ভূতে বিশ্বাস করেন? কী বললেন? করেন না? আচ্ছা বেশ। ভূত বা আত্মায় বিশ্বাস যদি না-ও করেন তবুও আজকের দিনটা কিন্তু চতুর্দশী।
কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিকে বলা হয় ভূত চতুর্দশী। কালী পুজোর আগের রাত ভূত চতুর্দশী হিসাবে পালন করা হয়। আজই নাকি সন্ধ্যের পর তেনাদের দেখা মেলে। তাদের খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু অনুভব করা যায়। ছোট থেকেই ভূত চতুর্দশী নিয়ে আমরা অনেকেই অনেক কথা শুনে এসেছি।
ভূত নিয়ে মানুষের মনে কম জল্পনা নেই। আদৌ কি ভূতের অস্তিত্ব আছে? নাকি পুরোটাই কল্পনা। তা জানতে ভূত প্রেমীরা দশকের পর দশক ধরে কম কাণ্ড করেননি।
উত্তর খুঁজতে ভূত চতুর্দশী তেও অনেক কাণ্ড করে থাকেন ভূত প্রেমীরা। যদিও রাজ্যের অন্যতম ভূতের জায়গা হিসেবে বলা হয় পুরুলিয়ার বেগুনকোদরকে, ইছামতির পারেও যে ভূতের আড্ডাখানা তাও বলে থাকেন অনেকেই।
আপনি যদি ভূত দেখতে চান তাহলে রাত নামলে ঢুঁ মারতে পাড়েন শহর কলকাতার এই জায়গাগুলিতেও। লোকমুখে শোনা যায় এইসব জায়গাতে নাকি 'তেনাদের' দেখা মিলতে পারে।
ইন্ডিয়ান মিউজিয়ম
কলকাতার একটা উল্লেখযোগ্য ভূতের বাড়ি হল, ইন্ডিয়ান মিউজিয়ম। চৌরঙ্গি রোড বা এখনকার জওহরলাল নেহরু রোডের এই মিউজিয়ম-বাড়িটি তৈরি হয়েছিল ১৮৭৫-৭৮ সালে। এখানে রয়েছে প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো এক মিশরীয় মানুষের মমি। আরও আছে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হাড়গোড় দিয়ে সাজানো গ্যালারি। রয়েছে প্রাণিবিদ্যার নানা নমুনাওয়ালা ‘জুলজি-গ্যালারি’। এত মরা প্রাণী যেখানে, সেখানে ভূত থাকবে না— এমন কখনও হয়?
ন্যাশনাল লাইব্রেরি
ভুতুড়ে কার্যকালাপে এই লাইব্রেরির যথেষ্ট দুর্নাম রয়েছে। অনেকেই এই লাইব্রেরিতে ভূতের দেখা পেয়েছেন বলে দাবি করেন। দিনদুপুরেই অশীরীর পদচারণার শব্দও পেতে পারেন। কিন্তু কার পদচারণার শব্দ শুনছেন আপনি? কেই-বা আপনার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে গেলেন? কানাঘুষো শোনা যায়, লর্ড মেটাকাফের স্ত্রীর আত্মাই নাকি ঘোরাফেরা করে লাইব্রেরিতে। ওই অশীরীরির উপস্থিতি নাকি টের পেয়েছেন লাইব্রেরির কর্মীরাও।
হেস্টিংস হাউস
কলাকাত শহরের অন্যতম পুরনো স্থাপত্য এটি। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বাসস্থান ছিল। এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা কলেজ। এখানকার ছাত্রীরাই ভুতুড়ে কাণ্ড-কারখানার কথা জানিয়েছেন। অনেকে ঘোড়ায় চড়ে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতেও দেখেছে এক সুটেড-বুটেড ইংরেজ সাহেবকে। তারপর মিলিয়ে গিয়েছেন হাওয়ায়। কখনও আবার কাগজপত্রের খসখসানি শোনা যায়। হেস্টিং সাহেব স্বয়ং নাকি এই বাড়িতে বিরাজ করেন। কেউ কেউ আবার বলেন, এক ফুটবল প্রেমীর আত্মা রয়েছে এই বাড়িতে। ওই যুবক নাকি ফুটবল খেলতে গিয়ে মারা গিয়েছিল।
মল্লিকঘাট
