Adenovirus: মহামারী রুখতে করোনার টিকায় (Covid-19 Vaccine) যে অ্যাডেনো ভাইরাসকে (Adenovirus) ‘ভেক্টর’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল বর্তমানে সেই ভাইরাসই এ রাজ্যে একের পর এক শিশু মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে অ্যাডেনো ভাইরাস করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহাস্য করেছিল, সেটাই এখন ‘প্রাণঘাতী’ হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, এমন ঘাতক ভাইরাসকে কেন করোনার টিকায় ব্যবহার করা হল? টিকা নেওয়ার ফলেই কি মহামারীর ব্যাপকতা কমিয়ে দেওয়া অ্যাডেনো ভাইরাস এখন এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে? উত্তর দিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক-ভাইরোলজিস্টরা...
আরও পড়ুন: রাজ্যে অ্যাডেনো ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে জারি অ্যাডভাইজারি
এই ভাইরাসের কোনও টিকা বা নির্দিষ্ট কোনও ওষুধও নেই:
অ্যাডেনো ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ (মেডিসিন) চিকিৎসক ডাঃ অরিন্দম বিশ্বাস (Dr Arindam Biswas) বলেন, “কোভিডের টিকায় ‘ভেক্টর ভাইরাস’ অ্যাডেনোর প্রয়োগেই বর্তমানে এই ভাইরাসের বাড়-বাড়ন্ত, এই ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ, এই ভাইরাসে বেশিরভাগ আক্রান্তই পাঁচ বছর বা তার কম বয়সী শিশু। আর শিশুদের কোভিডের টিকা দেওয়া হয়নি। তাই কোভিড ভ্যাক্সিনের সঙ্গে অ্যাডেনো ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির কোনও সম্পর্ক রয়েছে বলে আমি মনে করি না। বরং, শারীরিক দুর্বলতা, দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা, রোগের চিকিৎসা শুরুর ক্ষেত্রে বিলম্ব এবং যথাযথ চিকিৎসার অভাবেই সমস্যা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এই ভাইরাসের কোনও টিকা নেই, নির্দিষ্ট কোনও ওষুধও নেই। আক্রান্তের শারীরিক অবস্থা, সমস্যার উপর ভিত্তি করে এর চিকিৎসা করা হচ্ছে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করা গেলে অ্যাডেনো-আক্রান্তের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।”
কোভিড-পরবর্তী সময়ে হাইপার ইনফ্লেমেটরি ইমিউন রেসপন্স’জনিত অসুখ বাড়ছে:
করোনা টিকার ‘ভেক্টর ভাইরাস’ অ্যাডেনোর প্রকোপ বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট ডাঃ অমিতাভ নন্দী (Dr Amitabha Nandi) বলেন, “আমাদের ছোটবেলা থেকেই এই অ্যাডেনো ভাইরাসের সঙ্গে ছোটখাটো লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে আমরা বসবাস করছি। টনসিলাইটিস বা টনসিলে সংক্রমণ, কনজাংটিভাইটিস, জ্বর-সর্দি-কাশির পিছনে রয়েছে অ্যাডিনো ভাইরাসেরই অন্য স্ট্রেইন। কোভিড-পরবর্তী সময়ে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও তার প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। তাই ইদানীং ডেঙ্গি-জ্বর-সর্দি-কাশি সহ একাধিক রোগের প্রকোপ বেড়েছে। একই কারণেই বেড়েছে অ্যাডেনো ভাইরাসের প্রকোপও। যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বা এর টিকা নিয়েছেন, আমরা দেখেছি তাঁদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। এঁদের মধ্যে HLH বা MASS-এর মতো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এ সবই হয়েছে ‘হাইপার ইনফ্লেমেটরি ইমিউন রেসপন্স’জনিত অসুখ। তবে কোভিডের টিকায় অ্যাডেনোর প্রয়োগের সঙ্গে বর্তমানে এই ভাইরাসের বৃদ্ধির কোনও সম্পর্ক রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।”
টিকায় ব্যবহৃত অ্যাডেনো ভাইরাসের প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা:
করোনা টিকার ‘ভেক্টর ভাইরাস’ হিসাবে অ্যাডেনোর প্রয়োগ প্রসঙ্গে মোহালির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর (IISER) অধ্যাপক, ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ডঃ ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় (Dr Indranil Banerjee) বলেন, “করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কোভিড ভ্যাক্সিনের ‘ভেক্টর ভাইরাস’ হিসেবে অ্যাডেনোর প্রয়োগ করা হয়েছে। কোভিড ভ্যাক্সিনের ‘ভেক্টর’ হিসেবে অ্যাডেনো ভাইরাসের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে শিম্পাঞ্জির শরীরে রোগ ছড়াতে পারে, এমন অ্যাডিনো ভাইরাস প্রয়োগ করা হয়েছিল। একাধিক পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়ার পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তৈরি অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকায় ‘ভেক্টর ভাইরাস’ হিসেবে অ্যাডেনো ভাইরাসের প্রয়োগ করা হয়। পরবর্তিকালে অবশ্য স্পুটনিক ভি সহ একাধিক টিকা তৈরির ক্ষেত্রে সেই সমস্যা এড়াতে টিকা তৈরির ক্ষেত্রে। এভাবে তৈরি হয় অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড। পরবর্তিকালে অবশ্য স্পুটনিক ভি সহ একাধিক টিকা তৈরির ক্ষেত্রে ‘ভেক্টর ভাইরাস’ হিসেবে অ্যাডেনো ভাইরাসের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে অ্যাডেনো ভাইরাসের ঘাতক-ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে কোভিডের টিকায় এই ভাইরাসকে ‘ভেক্টর’ হিসাবে প্রয়োগের কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ, এক দেশের শিশুদের এই টিকা দেওয়া হয়নি। আর ইদানীং অধিকাংশ অ্যাডেনো-আক্রান্তই শিশু। দুই, টিকায় ব্যবহৃত অ্যাডেনো ভাইরাসের প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা।”
কীভাবে ইদানীং অ্যাডেনো ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেল?
এই প্রশ্নের উত্তরে ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অ্যাডেনো ভাইরাসের ৮৮টি ভ্যারিয়েন্ট আছে। সম্প্রতি অ্যাডেনো ভাইরাসে আক্রান্ত বা মৃতের শরীর থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে তার ‘ভাইরাল জেনম সিক্যুয়েন্সিং’ করার পর জানা সম্ভব হবে অ্যাডেনো ভাইরাসের কোন ভ্যারিয়েন্ট এখন প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। অ্যাডেনো ভাইরাসের পুরনো কোনও ভ্যারিয়েন্ট অথবা ভাইরাসের মিউটেশনে তৈরি নতুন কোনও ভ্যারিয়েন্ট এই শিশুমৃত্যুর জন্য দায়ি, তা জানার জন্য ‘ভাইরাল জেনম সিক্যুয়েন্সিং’ প্রয়োজন। প্রত্যেক রাজ্যেই এই পরীক্ষার যথাযথ পরিকাঠামো রয়েছে। সরকার উদ্যোগী হয়ে এই পরীক্ষা ও গবেষণা শুরু করলে পরবর্তিতে এর চিকিৎসা এবং আক্রান্তের প্রাণ বাঁচানো আরও সহজ হয়ে যাবে।”
গ্রাফিক্স: শুভঙ্কর মিত্র।