সংবিধান প্রবর্তনের স্মৃতিতে প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি তারিখটি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। এই বছর ভারতবাসী ৭৩ তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করতে চলেছে।
নেতাজি জন্মজয়ন্তীর পরপরই ক্যালেন্ডারে যে দিনটাকে ঘরে দেশাত্মবোধক আবেগ জাগ্রত হয় প্রত্যেক ভারতীয়র মনে, সেটি হল ২৬ জানুয়ারি। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারতবর্ষ। কিন্তু সে সময় ভারতের নিজস্ব কোনও স্থায়ী সংবিধান না থাকায় ব্রিটিশ সরকার প্রণোদিত ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টের সংশোধিত সংস্করণ অনুযায়ী স্বাধীন ভারত শাসিত হত।
ভারতের সংবিধান রচনার জন্য ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর তারিখে তৈরি হয়েছিল গণপরিষদ। তারপরে নানা আলাপ-আলোচনার পথ ধরে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক রচিত সংবিধান গৃহীত হয়। এরপরে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখ থেকে এই সংবিধান কার্যকরী হয়। সেই সূত্রেই ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীন হয় ভারত। কিন্তু এদিনটি ভারতীয়রা বেছে নেননি। লর্ড মাউন্ট ব্যাটন ১৫ অগাস্ট দিনটিকে বেছে নিয়ে ভারতকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন।দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এই একইদিনেই জাপান মিত্রশক্তির কাছে হার মানে। তাই ১৫ অগস্ট দিনটিকে বেছে নেয় ব্রিটিশ সরকার।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টে দেশ স্বাধীন হলেও তখন ভারতের নিজস্ব কোনও সংবিধান ছিল না। স্বাধীনতার দু'সপ্তাহ পর ২৯ অগস্ট ড: বি. আর আম্বেদকরের অধ্যক্ষতায় ভারতে স্থায়ী সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশে একটি খসড়া কমিটি গড়ে তোলা হয়। ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর ডঃ বি. আর আম্বেদকরের নেতৃত্বকারী খসড়া কমিটি সংবিধান সভায় ভারতীয় সংবিধানের খসড়া জমা দেয়। এরপর দু'বছরেরও অধিক সময় ধরে জনগণের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা ও নানান চিন্তাভাবনার পর প্রস্তাবিত সংবিধানে কিছু সংশোধন, সংযোজন ও পরিবর্তন আনা হয়। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর সংবিধান সভায় ভারতীয় সংবিধানের খসড়া গৃহীত হয়।
১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচিত হয়। সেইসময় ভারতের সংবিধান রচয়িতারাই সিদ্ধান্ত নেন যে, স্বাধীনভারতের প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠা কোনও একটি বিশেষ দিনে পালন করা উচিত। এরপরেই ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়।এরপর ১৯৫০ সাল থেকে পালন করা শুরু হয় প্রজাতন্ত্র দিবস।এবার প্রশ্ন উঠে আসে, কেন ২৬ জানুয়ারি তারিখকেই প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
সাত দশক আগে ২৬ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছিল ভারতের সংবিধান। তবে তার আগে কিন্তু এই দিনটিকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে বিবেচনা করা হত। মহাত্মা গান্ধী নাম দিয়েছিলেন স্বতন্ত্রতা সংকল্প দিবস। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ১৯২৯ সালের বর্ষশেষে 'পূর্ণ স্বরাজ' আনার শপথ ঘোষণার পর ১৯৩০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারিকেই স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে ঔপনিবেশিক শাসনের শিকল ভেঙে ভারত যেদিন বাস্তবেই স্বাধীনতার মুখ দেখল- সেইদিন ঘটনাচক্রে ছিল ১৫ অগাস্ট। যার ফলে পালটে গেল ২৬ জানুয়ারির গুরুত্বও।
১৯৫০ সালে দেশের সংবিধান প্রস্তুত হওয়ার পর, তা কার্যকর করতে প্রয়োজন হল একটি দিনের। তখনই ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যের বিচারে বেছে নেওয়া হয় ২৬ জানুয়ারিকেই। এই কারণেই ২৬ জানুয়ারি পরিচিত হল ভারতের সাধারণতন্ত্র দিবস হিসেবে।
এই বিশেষ দিনের তাৎপর্য কী!
প্রতি বছর রাজধানী দিল্লির রাজঘাট থেকে বিজয়পথ বরাবর একটি কুচকাওয়াজ আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত থাকেন আর্মি, নেভি, এয়ার ফোর্সের বিভিন্ন রেজিমেন্টরা। তাঁরা তাঁদের সমস্ত অফিসিয়াল সজ্জায় মার্চ পাস্ট করে। তাছাড়া অশ্বারোহী ঘোড়াগুলিও অনুষ্ঠানের জন্য সুন্দরভাবে সাজানো হয়। নির্দিষ্ট রাজ্যের সঙ্গীত চালানো হয়। এই এই সুন্দর চিত্রগুলি ভারতীয় সংস্কৃতির বহুগুণ সমৃদ্ধি বাড়িয়ে তোলে। পুরো অনুষ্ঠানটি একটা সুন্দর মুহুর্তের বাতাস বয়ে আনে।
২৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ১৮ মিনিটে ভারতের সংবিধান কার্যকরী হয়। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রথম গণতন্ত্র দিবসের প্যারেড রাজপথের পরিবর্তে তৎকালীন ইর্ভিন স্টেডিয়াম (বর্তমানে ন্যাশনাল স্টেডিয়াম)-এ আয়োজিত হয়েছিল। সে সময় ইর্ভিন স্টেডিয়ামের চারদিকে দেওয়াল ছিল না ও সেখান থেকে লালকেল্লা স্পষ্ট দেখা যেত।
প্রজাতন্ত্র দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের মধ্যে কী পার্থক্য?
প্রজাতন্ত্র দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের মধ্যে কিছু পার্থক্য দেখা যায়> প্রজাতন্ত্র দিবস ও স্বাধীনতা দিবস উভয়ই জাতীয় দিবস। কিন্তু যা আলাদা দিন পালন করা হয়। স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগস্টকে পালন করা হয়। কারণ, এই দিনে ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। আর ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করা হয়। কারণ, সংবিধানের সহযোগিতায় একটি গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল আমাদের দেশ।