scorecardresearch
 

Marathon HS Exams: একই দিনে দু-দু’টো পেপার, শারীরিক-মানসিক সামর্থ্যের পরীক্ষা; ফিরে দেখা সেই উচ্চমাধ্যমিক

HS Exams Before 2007: ২০০৬ সাল পর্যন্ত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় ছেলেমেয়েরা যেন যুদ্ধে যেত! একই দিনে একেকটি বিষয়ের দু’টি পেপারের পরীক্ষা দিতে হতো। তিন তিন ছয় ঘণ্টার পরীক্ষা আর মাঝে এক ঘণ্টার বিরতি। ১৭ বছর আগের উচ্চমাধ্যমিকের স্মৃতি ঘেঁটে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন সে সময়ের কয়েকজন ‘যোদ্ধা’।

Advertisement
একই দিনে দু’টো পেপার, শারীরিক-মানসিক সামর্থ্যের পরীক্ষা, ফিরে দেখা ১৭ বছর আগের উচ্চমাধ্যমিক। একই দিনে দু’টো পেপার, শারীরিক-মানসিক সামর্থ্যের পরীক্ষা, ফিরে দেখা ১৭ বছর আগের উচ্চমাধ্যমিক।
হাইলাইটস
  • ২০০৬ সাল পর্যন্ত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় ছেলেমেয়েরা যেন যুদ্ধে যেত!
  • একই দিনে একেকটি বিষয়ের দু’টি পেপারের পরীক্ষা দিতে হতো।
  • তিন তিন ছয় ঘণ্টার পরীক্ষা আর মাঝে এক ঘণ্টার বিরতি।

Marathon HS Exams: এখন বই পড়ার বা খাতায় লেখার অভ্যাসটাই প্রায় চলে গিয়েছে অনেকের। এখন ব্যাগভর্তি মোটা মোটা বইয়ের বদলে স্মার্টফোনে পিডিএফ ফাইল খুলে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার চল। কিন্তু ২০০৬ সাল পর্যন্ত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় ছেলেমেয়েরা যেন যুদ্ধে যেত! এক ব্যাগ ঠাসা মোটা মোটা বই, গ্লুকোজ গোলা জলের বোতল, বেশ কিছুটা টিফিন নিয়ে মোটামুটি ৯-১০ ঘণ্টার জন্য পরীক্ষা দিতে বাড়ির বাইরে কাটাতে হতো পরীক্ষার্থীদের। কারণ, একই দিনে একেকটি বিষয়ের দু’টি পেপারের পরীক্ষা দিতে হতো। তিন তিন ছয় ঘণ্টার পরীক্ষা আর মাঝে এক ঘণ্টার বিরতি। ওই এক ঘণ্টার বিরতি পরীক্ষার্থীদের কাছে প্রায় ‘যুদ্ধ বিরতি’র সামিল ছিল। ১৪ মার্চ থেকে রাজ্যে শুরু হচ্ছে এ বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। তার আগে ১৭ বছর আগের উচ্চমাধ্যমিকের স্মৃতি ঘেঁটে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন সে সময়ের কয়েকজন ‘যোদ্ধা’।

মিথুন নারায়ণ বসু, উচ্চমাধ্যমিক: ১৯৯৯, পেশা: স্কুলশিক্ষক
“আমরা যারা গত শতকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছি তাদের সক্কলের সেই ম্যারাথন পরীক্ষার বিভীষিকাময় স্মৃতি অবশ্যই মনে রয়েছে। সে ছিল এক অন্য জমানা। সব বিষয়েরই একশো নম্বরের দু'টি পেপার, মোট দু'শো নম্বর। সকাল দশটা থেকে তিনঘণ্টা প্রথম পত্র। বেলা একটা থেকে দু'টো একঘন্টার বিরতি। ফের দু'টো থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি দ্বিতীয় পত্র। সক্কাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে টলতে-টলতে, কপালে দইয়ের ফোঁটা চড়িয়ে, নাকেমুখে দুটি দানা গুঁজে কোনও মতে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছনো। তারপর আক্ষরিক অর্থেই শুরু হতো পরীক্ষা। শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যের, ধৈর্যের আর অবশ্যই দুই বছর ধরে পড়া যাবতীয় বিষয়ের প্রশ্নানুযায়ী যথাযথ উত্তর প্রদানের পরীক্ষা।

HS exam

সেই যুগে উত্তরের শব্দসীমাও আলাদা করে কিছু থাকত না। পরীক্ষকরা পাতা গুণে নম্বর দিয়ে থাকেন, এমনটাই ছিল সাধারণ ধারণা। বিশেষত বাংলা আর ইতিহাসের ক্ষেত্রে এ'টি ছিল সর্বজনমান্য বিশ্বাস, আর সেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটপাতার উত্তরপত্র জমা দেওয়ার মতো মানুষের সংখ্যাও কিছু কম ছিল না। ২০০৭ সাল থেকে যাঁরা উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছেন তাঁদের কাছে এইসব গল্পকথা মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই ছিল বাস্তব। অনেকেই বিশাল ও গোটা-গোটা অক্ষরে দুই-তিন লাইনে পাতা ভরানোর কৌশলে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। সেই অপূর্ব ক্যালিগ্রাফি দেখে সাইনবোর্ড-লেখক বা রাজনৈতিক দেয়াল-লিখনের শিল্পীরাও লজ্জা পেতেন, সন্দেহ নেই।

Advertisement

আমরা যারা খাতায় খুব বেশি লুজ শিট যোজনা করতে পারতাম না, তারা রীতিমতো হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। তবু যে মোটের ওপর ভালো নম্বর পেয়েই পাস করতাম, এ থেকে বিশ্বাস জন্মেছিল যে পরীক্ষকরা কেবলই পাতা গোনেন না, মধ্যে-মধ্যে খাতা পড়েও দেখেন। প্রথম পত্রের পরীক্ষা শেষ করে বাইরে বেরোলেই অভিভাবকেরা ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কোন প্রশ্নের উত্তর কেমন লেখা হলো, কী বাদ গেল, কেন বাদ গেল ইত্যাকার প্রশ্নবাণের বৃষ্টির সঙ্গে ধেয়ে আসত নানাবিধ সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবারের যুগপৎ আক্রমণ। প্রবল ক্ষিপ্রতায় একঘন্টার মধ্যে সেইসব আক্রমণ সামলে আবার নামতে হতো সমরাঙ্গনে। তারপর বিকেল পাঁচটায় রণ-ক্লান্ত সৈনিকের মতো ফের টলতে-টলতে বাড়ি ফেরা। দু'টি পরীক্ষার মধ্যে অন্তত একদিনের ব্যবধান থাকলেও মনে হতো এর চেয়ে শান্তির আর কিছু নেই। আর যদি পরপর পড়ত পরীক্ষা, তবে ছাত্র-ছাত্রী আর অভিভাবকদের ওপর চাপের বহর কেমন হতো, সহজেই অনুমেয়। তবে তখন ছাত্র-পরম্পরায় এ-ই ছিল রীতি, কাজেই আলাদা করে চাপ মনে হতো না। মনে হতো এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছু নেই। 

HS Exam

আজ যখন দেখি অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী নির্দিষ্ট বাক্যসংখ্যায় সীমিত শব্দের উত্তর লিখতে গিয়েও কাহিল হয়ে পড়ে, প্রকল্পের কুড়ি নম্বর বাদ দিয়ে বাকি আশি নম্বরের লিখিত পরীক্ষার চাপে হিমশিম খায়, তখন অবাকই লাগে। এরা তিনঘন্টা পনেরো মিনিটে আশি নম্বরের উত্তর দিতে গিয়ে সমায়াভাবে ভোগে, অথচ প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ প্রশ্নই তো এখন সংক্ষিপ্ত বা অতি-সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক। ষোলো বা আঠারো নম্বরের দীর্ঘ, সুদীর্ঘ উত্তর লিখতে হলে এদের হাল কেমন হতো মাঝেমধ্যে ভাবি। পরীক্ষা শুরুর আগে পনেরো মিনিট ধরে প্রশ্নপত্র যাচাই করার বিলাসিতা আমরা তো ভাবতেও পারতাম না। সেইসঙ্গে কত কনস্পিরেসি থিয়োরিও তো শুনতে পাই। এইভাবে নম্বর বাড়ানোর চক্করে গোটা একটা প্রজন্মের মানসিক সামর্থ্যের হানি ঘটাচ্ছি কি আমরা? উচ্চশিক্ষায় গিয়ে পারবে তো এরা মানিয়ে নিতে? না কি যাতে উচ্চশিক্ষায় কম ছাত্রছাত্রী সুযোগ পায়, তারই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র এই সব? এই সময়ের সেরা কবিয়াল তো সেই কবেই গেয়ে ফেলেছেন, "দ্য অ্যান্সার মাই ফ্রেন্ড ইজ ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড, দ্য অ্যান্সার ইজ ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড..."

 

HS exam

ডঃ চিত্তব্রত মাল, পিএইচ.ডি., উচ্চমাধ্যমিক: ২০০৩, সহকারী অধ্যাপক, বায়োইনফরমেটিক্স
“আপনি যদি প্রায় ১৬ বছর আগে ফিরে দেখেন, তবে আপনি লক্ষ্য করবেন যে, ওই সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অর্ধেক করা হয়েছিল: প্রথমার্ধে ৩ ঘণ্টা এবং দ্বিতীয়ার্ধে আরও ৩ ঘণ্টার ম্যারাথন পরীক্ষা। তার মানে একটি বিষয়ের জন্য আমাদের এত ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল যাতে আমরা দুই বছরের পাঠ্যক্রম থেকে যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে তৈরি। এক বিষয়ের দুই পেপারের পরীক্ষার মাঝে এক ঘণ্টার বিরতি পাওয়া যেত। পরের হাফের টপিক রিভাইজ করতে করতে বাড়ি থেকে আনা খাবার নাকে মুখে গুঁজে তৈরি হতাম পরীক্ষার পরের পর্যায়ের লড়াইয়ের জন্য। সে সময়ে প্রায় সব বিষয়েই প্রশ্ন অনুযায়ী লম্বা চওড়া উত্তর লিখতাম। সে ভাবেই আমরা প্রস্তুতি নিতাম। তবুও আমরা উত্তর লেখার জন্য তাড়াহুড়া করিনি। প্রথমে আমরা সেই উত্তরগুলো লিখতাম যেগুলো আমরা খুব ভালো করে জানতাম, তারপর অন্য উত্তরগুলো লিখতাম। প্রথম দিন থেকে আমাদেরকে খুব পরিষ্কারভাবে উত্তর লিখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যাতে মূল্যায়নকারীরা সহজেই বুঝতে পারে। আমরা আমাদের হাতের লেখাও খুব ভাল রাখতাম।

Advertisement

এখন দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে গেছে। শিক্ষার্থীরা একটি বিষয়ের জন্য ৩ ঘণ্টা পরীক্ষা দেয়। শুধুমাত্র দ্বাদশ শ্রেণীর সিলেবাস অনুযায়ী। তাই এখন পরীক্ষার্থীরা যে কোনও বিষয়ে আরও জোরালো ভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে। প্রশ্নের ধরনও অনেকটা বদলেছে। আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে। যদিও পরীক্ষায় বসার আগে কারোরই সে কথা মনে হয় না। তবুও ভয় নেই। মাথা ঠাণ্ডা রাখলেই দেখা যাবে বেশিরভাগ প্রশ্নই চেনা-পরিচিত। শান্ত হয়ে ধীরে ধীরে লেখা শুরু করে তারপর গতি বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, লেখার জন্য পুরনো ব্যবহৃত কলমই সঙ্গে নিতে হবে। উত্তরপত্রের মার্জিন বজায় রেখে পরিষ্কার করে লেখার চেষ্টা করতে হবে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিলেই বিপদ! নিজের উপর বিশ্বাস রাখলেই পরীক্ষা ভাল হবে।”

HS exam

সৈকত মিত্র, উচ্চমাধ্যমিক: ২০০৭, বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
ছোট থেকেই শুনে বড়ো হয়েছিলাম উচ্চমাধ্যমিক মানেই, ৭ ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্নভাবে একদিনে দুটো পেপারের পরীক্ষা দেওয়া, যা সত্যিই বিপুল সিলেবাস এর সহ্গে যোগ হয়ে পড়ুয়াদের মনে দুশ্চিন্তা ও আতঙ্ক তৈরি করত। কি করে যে এটা সম্ভব হবে ভেবে কুল কিনারা পেতাম না! যখনই শুনলাম যে আমাদের আর এভাবে পরীক্ষা দিতে হবে না, যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো, স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম! অনেকটা ভয়হীন ও মানসিক চাপমুক্ত হয়ে পরীক্ষাও দিয়েছিলাম। আর সেই জন্য পরীক্ষাও ভালই হয়েছিল।

Advertisement