scorecardresearch
 

'কাঁদো বাংলাদেশ কাঁদো'...বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে কলম ধরলেন তসলিমা

বাংলাদেশে আশির দশক থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে ইসলামি সমাজ তৈরির জন্য তৎপর হয়েছলেন দেশের শাসকগণ। সংবিধানকে ইসলামিকরণ করা হয়েছে।

Advertisement
তসলিমা নাসরিন তসলিমা নাসরিন
হাইলাইটস
  • হাসিনা প্রতিবার প্রতিশ্রুতি দেন, অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে
  • কিন্তু, বাস্তবে চিত্রটা উল্টো
  • বাংলাদেশে আসলে হাসিনার জিহাদিস্তান

বাংলাদেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি নিয়ে কলম ধরলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন।  জানালেন নিজের মত। 

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে  বাংলাদেশের যুদ্ধই  প্রমাণ করেছে 'মুসলিম ইউনিটি' একটি ভুল ধারণা, প্রমাণ করেছে ভারত ভাগের  দ্বিজাতিতত্ত্ব ছিল ভুল সিদ্ধান্ত, প্রমাণ করেছে ধর্ম বর্ণের ঊর্ধ্বে মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি। গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই বাঙালি হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানকে ইউনিটি দিয়েছে। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যেই  ধর্মনিরপেক্ষতা মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাক স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই দেশে, গণতন্ত্র শয্যাশায়ী।

বাংলাদেশে আশির দশক থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে ইসলামি সমাজ তৈরির জন্য তৎপর হয়েছিলেন দেশের শাসকগণ। সংবিধানকে ইসলামিকরণ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রগতিশীল মানুষের বিপুল ভোটে জিতেছেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে তিনি ১৯৭২’এর ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ফিরিয়ে আনবেন, তিনি দেশের পারিবারিক আইনকে ধর্মমুক্ত করবেন, তিনি ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না, তিনি ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে আলাদা করবেন, তিনি সংখ্যালঘুদের সম্পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবেন, তিনি নারীর সমানাধিকার আনবেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন করবেন। অথচ ক্ষমতায় এসে তিনি এসবের কিছুই করেননি। তিনি ব্যস্ত ছিলেন কী করে বিরোধীদলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করা যায়, কী করে ইসলামি মৌলবাদীদের সমর্থন আদায় করে আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকা যায়।

তিনি দেশ জুড়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মসজিদ মাদ্রাসা থাকা সত্ত্বেও মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে তুলেছেন। যে মসজিদ মাদ্রাসাগুলোর অধিকাংশই মৌলবাদি এবং জিহাদি তৈরির কারখানা। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন তিনি বিরোধী দল জামাতে ইসলামি এবং বিএনপির চেয়েও বেশ ধার্মিক। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি যত ইসলামিকরণ করেছিল দেশের, তার চেয়ে বেশি করলেন শেখ হাসিনা। তিনি উগ্রপন্থী জিহাদি মৌলবাদিদের সারা দেশ জুড়ে ওয়াজ মাহফিল (ধর্মসভা) করার অনুমতি দিলেন। এঁরাই  নতুন প্রজন্মের মগজ ধোলাই করতে লাগলেন জিহাদের মন্ত্র দিয়ে। মূলত  নারীর বিরুদ্ধে এবং অমুসলিম বিশেষ করে হিন্দুর বিরুদ্ধে  তাদের জিহাদ। নারীকে ঘরবন্দি করার আর বোরখাবন্দি করার জিহাদ। হিন্দুদের  উৎখাত করার জিহাদ। হিন্দুদের মন্দির ভাঙাকে তারা জিহাদের অংশ বলেই মনে করে। মৌলবাদিরা নতুন প্রজন্মের মগজ ধোলাই করেছে এই বলে যে, অমুসলিমরা সব কাফের, তারা আল্লাহ মানে না, আল্লাহ তাদের দোজখে নিক্ষেপ করবেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের প্রতি তীব্র ঘৃণা যেন মুসলমানদের মনে জন্ম নেয়, সেই চেষ্টা নিরবধি চলছে মসজিদ মাদ্রাসায়। হাসিনার সরকার সব জেনেও হিংসে এবং ঘৃণার ধর্মপ্রচারকে বন্ধ করার কোনও চেষ্টা করেননি।  শেখ হাসিনা কোনও বিজ্ঞান স্কুল তৈরি করেননি, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার করেননি, বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি বাড়াননি, মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করার ব্যবস্থা করেননি, তিনি মানুষকে ধর্মান্ধ বানাবার সব রকম  ব্যবস্থা নিয়েছেন। ইসলামি দলগুলোকে সহস্র কোটি  টাকা দান করেছেন, মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমতুল্য করেছেন, এমনকী স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তক থেকে  অমুসলিম লেখকদের লেখা  সরিয়ে দিয়ে শুধু মুসলিম লেখকদের লেখা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পাকিস্তান আমলেও পাঠ্যপুস্তককে এমন সাম্প্রদায়িক করা হয়নি।  

