২০১৪ সালের ২৬ মে, দিনটি কোনও দিনই ভুলতে পারবেন না নরেন্দ্র দীমোদরদাস মোদী। সেদিনই রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনের প্রাঙ্গণে ইতিহাস রচনা কর করে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন তিনি। দেখতে দেখতে সাত বছর হয়ে গেল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের চালিকাশক্তি তাঁর হাতেই। সেই নরেন্দ্র মোদী আজ ৭০ পেরিয়ে ৭১ পড়লেন।
ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা ছুঁতেই মোদীর জন্মদিন সেলিব্রেট করা শুরু করে দেন বিজেপি কর্মীরা। কোথাও লাড্ডু বিলি করে আবার কোথাও বাজি ফাটিয়ে চলে প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন পালন। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জন্ম ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গুজরাতের ভাদনগরে। অনেকের মতে, এই রকম বলিষ্ঠ ও দৃঢ়চেতা প্রধানমন্ত্রী আগে দেখেনি দেশ। এর পাল্টা আবার অনেকে বলছেন এমন দেখনদাড়ি প্রধানমন্ত্রীকেও আগে কখনও দেখেনি ভারতবাসী। তবে নানান চড়াই-উৎরাই পেরোতে পেরোতেই ৭০ পেরিয়ে গেলেন মোদী।
২০০১ সালের ৭ অক্টোবর গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। এরপর টানা ১৩ বছর গুজরাতের মসনদে থেকে ২০১৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তারপরও ৭ বছর হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী মাসের ৭ তারিখ জনপ্রতিনিধি হিসেবে ২০ তম বর্ষপূর্তি প্রধানমন্ত্রী মোদীর। আর এই উপলক্ষে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে বিজেপি। সেপ্টেম্বর ১৭ প্রধানমন্ত্রী মোদীর জন্মদিন। এদিন থেকে শুরু করে আগামী ৭ অক্টোবর পর্যন্ত 'সেবা ও সমর্পণ অভিযান' চালাবে বিজেপি।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বিজেপি ওনার জন্মদিনের দিন সেবা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। আর জন্মদিনের দিন থেকে এক সপ্তাহের জন্য দেশজুড়ে মানবসেবার আয়োজন করা হয়। কিন্তু এবার বিজেপি এই আয়োজন ৭ দিন থেকে বাড়িয়ে ২০ দিন করেছে।
মোদীর কৈশরের অনেকটা সময় কেটেছিল রেলস্টেশনে চা বিক্রি করে। চাওয়ালা থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গল্পে রয়েছে নানা চড়াই উৎরাই। চলুন তাঁর জন্মদিনে জেনে নেওয়া যাক প্রধানমন্ত্রীর জীবনের নানা অজানা গল্প।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছোটবেলা ছিল একেবারে সাধারণ। ছোট বেলায় ছিলেন চা বিক্রেতা। সেই চা বিক্রেতা থেকে সন্ন্যাস জীবন, হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের গুরুত্বপূর্ণ কর্মী তারপর সেখান থেকে ক্রমাগত রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠা। এবারের জন্মদিনের আগেই এসেছে সুখবর। বিশ্ব খ্যাত ‘TIME Magazine” ২০২১-র বিশ্বের সবথেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে সূচিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জায়গা করে নিয়েছেন। তবে এইবার প্রথম নয় এই নিয়ে পরপর তিনবার টাইম ম্যাগাজিনের প্রভাবশালীদের তালিকায় নাম উঠল মোদীর।
সাত বছর মসনদে থাকার পরেও জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাঁটা পড়েনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জো বাইডেন, বরিস জনসন, অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, জাস্টিন ট্রুডোর মত প্রথম সারির নেতাদের পিছনে ফেলে দিয়েছেন প্রধাননন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দ্য মর্নিং কনসাল্টে’র সমীক্ষায় ১৩ জন বিশ্বনেতার মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বনেতাদের অনুমোদেনর তালিকায় (Globel Leader Approval Rating) ৭০ শতাংশের সমর্থনই রয়েছে তাঁর দিকে।
তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসহ নানা কাজে গত অন্তত দুই দশক ধরে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জীবনের এক দুঃসাহসিক যাত্রার মধ্য দিয়ে তিনি বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এসবের বাইরেও তার রয়েছে আরো অনেক অজানা কাহিনি। চলুন প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে সেই গল্পই ফের একবার ফিরে দেখা যাক।
১৯৫০ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর জন্ম। তার পিতার নাম দামোদরদাস মুলচান্দ ও মায়ের নাম হীরাবেন। ৬ সন্তানের মধ্যে মোদী ছিলেন তৃতীয়। মুদি ব্যবসায়ী পরিবারেই মোদীর জন্ম। শৈশব থেকেই মোদী চায়ের স্টলে তার বাবাকে সাহায্য করতেন।
বেদনগর রেলস্টেশনে যাত্রীদের কাছে হেঁটে হেঁটে চা বেচতেন মোদী। চা বিক্রি ছিলো মোদীর পরিবারের আদি পেশা। জানা যায় আহমেদাবাদে স্টেট ট্র্যান্সপোর্ট অফিসে নরেন্দ্র মোদী তার ভাইয়ের সঙ্গে চা বিক্রি করতেন। তখনই তিনি কঠোর সংগ্রাম এবং স্থির ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হবার সত্যিকার অর্থ অনুধাবন করেছিলেন।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। বয়স তখন তার মাত্র ১৫ বছর। ১৯৬৭ সালে গুজরাতে যখন ভয়াবহ বন্যা হয়, তখন ১৭ বছরের মোদী স্বেচ্ছায় বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করেন।
ধর্মীয় সাধনাও তাকে শৈশব থেকে ব্যাপকভাবে মুগ্ধতা দিয়েছিলো। বেশ অল্প বয়সেই তিনি সন্ন্যাসব্রত পালনের জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে সাধুদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত হিমালয়ে গিয়ে ২ বছর সন্ন্যাস জীবন কাটান তিনি।
স্বামী বিবেকানন্দকে নিজের আইডল বা আদর্শ মনে করেন নরেন্দ্র মোদী। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফিরে দেখলে দেখা যাবে স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত কিশোর মোদী সেই সময় গুজরাতের রাজকোট শাখায় মিশনের আশ্রমে যেতেন। সেই সময় মোদী সন্ন্যাস নেবেন বলেও ঠিক করেন। কিন্তু সেই সময় ১৯৬৬ সালে ওই আশ্রমের রাজকোট শাখার প্রধান, যিনি পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের পঞ্চদশ সভাপতি হয়েছিলেন সেই স্বামী আত্মস্থানন্দ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সন্ন্যাস তাঁর জন্যে নয়। তিনিই বলেন, তাঁর উচিত জনগণের মধ্যে থেকে মানুষের জন্যে কাজ করা, নির্জনে থেকে নয়। সেই দিনগুলিতে, মোদী নিয়মিত স্বামী আত্মস্থানন্দজি মহারাজের সঙ্গে দেখা করতেন এবং তাঁর কাছে আধ্যাত্মিক পাঠ নিতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যদিও মোদী কিছুটা সময় সেখানে কাটিয়ে ফিরে এসেছিলেন, তবে স্বামী আত্মস্থানন্দ এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ ছিল। মোদী যখনই কলকাতায় যেতেন, এমনকি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনও সময় পেলেই তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে ঘুরে যেতেন।
পরিচিতজনদের থেকে জানা যায় স্কুলে মোদী ছিলেন আর দশটা ছাত্রের মতোই। কিন্তু ওই বয়স থেকেই তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, টানা চার দশক ধরে ‘নবরাত্রি’র সময় উপবাস করছেন তিনি। স্কুলে পড়ার সময়ই মোদীর আধ্যাত্মিক বিষয়টি অনেকের নজরে আসে। তিনি প্রায়ই পরিবার থেকে বেরিয়ে দূরে নির্জন স্থানে গিয়ে উপাসনা করতেন। কখনো তাঁকে দেখা যেত হিমালয়ে গিয়ে উপাসনা করতে। ১৯৬৭ সালে চূড়ান্তভাবে পরিবারের সঙ্গ ত্যাগ করেন তিনি। ১৯৭১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আরএসএসে যোগ দেন মোদী।
সন্ন্যাস জীবন কাটানোর সময় নরেন্দ্র মোদীর মাত্র দুটি পোশাক ছিল। কিন্তু, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জনসমক্ষ এখন নিজেকে উপস্থাপনের ব্যাপারে বেশ সজাগ। ইস্ত্রি করা পরিপাটি পোশাক পরতে পছন্দ করেন তিনি। অন্য রাজনীতিবিদদের চেয়ে নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন ও মোদী ব্র্যান্ডকে রূপ দেয়ার ব্যাপারে বেশ সচেতন তিনি।
