scorecardresearch
 

R D Burman: কান্নার সুরে তিনি পঞ্চম হতে পারেন, গানের সুরে তিনিই প্রথম

সত্তরের দশকে ভারতীয় সিনেমার গানে প্রায় রাজত্ব করে গিয়েছেন। বিশেষত হিন্দি ছবির গানে। সেই রাহুলদেবকে আশির দশকে অপেক্ষা করতে হত কাজের জন্য। জানি না কী ভাবে, তবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একটা ধারণা রাতারাতি তৈরি হয়েছিল, রাহুলদেব বর্মনকে দিয়ে সুর করালে সে ছবি চলবে না। ভাবা যায়! নির্জনতা, শরাব আর নিজের সৃষ্টিতে সে সময় ডুবে থাকতেন পঞ্চম।

Advertisement
আশা ভোঁসলের সঙ্গে নিজের মিউজিক রুমে আর ডি বর্মন আশা ভোঁসলের সঙ্গে নিজের মিউজিক রুমে আর ডি বর্মন
হাইলাইটস
  • যিনি কাঁদতেনও সুর করে, তিনি তো সুরেই ডুবে থাকবেন। শুধু ডুবেই থাকেননি, ডুবিয়ে ছেড়েছেন আসমুদ্র হিমাচলকে।
  • যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, লিখে ফেললেন ” আও টুইস্ট করে”। আর গাইলেন মান্না দে।
  • বাবা শচীনদেব বর্মন অভিমানে অনেক দিন কথা বলেননি এই গান শুনে। শচীন কর্তার মনে হয়েছিল এই গানের সুর মোটেই ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না।
  • সত্তরের দশকে ভারতীয় সিনেমার গানে প্রায় রাজত্ব করে গিয়েছেন। বিশেষত হিন্দি ছবির গানে। সেই রাহুলদেবকে আশির দশকে অপেক্ষা করতে হত কাজের জন্য।
  • যাবতীয় অপমান বঞ্চনার জবাব তাঁর শেষ অ্যাওয়ার্ডে দিয়ে গিয়েছিলেন রাহুলদেব বর্মন।

যিনি কাঁদতেনও সুর করে, তিনি তো সুরেই ডুবে থাকবেন। শুধু ডুবেই থাকেননি, ডুবিয়ে ছেড়েছেন আসমুদ্র হিমাচলকে। আজকের দিনে ১৯৩৯ সালে কলকাতায় জন্ম সুরকার, গায়ক রাহুলদেব বর্মনের। বাবা সঙ্গীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মন এবং মা মীরা দাশগুপ্ত ছিলেন গীতিকার। তাঁর ঠাকুরমা ডাকতেন ‘টুবলু’ নামে। কেউ কেউ বলে থাকেন সা রে গা মা পা এর ‘পা’ ধ্বনি দ্বারা রাহুল একদম ছোটোবেলায় ক্রন্দন করতেন তাই তার নাম সা রে গা মা পা এর পঞ্চম ধ্বনি অনুযায়ী পঞ্চম হয় বা ‘প’ অক্ষর থেকে পঞ্চম রাখা হয়। কেউ কেউ আবার এও বলেন যে অভিনেতা অশোক কুমার রাহুলের ডাকনাম পঞ্চম রেখেছিলেন।

৩৬/১ সাউথ এন্ড পার্ক, কলকাতা- ২৯। এই ঠিকানায় তাঁর বেড়ে ওঠা। একসময় এখানেই যে সপরিবারে থাকতেন শচীন দেব বর্মন। আর এখানেই বেড়ে ওঠা টুবলুর। যাবতীয় দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি চলছিল পড়াশোনা, সঙ্গে সঙ্গীত শিক্ষা, তবলা, সরোদের তালিম। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিল ব্রজেন বিশ্বাস, উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের মতো ব্যক্তিদের। পরবর্তীকালে মুম্বই এবং অন্যান্য জায়গায় গেলেও, রাহুল দেব বর্মনের মন পড়ে থাকত এই শহরে। এই বাড়িতেই উঠতেন। মনে-প্রাণে তিনি যে খাঁটি বাঙালি। তবে শুধু সাউথ এন্ড পার্কের বাড়িটিই নয়। ১৯৪৮ সালে এখানে আসার আগে হিন্দুস্তান পার্কের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন শচীন কত্তারা। সেই বাড়িতেই জন্ম রাহুল দেব বর্মনের।

