scorecardresearch
 

Kanan Devi: অনুমতি ছাড়া নায়কের চুম্বন! কানন দেবীর আপত্তিতে বাদ গিয়েছিল দৃশ্য

সিনেমার নায়কের সঙ্গে একটি রোম্যান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করছিলেন কানন। হঠাৎই কাননকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেন নায়ক। ঘটনায় প্রথমটায় বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন কানন। কারণ এ ধরনের কোনও দৃশ্যের কথা স্ক্রিপ্টে ছিল না। পরে রাগে অপমানে সেট ছেড়ে বেরিয়ে যান।

Advertisement
কানন দেবী কানন দেবী
হাইলাইটস
  • কৃষ্ণলীলা এবং চন্দ্রশেখর ছবিতে অভিনয় করে হিরোদের সমান পারিশ্রমিক (১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা) নিয়েছিলেন কানন দেবী।
  • এমন ঘটনা সিনেমার জগতে আর ঘটেছে, তেমনটা শোনা যায়নি।
  • সিনেমার নায়কের সঙ্গে একটি রোম্যান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করছিলেন কানন। হঠাৎই কাননকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেন নায়ক

জোর বরাতের চুমু

১৬ বছর বয়সে জোর বরাত ছবির জন্য সাউন্ড টেস্টে একবারে পাশ করেন কানন। সে সময় বাংলা ছবি সদ্য সবাক ছবির যুগে প্রবেশ করছে। পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তত দিনে তিনটি সিনেমায় মুখ দেখিয়ে ফেলেছেন কিশোরী কানন বালা। তার মধ্যে ২টি সিনেমায় পরিচালক ছিলেন জ্যোতিষ। এই সিনেমায় একটা ঘটনা ঘটে যা কানন দেবীকে (Kanan Devi) অনেক পরিণত করেছিল। বলা যায় তিনি সিনেমার আর একটি কদর্য রূপের সাক্ষী হয়ে থেকেছেন সিনেমার সেটে। সিনেমার নায়কের সঙ্গে একটি রোম্যান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করছিলেন কানন। হঠাৎই কাননকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেন নায়ক। ঘটনায় প্রথমটায় বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন কানন। কারণ এ ধরনের কোনও দৃশ্যের কথা স্ক্রিপ্টে ছিল না। পরে রাগে অপমানে সেট ছেড়ে বেরিয়ে যান। পরিচালক জ্যোতিষবাবু তাঁকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেন, যে এমনটা সিনেমায় খুব সাধারণ বিষয়। পাশ্চাত্যের সিনেমায় হামেশাই হয়ে থাকে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কানন অনড় ছিলেন তাঁর সিদ্ধান্তে। সিনেমায় কোনও ভাবেই সে দৃশ্য দেখানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রতিবাদেরই জয় হয়েছিল।

তৎকালীন বাংলা সিনেমায় কেন হিন্দি সিনেমায় পর্যন্ত চুম্বন দৃশ্যে অভিনয় করতে কোনও অভিনেত্রী সাহস পেতেন না। সর্বোপরি দর্শক মনও তখন এ ধরনের দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত হয়নি। আজকের দিনেও চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে কোনও সাহসী দৃশ্য সিনেমায় দেখানো হলে তা নিয়ে রে রে পড়ে যায় দর্শকদের মধ্যে। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগের অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সহায় সম্বলহীন কিশোরী কাননকে এ ধরনের অপমান বহুবার সহ্য করতে হয়েছে। কখনও কাজ করার পর কথা মতো পারিশ্রমিক পাননি। কখনও সংসারের তাড়নায় পুরুষের চরিত্রেও অভিনয় করতে হয়েছে বালিকা কাননকে!

Advertisement

একটু একটু করে তাঁর নাম ছড়াতে থাকে। ১৯৩২ সালে পর পর চারটি ছবি মুক্তি পায় কাননের। ২ বছরের মধ্যে অভিনয় গান মিলিয়ে গোটা দেশে তখন পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছেন কানন। জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনাতেই জীবনের অন্যতম সেরা হিট মানময়া গার্লস স্কুল-এ অভিনয় করলেন কানন। রাতারাতি স্টারের তকমা জুটল। সাফল্য আসতে থাকল দ্রুত। তার মধ্যেও কিছু আক্ষেপ রয়ে গেল তাঁর যা সারা জীবনেও গেল না। যেমন প্রমথেশ বড়ুয়া তখন শরৎচন্দ্রের দেবসাস অবলম্বনে ছবি করবেন স্থির করলেন। কানন দেবীকে পার্বতীয় ভূমিকায় ভেবেই তিনি ছবি তৈরির কথা ভাবেন। সে কথা জানান কাননকে। কিন্তু রাধা ফিল্ম-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। প্রমথেশ সিনেমাটি করছিলেন নিউ থিয়েটার্সের হয়ে। কানন দেবী বহু চেষ্টা করেছিলেন সিনেমায় অভিনয় করার। কিন্তু সে সুযোগ তিনি পাননি।

পরবর্তীকালে নিউ থিয়েটার্সে যোগ দিয়ে প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন তিনটি ছবিতে। প্রথম ছবি ছিল ১৯৩৭ সালে মুক্তি। দুরন্ত হিট হয় ছবিটি। বাংলার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি ভাষাতেও অভিনয় করছেন কানন। খুনি কৌন, সাপেরা, বিদ্যাপতি, জাওয়ানি কী রাত, লগন, ফ্যায়েসলা প্রভৃতি। তার মধ্যে খুনি কৌন ভীষণ হিট ছবি ছিল। লগন ১৯৪১ সালের হাইয়েস্ট গ্রসিং ফিল্ম ছিল। এমন একটা ধারণা তখন তৈরি হয়ে গিয়েছিল, কানন দেবী থাকলে সে ছবি ফ্লপ করা এমন সাধ্য কারও নেই।

 

'স্বপ্ন ভাঙাবেন না। আমি এখন কানন বালার সঙ্গে আছি...'

এর মাঝে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও ঘটে গিয়েছে অনেক পালাবদল। ১৯৪০-এর ডিসেম্বরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন বিলেত ফেরত উচ্চ শিক্ষিত যুবক অশোক মৈত্রের সঙ্গে। অশোকের সঙ্গে কাননের দেখা হওয়ার গল্পটি যেন উপরওয়ালাই চিত্রনাট্য হিসাবে লিখে পাঠিয়েছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের একেবারে প্রথম সারির নেতা এবং সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পুত্র ছিলেন অশোক। তখন তিনি বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করছেন। পড়ানোর ফাঁকে কলকাতায় আসতেন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পান-গল্প করতে। এমনই এক সন্ধ্যায় চূড়ান্ত নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অশোক মুখ ফুটে বন্ধুদের বলে ফেললেন, 'এমন সন্ধ্যায় শুধুমাত্র একটি চাওয়াই বাকি, সেটা হল কাননকে পাশে পাওয়া।' ঝোঁকের বশে বন্ধুরা তাঁকে গাড়িতে তুলে কানন দেবীর বাড়ির দরজার সামনে বেহুঁশ অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যান। ভোর বেলা দরজা খুলে কানন আবিষ্কার করেন একজন সুবেশী সুদর্শন যুবক দোরগোড়ায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। তিনি তড়িঘড়ি অশোকের মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়ে প্রশ্ন করেন, 'আপনি কে? এখানে কী ভাবে এলেন?' খানিক চোখ খুলে আধোঘুম আধো জাগরণে অশোক উত্তর দিয়েছিলেন, 'চলে যান, স্বপ্ন ভাঙাবেন না। আমি এখন কানন বালার সঙ্গে আছি।'

প্রথম দেখাতেই কাননের ভালো লেগে গিয়েছিল অশোককে। আর অশোক তো কানন বলতে অজ্ঞান। ফলে ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণত হতে সময় নেয়নি। অশোকের বোন রানির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশের। এঁদের সঙ্গেও ভীষণ সখ্য হয়েছিল কানন দেবীর। অশোকের মা কুসুমকুমারী দেবীর সঙ্গেও কাননের সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল হেরম্বচন্দ্রকে নিয়ে। তিনি কোনও ভাবেই প্রেম বা বিয়ে মেনে নেবেন না সে কথা সকলেই জানতেন। জীবিত অবস্থায় মেনেও নেননি। হেরম্বচন্দ্রের মৃত্যুর পর বিয়ে হয় কানন এবং অশোকের। সুখের সাগরে ভাসছিলেন কানন। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ে, সামাজিক স্বীকৃতি, সম্মান, প্রতিপত্তি, অর্থ, যশ, খ্যাতি সবই মুচলেকা দিয়ে কাননের চৌকাঠে বাঁধা পড়েছিল। অশোকের সান্নিধ্যে এসে কানন পড়াশোনা এবং গানবাজনা উভয় বিষয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। বিশেষ করে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মায় অশোকের সৌজন্যেই।

Advertisement

কিন্তু কাননের জীবনের চিত্রনাট্য কোনও অংশে সিনেমার চেয়ে কম কিছু নয় তা আগেই লেখা হয়েছে। যে সিনেমার জন্য কাননের প্রেমে পড়া, তাঁর সঙ্গে বিয়ে করতে সমাজকে উপেক্ষা করলেন অশোক, বিয়ের পর সিনেমা ছাড়ার জন্যই ধীরে ধীরে সমস্যা তৈরি হল দাম্পত্য জীবনে। অশোকের সংসারে নিশ্চিন্তে জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন তিনি। তৎকালীন সময়ে এমনটা বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। সে যুগের আরও এক নামী নায়িকা-গায়িকা উমাশশীও বিয়ের পর অভিনয়কে বিদায় জানিয়েছিলেন। সকলে ভেবেছিলেন কাননের ক্ষেত্রেও এমনটাই ভবিতব্য। কিন্তু আত্মসম্মান এবং প্রতিভাকে কোনও ভাবেই দমিয়ে রাখতে পারেননি কানন। ফলে ছোট চিড় অচিরেই বড় ফাটলের আকার নেয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালে আইনি বিচ্ছেদে শেষ হয় সম্পর্ক। আশ্চর্ষের বিষয়, নিকট মহলে বহুবার এ বিষয়ে কথা বললেও, তাঁর আত্মজীবনীতে এ সম্পর্কে কোনও কথাই উল্লেখ করেননি কানন দেবী।

 

দ্বিতীয় বিয়ে হরিদাস ভট্টাচার্য-কে

চার বছর পর দ্বিতীয় বিয়ে হয় হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে। রাজ্যপালের এডিসি পদে নিযুক্ত ছিলেন হরিদাস। একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়ে হরিদাসের সঙ্গে পরিচয় হয় কাননের। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে প্রণয় গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিয়ের পর খবরের কাগজ থেকে ম্যাগাজিনে যাকে বলে কলতলার কেচ্ছা শুরু হয়েছিল কানন দেবীকে নিয়ে। কিন্তু সে সবের ধার ধারতেন না হরিদাস। তৎকালীন বম্বের এক প্রযোজক মাসিক ৫ লক্ষ টাকা বেতন দিয়ে কানন দেবীকে বম্বে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কানন দেবী রাজি হননি। তিনি সদর্পে বলেছিলেন, 'বম্বের প্রয়োজন হলে বম্বে এখানে আসবে।' শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল। কৃষ্ণলীলা এবং চন্দ্রশেখর ছবিতে অভিনয় করে হিরোদের সমান পারিশ্রমিক (১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা) নিয়েছিলেন কানন দেবী। এমন ঘটনা সিনেমার জগতে আর ঘটেছে, তেমনটা শোনা যায়নি।

এ সময় নিজের প্রোডাকশন হাউসও তৈরি করেন কানন দেবী। তাতে বেশ কয়েকটি ছবিতে নিজে এবং স্বামী হরিদাস পরিচালনার ভার সামলেছিলেন। প্রায় সব ছবিই হিট করেছিল। তাঁর প্রডোকশন হাউজে প্রথম জীবনে কাজ করেছেন বিখ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদার। বিদেশে গিয়ে সেখানকার মেকআপ, ক্যামেরার কাজ, স্টুডিওর পরিস্থিতি দেখে এ দেশেও চেষ্টা করেছিলেন তেমনটা করার। তাঁর আক্ষেপ ছিল, 'বিদেশে যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা রয়েছে, সে সব এ দেশে পাওয়া গেলে এটাই সিনমার পুণ্যভূমি হয়ে উঠত।' হরিদাসের সঙ্গে ৪০ বছরের বিবাহিত জীবন কাটিয়েছেন কানন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত।  সে সময় রিজেন্ট গ্রুভে পাকাপাকি ভাবে থাকছেন। একদিন নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েন হরিদাস। কেন, কী জন্যে, সে সবরে উত্তর আর মিলবে না।

প্রাক্তন মহিলাশিল্পীদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন কানন দেবী। সে জন্য তৈরি করেছিলেন মহিলা শিল্পীমহল। কিন্তু সেটাও খুব বেশি দিন চালাতে পারেননি নানা কারণে। তত দিনে পদ্মশ্রী, দাদাসাহেব ফালকে, জাতীয় পুরস্কার সবই পাওয়া হয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে লাইম লাইট থেকে দূরেও সরছিলেন। এক সময় সব কিছুই সরিয়ে রেখে ঠাকুর ঘরের আশ্রয়ে চলে গেলেন ভারতীয় সিনেমার প্রথম সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা। একা হতে লাগলেন ধীরে ধীরে। একা একা চুপি চুপিই একদিন চলে গেলেন। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই বেলভিউ নার্সিংহোমের একটি কেবিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কানন দেবী। যে ইন্ডাস্ট্রির জন্য তিনি এত কিছু করেছেন, যে সমস্ত স্টুডিওর ফ্লোরে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন, সেখান থেকে তাঁর শেষকৃত্যের সময় কেউ এলেন না। কয়েক জন শ্দ্ধা জানিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু পাশে থাকেননি কেউই। তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শেষ পর্যন্ত ছিলেন। আর ছিল তাঁর পরিবার।

Advertisement

এটাই কি প্রাপ্য ছিল দেশের প্রথম সুপারস্টারের? জানা নেই। তবে কানন দেবীর জীবনের চিত্রনাট্য সব দৃশ্য সব সময় করুণ রাগেই শেষ হয়েছে। জীবনের শেষ দৃশ্যে ক্ল্যাপস্টিক পরার সময়ও তার পরিবর্তন হয়নি।

 

Advertisement