হাওড়া ব্রিজের নীচে মল্লিকঘাট ফুলবাজারের সামনের ঘাটেও ভূতের অস্তিত্ব টের পান অনেকেই। এখানে আবার সাদা শাড়ি পরিহিত পেত্নী নাকি ঘোরে। যাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করেন, তাঁরা নাকি প্রতিদিন একটা না একটা ভৌতিক কাণ্ডকারখানার স্বাক্ষী থেকেছেন। কখনও দেখেন এক মহিলাকে সাদা শাড়ি পরে ঘুরতে। কখনও নাকি-সুরে কান্নার আওয়াজও পাওয়া যায়। লোকেদের ধারণা, গঙ্গায় ডুবে কোনও মহিলার মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর আত্মাই এখন ঘুরে বেড়ায়।
নিমতলা শ্মশানঘাট
কলকাতার বিখ্যাত শ্মশানঘাট নিমতলা। অমবস্যার রাত এলেই এখানে নাকি তেনাদের আনাগোনা শুরু হয়। তারপর ভূত চতুর্দশীর বিশেষ দিনে তো কথাই নেই। কত নাকি অশীরীরি আত্মার বিচরণ ঘটে এই নিমতলা ঘাটে। কত রকমের অলৌকিক ঘটনা ঘটে। তবে এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এখানে বহু মানুষের শবদাহ হয়। তাই সেখানে অশীরির আত্মার বিচরণ করা অস্বাভাবিক ঘটনা নয় তাঁদের কাছে।
লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থান
লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরস্থানে শায়িত রয়েছে স্যার উইলিয়াম হে ম্যাকনটন। প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে তিনি নিহত হয়েছিলেন। তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল এই গোরস্থানে। স্যর উইলিয়ামের স্ত্রী স্বামীর ছিন্নভিন্ন দেহ আফগানিস্তান থেকে নিয়ে এসে সমাধিস্থ করেছিলেন কলকাতায়। উইলিয়াম সাহেবের এই সমাধির কাছে গেলেই কবরের সামনে ছায়াদানকারী গাছটি কাঁপতে থাকে। কথিত আছে, উইলিয়ামের ক্ষুব্ধ আত্মার আস্ফালনেই কাঁপে গাছটি।
দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান
পার্কস্ট্রিটের এই গোরস্থানে বেশিরভাগ সমাধিই ব্রিটিশ সৈন্যদের। কলকাতার সবথেকে পুরনো এই কবরস্থান নিয়ে অনেক গল্প রয়েছে। অনেকেই এই জায়গা পরিদর্শন করে অনেক অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছেন। একবার এক দল যুবক এই কবরস্থানের ফটো তুলেছিলেন। সেই ছবিতে কিছু অদ্ভুত আকৃতি ধরা পড়ে। পরে ওই যুবকরা প্রত্যেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
কলকাতা হাইকোর্ট
১৩ নম্বর কোর্ট রুম। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এখান থেকেই। অনেকের দাবি, এখনও গভীর রাতে রক্তাক্ত পা হেঁটে গিয়ে ঢোকে ওই কোর্ট রুমে।
আকাশবাণী
কলকাতার পুরনো ভুতুড়ে বাড়ির মধ্যে এক নম্বর গারস্টিন প্লেস এবং দ্বিতীয় এর প্রথম অফিস। আকাশবাণীর পুরনো দফতর গারস্টিন প্লেসে বারবার দেখা গিয়েছে অশরীরী আত্মা। ফাঁকা লম্বা করিডর, অজস্র স্টুডিও আর ব্রিটিশ অবকাঠামো মিলিয়ে আকাশবাণীর ভুতুড়ে অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। রাত গভীর হলে অনেকেই দেখেছেন সাহেবের ছায়া উবু হয়ে কাজ করছে। আবার কেউ কেউ দেখেন মধ্যরাতে রেকর্ডিং রুমের বারান্দায় কে যেন গান শুনছেন। হয়তো বেতারের আশ্চর্য বিজ্ঞানী সে যুগের মনে জন্ম দিয়েছিল এসব ভুতুড়ে বিশ্বাসের। এখনো নানা স্টুডিও থেকেই রাতে ভেসে আসে যান্ত্রিক সুর। বলাই বাহুল্য, সেই যন্ত্রগুলো কোনো মানুষ বাজায় না।
রেসকোর্স
