খাবে না। সমস্ত কুকুর গুলোকে নিয়েও বেশ সময় কাটে। পুজোর সময় তারা কিন্তু খুব ব্যস্ত। এরকম হাসপাতালের মধ্যে প্রচুর বাঁদর আছে;তারা কোনও অনিষ্ট করে না। খেতে না পেলে রেগে গেলে একটু অনিষ্ট হয়। কিন্তু মিশনের হাসপাতালের কিচেনের দিকটা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম সব একজোট হয়ে ঘুরছে,হাটছে। জানলাম এই জায়গাটা আসে তার কারণ ওরা এখানে খাবারের গন্ধটা পায় এবং তরিতরকারি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তাই। গরমকালে অনেক সময় খাদ্যাভাব হলে ওরা জঙ্গল থেকে চলে আসে,শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন ওরা খুব ক্রুদ্ধ হয়ে থাকে। খেতে না পেলে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। এই সমস্ত নাানা রকম প্রাণী জগতের সঙ্গে পুজোর সময় রামকৃষ্ণ মিশনে দেখা হচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে একটা কথোপকথন গড়ে উঠেছে। Non Verbal কথোপকথন কিন্তু বলা যাবে না। কারণ,তারা কিন্তু নানা স্বরে ডাকছে,সেটা বুঝে নিতে হবে। আমিও তাদের সঙ্গে কথা বলছি,মনে হচ্ছে ওরাও বুঝতে পারছে।
চলবে...