
ইতিহাস ও ঐতিহ্যে মোড়া শহরগুলির মধ্যে একটি অন্যতম নাম হল কৃষ্ণনগর। এই শহরের প্রতিটি অলিগলিতে এখনও ছড়িয়ে রয়েছে টুকরো টুকরো ইতিহাস। তবে সবচেয়ে বেশি ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে। দুর্গা কিংবা জগদ্ধাত্রী পুজোর পাশাপাশি রাজবাড়ির বিশেষত্ব হল রাজবাড়ির ময়দানে বসা নদিয়া জেলার সর্ববৃহৎ মেলা, বারোদোল মেলা। বহু প্রাচীন এই মেলা শুরু হল আজ অর্থাত্ ১ এপ্রিল থেকে। চলবে একমাস।
রঙিন আলোতে মেতে ওঠে গোটা রাজবাড়ি ও রাজবাড়ি প্রাঙ্গন
নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামেই জায়গাটির নাম হয় কৃষ্ণনগর। এককালে বাংলা তথা ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমার তিথির পরবর্তী একাদশী তিথিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের দ্বিতীয় একাদশী তিথিতে শুরু হয় বারোদোল মেলা। পরবর্তী একমাস ধরে রাজবাড়ির ময়দান প্রাঙ্গন জুড়ে চলে এই মেলা। এই বছর আজ বিকাল ৪টে থেকে শুরু হবে এই মেলা চলবে রাত ১১ টা পর্যন্ত। রকমারি জিনিস, নানা খাবারের সম্ভার ও আট থেকে আশির আনন্দ ও রঙিন আলোতে মেতে ওঠে গোটা রাজবাড়ি ও রাজবাড়ি প্রাঙ্গন। ফার্নিচার থেকে হরেক মাল, গরমে শরীর ঠান্ডা করা লস্যি থেকে ঘুগনি, মোমো, ফুচকা ও অন্যান্য নানা ধরনের জিনিসে ভরে ওঠে মেলা।
কেন মেলার নাম বারোদোল?
একমাস ধরে চলা এই বারোদোল মেলার প্রধান বিশেষত্ব হল রাজবাড়িতে মেলার পাশাপাশি রাজবাড়ির প্রাঙ্গনে প্রথম তিনদিন ধরে ভগবান কৃষ্ণকে পুজা করার রীতি। এই রীতি অনুযায়ী মেলা শুরুর প্রথম তিনদিন ব্যাপি কৃষ্ণের নানা রূপকে পুজো করা হয়। প্রথম দিন – কৃষ্ণকে গোপাল রূপে, দ্বিতীয় দিন – গোপীনাথ রূপে, আর সর্বশেষ তৃতীয় দিনে- রাধাকৃষ্ণ রূপে পুজো করা হয়। প্রথম দিন গোপাল রূপে কৃষ্ণকে পুজোর সময় রাজবেশ বা রাজার সাজে সাজানো হয়। পরানো হয় বহু অলংকার। দ্বিতীয় দিনে, অর্থাৎ গোপীনাথ রূপে কৃষ্ণকে পূজোর সময় ফুলের সাজ পড়ানো হয়। তখন রাজবেশের অলংকার খুলে কৃষ্ণকে ফুলের অলংকার পরানো হয়। তৃতীয় ও সর্বশেষ দিন রাধাকৃষ্ণ রূপে পুজো করার সময় পরানো হয় রাখাল বেশে। এই দিনে কৃষ্ণের কাছে খিচুড়ি ভোগ প্রসাদ দেওয়া হয়। সেই প্রসাদ পেতে বহু মানুষ জমা হয় রাজবাড়ির প্রাঙ্গনে। এছাড়াও বাকি ২৭ দিন বহু মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে, বছরের এই ৩০ দিন হাসি আনন্দে ভরে ওঠে রাজবাড়ির মাঠ। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকে বয়ে আসা এই ঐতিহ্যের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয় গোটা কৃষ্ণনগর তথা শহরবাসী।
কৃষ্ণের কোন ১২ রূপের পুজো হয়?
আনুমানিক ১৭৬৪ সালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই মেলা চালু করেন। কথিত আছে, রাজবাড়ির কুলদেবতা বড় নারায়ণচন্দ্রের মূর্তির সঙ্গে কৃষ্ণের বারোটি রূপের পুজো হয়। তাই এই মেলার নাম বারোদোল মেলা। গোপাল, রাধাকৃষ্ণ , বলরাম, শ্রী গোপীমোহন, লক্ষ্মীকান্ত, ছোটো নারায়ণ, ব্রহ্মদেব, গড়ের গোপাল, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ, নদিয়ার গোপাল, তেহট্টের কৃষ্ণরায়, কৃষ্ণচন্দ্র, শ্রীগোবিন্দদেব, মদন গোপাল এই বারোটি রূপ পুজিত হয়।
শোনা যায়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দুজন রানি ছিলেন। কথা ছিল , রাজা দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে রাঘব রায় নির্মিত উলায় (বর্তমানের বীরনগরে) মেলা দেখতে যাবেন। কিন্তু রাজকার্য থাকায় রাজা তাঁর কথা রাখতে পারেননি। তাই রাজা সিদ্ধান্ত নেন, রাজপ্রাঙ্গনে একটি মেলা আয়োজন করবেন। এরপরেই রাজা প্রবর্তন করেন বারোদোল মেলা। যার ফলে রাজমহিষী ও অন্তপুরের সকল নারী রাজবাড়ি থেকেই এই মেলা দেখতে পারতেন।
সেই ঐতিহ্যকে বজায় রেখে আজও রাজবাড়ি আলো করে বসে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রবর্তিত মেলা “কৃষ্ণনগর বারোদোল মেলা”।
প্রতিবেদক: ঋত্বিকা ঘোষ