ঘোড় প্রতিযোগিতায় মুখরিত থাকে ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব খ্যাত রেসকোর্স ময়দানেও নাকি তেনারা রয়েছে। রাতে এখানে ঘটে যায় অলৌকিক সব ঘটনা। কে বা কারা যেন ঘোড়া নিয়ে ছুটে বেড়ান এখানে। স্পষ্ট দেখতে পাওয়া ঘোড়া নিমিষেই বাতাসে মিলিয়ে যায়। ইতিহাসে রয়েছে একটি কাহিনি। রয়্যাল পরিবারের ব্রিটিশরা এখানে ঘোড় সওয়ার করতেন। একবার এক ব্রিটিশ জর্জ উইলিয়ামস তার বিখ্যাত সাদা ঘোড়া নিয়ে ময়দান চষিয়ে বেড়াতেন। অপরূপ সাদা ঘোড়াটির নাম ছিল পার্ল হোয়াইট। প্রচুর রেস আর ট্রফি জেতায়, পার্ল হোয়াইটকে তখনকার সময় এক নামেই চিনত। উইলিয়ামস ঘোড়াটিকে নিজের প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন।
পুতুলবাড়ি
হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত পুতুলবাড়ি এই শহরের আরও একটি ভৌতিক জায়গা। এই বাড়িতে কিছু অসাধারণ পুতুলের সংগ্রহ আছে। ধনী বাবুদের হাতে দীর্ঘদিন ধরে যৌন অত্যাচারিতা হতেন যে মহিলারা, তাঁদের আত্মা এখনও এই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় বলে অনেকের বিশ্বাস। বিশেষ করে এই বাড়ির ওপরের তলার বদনাম সবচেয়ে বেশি। চুরির রিনিরিনি আওয়াজ, নুপূরের ঝমঝম শব্দ, মিঠে হাসির সুর এখনও কানে বাজে প্রায়শই। আশেপাশের বাসিন্দারাও নাকি এই ঘটনার সাক্ষী।
হাওড়া ব্রিজ
১৯৪৩ সালে আম জনতার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল হাওড়া ব্রিজ। কলকাতার গর্ব এই ব্রিজ শুধু এর সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত নয়, এটিও কলকাতার ভুতুড়ে স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। বহু সময় বহু মানুষ হাওড়া ব্রিজ গঙ্গার জলে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ভোর ৩টে নাগাদে এখানে অনুশীলন করেন কুস্তিগীররা। তাঁরা অনেকেই জলের ওপর ভাসমান একটা হাত দেখেছেন। কেউ ডুবে যাচ্ছে ভেবে যিনি সাহায্য করতে গিয়েছেন, তিনি নিজেও আর ফিরে আসেননি। রাতের বেলা সাদা শাড়ি পরে এক মহিলাকেও ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছেন অনেকে।
রাইটার্স বিল্ডিং
একদা রাজ্যের মূল প্রশাসনিক ভবন। এই বাড়ির ফাঁকা ঘরগুলিই ছিল ভূতের বাসস্থান। রাত নামলেই তাঁদের হুড়োহুড়ি শুরু হয়। এমনকী এমনই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, কেউ ওই ফাঁকা ঘরগুলির আশেপাশের ঘরগুলিতে থেকে কাজই করতে পারতেন না। কেউ সাহসও করতেন না সন্ধ্যার পর ওই ঘরগুলির আশেপাশে একা যাওয়ার। মাঝরাতে কান্নার আওয়াজও পাওয়া যায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে এই তথ্য জানা গিয়েছে।
রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন
এই স্টেশনেই নাকি আড্ডা বসায় ভূতের দল। একেবারে গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয় রাত নামলেই। যাঁরাই শেষ মেট্রায় সওয়ারি হয়ে রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে নেমেছেন, তাঁরা সাক্ষী থেকেছেন ভুতুড়ে কাণ্ডের। রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনে নাকি যাত্রীরা বিভিন্ন ছায়ামূর্তিকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। যাত্রীদের ব্যাখ্যা, মেট্রোর লাইনে ঝাঁপ দিয়ে যাঁরা আত্মহত্যা করেন, তাঁদের অশীরীরি আত্মাই সন্ধ্যার পর এই স্টেশনে এসে মিলিত হন। শোনা যায়, কলকাতার অন্য মেট্রো স্টেশনগুলির তুলনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে এখানেই।