Advertisement

যতবারই হিন্দুদের ওপর মুসলমান মৌলবাদিদের নির্যাতন ঘটে, শেখ হাসিনা  প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি সব অপরাধীকে গ্রেফতার করার এবং শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটি ভিন্ন। বাংলাদেশের নামী মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত নয় বছরে তিন হাজারের চেয়ে বেশি হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমানরা অপরাধ ঘটিয়েছে, এবং একটি অপরাধীরও আজ অবধি বিচার হয়নি।

হাসিনা নিজের দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। তাঁর দেশে হিন্দুদের বাড়ি ঘর, মন্দির যখন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তখন  তিনি ভারতে যেন প্রতিশোধ নিতে মুসলমানের ওপর হিন্দুরা আবার না অত্যাচার করে বসে -- সেই নিয়ে চিন্তিত। ভারতের মুসলমানদের কঠোর নিরাপত্তা যেন দেওয়া হয়-- তা ভারত সরকারকে জানিয়ে দেন। তিনি বিদেশের মুসলমানের জন্য চোখের জল ফেলেন, অথচ নিজের দেশের নির্যাতিত মানুষের জন্য চোখে কোনও জল নেই তাঁর। রংপুরের পিরগঞ্জে দুটো গ্রাম  যখন পুড়ছিল , হিন্দুরা গৃহহীন পড়ে আছে, বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে, পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তখন তিনি তাঁর ছোট ভাই শেখ রাসেলের জন্মদিন দেশজুড়ে ঘটা করে পালন করেছেন।

কেউ কেউ বলে হিন্দুরা আর তাঁর ভোট ব্যাঙ্ক নয়, তাই তাদের নিরাপত্তা নিয়ে হাসিনার মাথাব্যথা নেই। অথচ হাসিনা যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তা তিনি সহজে রক্ষা করতে পারতেন, যেহেতু কোনও বিরোধী দলের আপত্তি করার আশঙ্কা নেই।  তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে পারতেন সংবিধানে। প্রশ্ন জাগে, হাসিনা কি আদৌ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী? সত্যি কথা হল, হাসিনা বাংলাদেশকে জিহাদিস্তান বানানোর জন্য যা যা করা দরকার করছেন।

আসলে কোরান সবচেয়ে বেশি অবমাননা করে মুসলমানেরা। এই কোরান অবমাননাকারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে জিহাদিরা কোনও আওয়াজ ওঠায় না। অথচ কোরান অবমাননা করেছে হিন্দুরা, এই মিথ্যে দোষ দিয়ে হিন্দুর ঘর বাড়ি মন্দির ভেঙে ফেলা হয় । এসব কি হাসিনা জানেন না? সব জানেন। জেনেও তিনি হিন্দুদের কোনও নিরাপত্তা দেন না। বিশ্বকে বোকা বানাতে দু'একটা হিন্দুনির্যাতক জিহাদিকে গ্রেফতার করা হবে, তারপর দুদিন পর সবকটা জিহাদিকে চুপচাপ মুক্তি দেওয়া হবে। এই হল হাসিনার জিহাদিস্তান।

