বারাণসীর জ্ঞানব্যাপী মসজিদে পুজোর অধিকার চেয়ে মামলা করেছিলেন ৫ মহিলা। সেই মামলায় স্থানীয় আদালত কী রায় দেয় তার দিকেই তাকিয়ে ছিল গোটা দেশ। হঠাৎ করেই জ্ঞানব্যাপী মসজিদ কমপ্লেক্সের ওজুখানায় একটি 'শিবলিঙ্গ'-র সন্ধান পাওয়ার দাবি করে হিন্দু পক্ষ। তারিখটি ছিল ১৬ মে, ২০২২। হিন্দু পক্ষের তরফে হর হর মহাদেব স্লোগান দিয়ে 'বাবা মিল গেয়ে' বলা হয়। এর বিরোধিতা করে মুসলিম পক্ষ। তাদের তরফে বলা হয়, ওটা 'শিবলিঙ্গ' নয়, আসলে ঝরনা।
এভাবেই নতুন করে মাথা চাড়া দেয় জ্ঞানব্যাপী বিতর্ক। দুই পক্ষের দাবির ফলে, মুঘল আমল, ঔরঙ্গজেব, কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের ইতিহাস, নন্দী মূর্তি, শৃঙ্গার গৌরী, জ্ঞানব্যাপীর দেওয়ালে ধর্মীয় চিহ্ন ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। আদালতে যায় মামলা।
হিন্দুপক্ষের 'শিবলিঙ্গ' পাওয়ার দাবির পর বারাণসী আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করা হয়। যার জেরে আদালতের তরফে ওজুখানাকে সুরক্ষিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। বলা হয়, কেউ যেন সেখানে আর প্রবেশ না করে। এদিকে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ট্রাস্ট দাবি করে, আদালতের সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত জ্ঞানব্যাপী মসজিদে পাওয়া 'শিবলিঙ্গ'-টি যেন তাদের হস্তান্তর করা হয়। তবে মুসলিম পক্ষ দাবি করে, ওটি 'শিবলিঙ্গ' নয়। আসলে একটা ঝরনা। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত তা ব্যবহৃত হয়েছে বলেও দাবি করা হয়।
আরও পড়ুন : Netaji Note Controversy: এক লক্ষ টাকার নোটে ছিল নেতাজির ছবি! জানুন
'শিবলিঙ্গ'-র দাবি নিয়ে নিম্ন আদালত-হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট, এই তিন জায়গাতেই বিতর্ক দানা বাঁধে। রাজনৈতিক উত্তাপও বাড়তে থাকে। দেশের নানা প্রান্তে জ্ঞানব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
ইতিহাস কী বলে?
কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সংলগ্ন জ্ঞানব্যাপী মসজিদের বিষয়টি ১৯৯১ সাল থেকে আদালতে রয়েছে। ইংরেজ আমলেও এই মামলা আদালতে গিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের ইতিহাস বহু শতাব্দী প্রাচীন। ভারতের ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে, বিশ্বেশ্বর বা বিশ্বনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ সবচেয়ে বিখ্যাত। কারণ, এটি বিশ্বের অন্যতম পবিত্র মন্দির হিসেবে বিবেচিত হয়। কাশী বিশ্বনাথের প্রাচীন মন্দিরের প্রথম উল্লেখ পুরাণে পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিকদের একাংশের মতে, মন্দিরটি মহম্মদ ঘোরি প্রথম ভাঙেন। ১১৯৪ সালে তা ফের নির্মিত হয়। কিন্তু, ১৪৪৭ সালে জৌনপুরের সুলতান আবারও এই মন্দির ভেঙে ফেলেন। ১৫৮৫ সালে আকবরের সেনাপতি রাজা মান সিং এবং অর্থমন্ত্রী রাজা টোডর মল পুরোনো জায়গায় শেষবারের মতো এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের আমলে ফের তা ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। যা জ্ঞানব্যাপী বা আলমগীর মসজিদ নামে পরিচিত। কাশী বিশ্বনাথের যে মন্দির এখন দেখা যায়, সেটি ১৭৭৭ সালে ইন্দোরের মারাঠা শাসক রানী অহিল্যা বাই হোলকার নির্মাণ করেছিলেন।
কৈলাশনাথ কাটজুর বইয়ে কী লেখা আছে?
স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বিখ্যাত আইনজীবী কৈলাশনাথ কাটজু ৩০-এর দশকে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির পরিচালনা সংক্রান্ত একটি মামলা করেছিলেন। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, 'বারাণসীর মন্দিরগুলি সারা বিশ্বে বিখ্যাত। হিন্দু ধর্মের প্রায় সব দেবতার ভক্তরা বারাণসী যান। সব দেবতার মূর্তি সেখানে রয়েছে। কিন্তু বারাণসী হল ভগবান শিবের অধ্যুষিত ভূমি। যিনি কাশী বিশ্বনাথের নামে পূজিত হন। যাকে কাশীর পৃষ্ঠপোষক দেবতা বলেও মনে করা হয়। বর্তমানে যে স্বর্ণমন্দির রয়েছে সেটি আকারে বিশাল নয়। ইন্দোরের মহারানি অহল্যাবাই এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তার ৫০ বছর পর পঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিং গম্বুজটিতে সোনার প্রলেপ দিয়েছিলেন। তাই এখন একে স্বর্ণ মন্দিরও বলা হয়।
আরও পড়ুন : Bodybuilder Lipika Debnath: এইভাবে এক্সারসাইজ করে জাতীয়স্তরে স্থান পেয়েছেন মালদার নার্স লিপিকা দেবনাথ
কৈলাশনাথ কাটজু আরও লিখেছিলেন, 'এই মন্দিরের কাছেই ছিল পুরোনো মন্দিরের জায়গা। আমার পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত, আমি ১৮১০ সালের এই শ্রেণীর জমির কাগজপত্র, চিঠি এবং আদেশ দেখেছি। এই জমি ঘিরে অনেকবার হিংসা হয়েছে। দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলাও হয়েছে। এই বর্গাকার জমিতে প্রাচীনকালে কাশী বিশ্বনাথের বিশাল মন্দির তৈরি হয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, মুসলিম শাসকদের নির্দেশে বহুবার এই মন্দিরটি ভেঙে ফেলা হয় এবং হিন্দুরা বারবার নির্মাণ করে।
বইটিতে কাটজু আরও লিখেছেন- 'দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে, বারাণসীর জেলা আদালত পুরো বিষয়টি দেখছে। শেষবার পুরানো জায়গায় মন্দির বানানো হয়েছিল আকবরের আমলে। ১৬৬০ সালের দিকে, ঔরঙ্গজেবের আদেশে, আবার তা ভেঙে ফেলা হয়। সেবার মন্দিরের জায়গায় মসজিদ তৈরি করা হয়। মসজিদের কাছেই রয়েছে জ্ঞানবাপীর কুয়ো। মন্দির ধ্বংস করার সময় শিবলিঙ্গকে বাঁচাতে সেই কুয়োতে পুরোহিতরা শিবের মূর্তি ফেলে দিয়েছিলেন।'
ওই বইতে এক জায়গায় লেখা আছে, 'অকাট্য ঐতিহাসিক উপাদানের উপর নির্ভর করে বারাণসীর বিচারক সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, মথুরার বিখ্যাত কেশবদেব মন্দির এবং বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ১৬৬০ সালের দিকে।'
প্রসঙ্গত, ইতিহাসবিদরা বলেন, ঔরঙ্গজেবকে একজন কট্টর শাসক ছিলেন। তাঁর শাসনকাল ছিল ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত।