যাদবপুর-সহ দক্ষিণ কলকাতার প্রায় সকলেই সুলেখার মোড় চেনেন, নাম শুনেছেন। কেন এই এলাকার নাম ‘সুলেখার মোড়’ বা ‘সুলেখা’ হল তা-ও জানেন। একটা সময় এখানে সুলেখা কালি তৈরির কারখানা ছিল। তবে ছিল শব্দটা আর বোধহয় ব্যবহার করা ঠিক হবে না। কারণ, ভোল বদলে আকর্ষণীয় মোড়কে বাঙালির ঘরে ফিরছে বাংলার ঐতিহ্যের সুলেখা কালি!
দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। বিদেশী জিনিস বর্জন করে স্বদেশি জিনিসের ব্যবহারে জোর দিয়ে আন্দোলন তখন জোর কদমে চলছে দেশজুড়ে। সে সময় পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর স্বাধীনতা সংগ্রামী ননীগোপাল মৈত্র তাঁর ভাই শঙ্করাচার্য মৈত্রের সঙ্গে স্বদেশি কালি তৈরির উদ্যোগ নেন। দুই ভাইয়ের উদ্যোগে বিদেশী কলমের কালি বর্জন করে স্বদেশি কালি তৈরির লক্ষ্যেই ১৯৩৪ সালে যাত্রা শুরু হয় সুলেখা কালির। বাংলা তো বটেই, একটা সময় দেশজুড়ে সুলেখা কালির একচেটিয়া ব্যবসা শুরু হয়ে যায়। সে সময় এই কালির চাহিদা এতটাই বাড়ে যে বাংলার বাইরেও সুলেখা কালির উৎপাদন শুরু হয়। এ কালি দিয়ে সুন্দর লেখা যায়। তাই এর নাম দেওয়া হয় ‘সু’ লেখা।
তবে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে যাদবপুরের ‘সুলেখার মোড়’ নামকরণের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ছাড়া আর তেমন কোনও তথ্য নেই। বাংলার স্বদেশী যুগের সুলেখা কালির ঐতিহ্যের সম্পর্কে কী করেই বা জানবে এই প্রজন্মের পড়ুয়ারা! তাঁরা তো আধুনিক বল পেনে লিখে অভ্যস্ত, ঝর্না কলম বা ফাউন্টেন পেন তাঁরা দেখেছে বটে, তবে তা ব্যবহার করেনি কখনও। উপহার হিসাবে হাতে এলেও ওই দু’-একদিন একটু নেড়েচেড়ে তুলে রাখা। ফলে ঝর্না কলমের স্বদেশী সঙ্গী সুলেখা কালির সম্পর্কে তাঁরা জানে না সে ভাবে।
কিন্তু অতীতে বাংলার বহু সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে এই কালির আঁচড়ে। সুলেখা কালির কথা বাঙালি পড়েছে সত্যজিত রায়ের কলমেও। সুলেখা কালির দোয়াত ধরা পড়েছে তাঁর তৈরি সিনেমার কোনও দৃশ্যে। কিন্তু নয়ের দশকের গোড়ার দিক থেকে আধুনিক বল পেনের সঙ্গে লড়াইয়ে থমকে গিয়েছিল সুলেখা কালির পথ চলা। ১৯৮৮ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যাদবপুরের সুলেখা কালি তৈরির কারখানা।
দীর্ঘ ১৮ বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৬ সালে ফের চালু হয় সুলেখার উৎপাদন। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সংস্থার চরিত্রে বদলে বল পেন, পেন্সিল, ইরেজার, সাবান, ফিনাইল, ন্যাপথালিনের পাশাপাশি শুরু হয় সৌর লণ্ঠন তৈরি ও বিপনন। ঐতিহ্য নয়, অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াই শুরু হয় তখন থেকে।
ছবিতে ১৯৫৯ সালে সুলেখার কারখানায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়।
একটা সময় যখন ফের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে ‘সুলেখা’ তখনই ফের করোনা মহামারী আর লকডাউনে ফের কারখানা বন্ধ হতে বসল। ওই সময়ে সংস্থা ও কর্মীদের বাঁচাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, পিপিই কিট, হ্যান্ড ওয়াশ তৈরি করা শুরু করে সুলেখা। কিন্তু ২০২০ সালের অক্টোবরে পুজোর সময় মহামারী আর লকডাউনের ধাক্কা পেরিয়ে ঝর্না কলমের কালিতে ভর করেই নিজেদের ঐতিহ্যের সঙ্গে জুড়তে উদ্যোগী হল সুলেখা। হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, হ্যান্ড ওয়াশের উপর সাময়িক ভাবে নির্ভর করতে হলেও ফের সংস্থার মূল উৎপাদিত পণ্য হিসাবে ফেরে ঝর্না কলমের কালি। ভোল বদলে আকর্ষণীয় মোড়কে ফের বাঙালির ঘরে ঘরে ফিরতে ঝাঁপিয়েছে সুলেখা কালি। একশো টাকায় ফাউন্টেন পেন-সহ কালির দোয়াতে মিলছে সুলেখার ‘হাতেখড়ি’। এছাড়াও একাধিক আকর্ষণীয় মোড়কে নীল, কালো, লাল, সবুজ রঙের ফাউন্টেন পেনের কালির সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছে সুলেখা।
সুলেখা কালির নতুন মোড়ক বেশ আকর্ষণীয় হলেও বাজারে যেখানে ৩০-৩৫ টাকায় ফাউন্টেন পেনের কালি পাওয়া যায়, লোকে সেখানে কেন ১০০ টাকা বা ২০০ টাকা দিয়ে সুলেখার কালি কিনবেন! এ প্রসঙ্গে সুলেখার বর্তমান ডিরেক্টর কৌশিক মৈত্র বলেন, “আধুনিক ফিল্টার পদ্ধতিতে তৈরি এই কালি গুণমানে বাজারের অন্যান্য কালির তুলনায় কতটা আলাদা, তা ব্যবহার করলেই বুঝবেন। এই কালি দীর্ঘক্ষণ জমাট বাঁধে না। পেনের ঢাকনা খোলা থাকলেও চট করে কালি শুকিয়ে যায় না। যে কোনও ভাল কালির এটাই স্বাভাবিক বৈশিষ্ট।” তবে অদূর ভবিষ্যতে বাজার ধরতে দাম কমানোর ভাবনাও রয়েছে সংস্থার, জানান কৌশিকবাবু। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার বাড়াতে আর ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ বল পেনের ব্যবহারে বাড়তে থাকা প্লাস্টিক দূষণ কমাতে নতুন ভাবে লড়াই শুরু করেছে সুলেখা। বর্তমান প্রজন্মকে পাশে নিয়ে ঐতিহ্য আর বাঙালির আবেগকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রত্যয়ী সংস্থা।
সত্যজিৎ রায়ের জয়বাবা ফেলুনাথ ছবিতে জটায়ুর (লামমোহন গাঙ্গুলি) পাশে সুলেখা কালির দোয়াত।