খুব কাজ পাগল মোদি। দিন রাত মিলিয়ে তিনি নাকি মাত্র ৩ ঘণ্টা ঘুমান। সকাল ৭টায় তিনি অফিসে ঢোকেন, রাত ১০টা বা আরও রাত পর্যন্ত সেখানে কাজ করে তবে বাড়ি ফেরেন।
নরেন্দ্র মোদী বেশ রক্ষণশীলও বটে। তবে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বিষয়ে একেবারে আধুনিক। প্রতিদিনই ইন্টারনেটে নিজের খবরগুলো দেখে নেন তিনি। ফেসবুক ও আর ট্যুইটার ব্যবহারেও মোদী খুবই স্বচ্ছন্দ।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নিজের বিয়ের ব্যাপারে কোনোদিন মুখ খোলেননি মোদী। এর আগে ৪ বার নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিলেও, আবেদনপত্রে স্ত্রীর কলামটি বরাবরই ফাঁকা রেখেছিলেন। ১৩ বছর বয়সে যশোদাবেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। তবে ব্যাচেলর বা কুমার জীবন কাটানোর প্রতি তীব্র ঝোঁক থাকায় যশোদাবেনের সঙ্গে বিয়ে কখনও মেনে নেননি মোদী। এক সময়ে যশোদাবেনও একাকী থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
মহিলাদের কাছেও মোদী বেশ জনপ্রিয়। মোদীর নির্বাচনী এলাকায় মহিলারা তাকে দেবতা হিসেবে জ্ঞান করেন। যে কারণে দেখা গেছে শেষ লোকসভা নির্বাচনে নারীদের উপস্থিতি ছিলো আগেরে যেকোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি। ধারণা করা হয়, ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে শশী ঠারুরের পর নরেন্দ্র মোদীই নারীদের কাছে বেশি জনপ্রিয়।
জীবনের বড় সময় কেটেছে তার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ কিংবা আরএসএস এর সঙ্গে। ১৯৭১ সালে আরএসএসে যোগি দেওয়ার কিছুদিন পরই সংগঠনটির দিল্লির কার্যালয়ে যান তিনি। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা করার জারির পর রাজনৈতিক বিরোধীদের জেলে ভরতে থাকেন। সে সময় দিল্লি থেকে গুজরাতে ফেরেন মোদী। সেই সময় সুযোগ পেলেই ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার করতেন বিভিন্ন পুস্তিকা।
রাজনীতিতে জড়ানোর পরও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক হন মোদী। পরে গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৭-৮৮ সময়ে তিনি বিজেপির গুজরাত ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন। মূলত, এর মধ্য দিয়েই মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি।
দলীয় কর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জেরে ধীরে ধীরে বিজেপিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করেন মোদী। ১৯৯০ সালে তিনি আডভানির নেতৃত্বে সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত রথযাত্রায় বড় ভূমিকায় ছিলেন। ১৯৯১ সালে তৎকালীন দলীয় প্রধান মুরলি মনোহর যোশির নেতৃত্বে কন্যাকুমারী-শ্রীনগর একতা যাত্রারও অন্যতম সংগঠক ছিলেন মোদী। গুজরাতের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। একটানা ২ হাজার ৬৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।
নরেন্দ্র মোদীর রসিকতাবোধও অসাধারণ। বিরোধী দল মোদীর এই গুণটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও, তার বাক্যের রসায়নগুলোর মধ্যে তীক্ষ্ণ মেধা ও বুদ্ধির ছটা লক্ষণীয়। কবি হিসেবেও মোদীর নাম ও খ্যাতি রয়েছে। লিখতে ভালোবাসেন, সমাবেশে যে বক্তৃতাগুলো দেন, তার একটি বড় অংশ তার নিজেরই লেখা।
প্রধানমন্ত্রী হিন্দিতেই বেশি দক্ষ। তবে ভারতের অন্যান্য শীর্ষ রাজনীতিকরা যেমন ইংরেজি বলেন, মোদি ইংরেজিতে একদমই কথা বলেন না।
কবি হিসেবেও মোদীর নাম ও খ্যাতি রয়েছে। লিখতে ভালোবাসেন, সমাবেশে যে বক্তৃতাগুলো দেন, তার একটি বড় অংশ তার নিজেরই লেখা।
নিরামিষাশী মোদী নিঃসঙ্গ থাকতে ভালোবাসেন ও অন্তর্মুখী স্বভাবের। জানা যায় তাঁর কোনো ঘনিষ্ট বন্ধু নেই। গুজরাতের স্থানীয় খাস্তার মতো মচমচে এক ধরনের রুটি এবং গুজরাতি খিচুড়ি তার প্রিয় খাবার।