বাংলাদেশের সর্বত্র বাংলাদেশিদের উৎসবের মূর্তি ভেঙেছে বাংলাদেশের মুসলমানেরা। কিন্তু এই মূর্তি ভাঙার খবর প্রকাশ করলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, তাই সরকারের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের মিডিয়া মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিল কয়েকদিন। হিন্দুর বাড়িঘর দোকানপাট ভাঙা হয়েছে কুৎসিত হিন্দুবিদ্বেষ থেকে। এই বিদ্বেষ উস্কে দিয়েছে ইসলামের নেতারা, শুধু ইসলামের নেতারাই নন, এই বিদ্বেষ উস্কে দেওয়া, মন্দির ভাঙাতে অংশগ্রহণ করে আওয়ামি লিগের স্থানীয় নেতারাও। তাদেরও আছে হিন্দুদের জমিজিরেত দখল করার লোভ।

Advertisement

লজ্জা লিখেছিলাম ২৯ বছর আগে। কী করে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হয়, এবং শেষ অবধি হিন্দুরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় -- এই কাহিনি বর্ণনা করেছি অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে লেখা বই লজ্জায়। বইটিতে ফিকশানের পাশাপাশি দীর্ঘকাল ধরে হওয়া হিন্দু নিপীড়নের তথ্য সমৃদ্ধ ননফিকশান আছে। লজ্জা নিষিদ্ধ করেছে খালেদা জিয়ার সরকার। হাসিনা সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে।  বাংলাদেশের একটি প্রাণীও লজ্জা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা করেনি। বইটিকে মুক্ত করার চেষ্টা করেনি।  আজ ২৮ বছর যাবত লজ্জা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। এই বইটি যদি নিষিদ্ধ না হত, এটি পড়লে অন্তত কিছু মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতো, অন্তত কিছু মানুষের বোধোদয় হতো, অন্তত কিছু মানুষ জিহাদি হওয়া থেকে বিরত থাকতো।  হাসিনা এবং  খালেদা কেউই সেটা চাননি। আমাকে দেশে প্রবেশ করতে খালেদা সরকার যেমন দেননি, হাসিনা সরকারও দেননি। আমার দোষ হল, আমি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ চেয়েছি, আমি মুক্তচিন্তার প্রসার চেয়েছি, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চেয়েছি। হাসিনা যদি বিশ্বাস করতেন এসব বিষয়ে তিনি লজ্জা থেকে নিষেধাজ্ঞা ওঠাতেন এবং দেশে প্রবেশ করার অনুমতি দিতেন। আমার অধিকার লঙ্ঘন করে তিনি তো প্রমাণ করছেন তিনি একজন কম বড় মৌলবাদি নন।

কত বড় ভণ্ড হলে তিনি ভারতকে বলতে পারেন, ভারতের সংখ্যালঘুদের যেন নিরাপত্তা দেওয়া হয়। কবে ভারতীয় মুসলিমদের ঈদ ভারতের হিন্দুরা বোমা মেরে পণ্ড করেছে? কবে তাদের ঈদের দিন মুসলিমদের গ্রামে আগুন ধরানো হয়েছে? ভারতের মুসলমানদের ওপর যে একেবারেই অত্যাচার হয় না, তা নয়, হয়। তবে এমন কোনও অত্যাচার নয় যে মুসলমানরা ভারত ছেড়ে কোনও মুসলিম দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশের হিন্দুরা কিন্তু ভয়ে দেশ ত্যাগ করছেই। ১৯৪৭ সালে ছিল শতকরা ২৯.৭ ভাগ হিন্দু, আজ সেই সংখ্যা আট বা নয়ে নেমেছে।

দেরিতে হলেও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে প্রগতিশীল মানুষ। এই প্রতিবাদ দেখে আশা জাগে বোধহয় দেশকে জিহাদিমুক্ত করা সম্ভব, তবে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া দেশকে মৌলবাদী এবং জিহাদি মুক্ত করে ধর্মনিরপেক্ষা দেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কথায় কথায় হাসিনা বলেন তিনি দেশের বিরাট উন্নয়ন করেছেন। তিনি এটাই বুঝতে চান না যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেই দেশের উন্নতি হয় না, দেশ সভ্য হয় না। সত্যিকার উন্নত এবং সভ্য দেশ হতে হলে দেশের নারীদের এবং সংখ্যালঘুদের সমানাধিকার এবং নিরাপত্তা সবার আগে জরুরি।

বি দ্র: এই লেখায় যাবতীয় বক্তব্য লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত। 'আজতক বাংলা' কোনওভাবে দায়ভার নেবে না।

Advertisement