মাত্র ন’বছর বয়সে ‘ফ্যান্টুস’ ছবির একটি গানে প্রথম সুর দেন রাহুল। সে ছবি মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালে। এরপর ১৯৬১ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘ছোটে নবাব’। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে রাহুল দেব বর্মণের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। ১৯৬৫ সালে মেহমুদ সাব “ভূত বাংলা” ছবির মিউজিকের দায়িত্ব দেন অন্তরঙ্গ বন্ধু পঞ্চমের হাতে। মেহমুদ সাহাব-কে যাঁরা চিনতেন তাঁরা জানেন কতটা প্রানবন্ত ছিলেন তিনি এবং তাঁর অভিনয়। পঞ্চম ঠিক করেন এলভিস প্রেসলির দৌলতে সেই সময়ে প্রচণ্ড জনপ্রিয় টুইস্ট নাচের ওপর একটা গান কম্পোজ করবেন, আর যাতে কোমর দোলাবেন মেহমুদ সাহাব নিজে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, লিখে ফেললেন ” আও টুইস্ট করে”। আর গাইলেন মান্না দে।

Advertisement
বাবা শচীনদেব বর্মনের সঙ্গে

বাবা শচীনদেব বর্মন অভিমানে অনেক দিন কথা বলেননি এই গান শুনে। শচীন কর্তার মনে হয়েছিল এই গানের সুর মোটেই ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না। ততদিনে পঞ্চম বানিয়ে ফেলেছেন “তিসরি মঞ্জিল”- এর বিখ্যাত সব গানের সুর। ‘আজা আজা ম্যয় হুঁ পেয়্যার তেরা’, ‘ও হাসিনা জুলফোওয়ালি জানে জাঁহা’ যা ছিল পশ্চিমী ক্যাবারের অনুকরণে বানানো। এর পাশাপাশি আরো দুটো গান ছিল ‘ও মেরে সোনা রে সোনা রে’ ও ‘তুমনে মুঝে দেখা’ যা দিয়ে পঞ্চম মিউজিক ডিরেক্টর হিসাবে প্রথমবারের জন্য সাফল্যের সিঁড়িতে পা রাখেন। তারপর শুরু হয় আর ডি-র যুগ। বাবা শচীন দেব বর্মনের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি করেন পঞ্চম। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকের বলিউড জেনে যায় মাঝারিমাপের চিত্রনাট্যও পঞ্চমের সুরের যাদুতে হয়ে ওঠে মিউজিক্যাল হিটস।

নিজের জীবনের বহু ঘটনা থেকেও পেশাদার জগতের গান বেঁধেছেন আরডি। তাঁর প্রথম স্ত্রী রিতা পটেল। তাঁর সঙ্গে দার্জিলিঙে আলাপ। রীতা নাকি আরডি-র গানের ফ্যান ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে এক দিন পঞ্চমের সঙ্গে ছবি দেখতে যান। ১৯৬৬-তে বিয়ে। যদিও ৭১-এই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বিবাহ-বিচ্ছেদের পরের বছর ‘পরিচয়’ ছবির জন্য ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’ গানটি লিখেছিলেন পঞ্চম। নতুন করে সম্পর্কে ফিরতে সময় লেগেছিল আরও ন’বছর। ১৯৮০-তে আশা ভোঁসলেকে বিয়ে করেন তিনি।

সাধন সঙ্গিনী - জীবন সঙ্গিনী

সত্তরের পঞ্চম শুধু বিদেশি সংগীত নিয়ে পড়ে থাকেননি, শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়েও বেশ কিছু কাজকর্ম করেছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন গুলজার সাহেবের লেখা আর কিশোর কুমারের গলা। আর ডি, গুলজার আর কিশোর কম্বিনেশন সমস্ত ব্লকবাস্টার। কি সব গান বেরিয়ে এসেছিল এই তিনজনের যুগলবন্দীতে! ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’, ‘ও মাঝি রে আপনা কিনারা’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগী সে কোয়ি’, ‘তুম আ গ্যায়ে হো নুর আ গ্যায়া হ্যায়’, ‘আনেওয়ালা পল জানেওয়ালা হ্যায়’। বলে শেষ করা যাবে না তবে কিশোর কুমারের সাথে একটা আলাদা সম্পর্ক ছিল আর ডি-র।

শুধু রাগপ্রধান গান গাওয়া ছাড়াও কিশোরের গলায় ও রাজেশ খান্নার লিপে আর ডি ভারতবর্ষকে সুর মূর্ছনায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন একটা গোটা দশক। অমর প্রেম সিনেমার কথাই ধরুন। সিনেমার সমস্ত গান আজও মানুষ সমান আঘ্রহ নিয়ে শোনেন। এ সময় বেশ কিছু পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে তিনি পিছনে ফেলে দেন তাঁর সমসাময়িক সঙ্গীত পরিচালকদের। কিছু গানের শুরুতে এমন কিছু আওয়াজ তৈরি করেন যা সেইসময় বসে করা দূরে থাকা ভাবতেও কেউ পারতেন না। কিন্তু তিনি তো সরস্বতীর বরপুত্র। তাই অনায়াসে অমন শব্দ সৃষ্টি করে গেছেন। যেমন ‘শোলে’ সিনেমায় ‘মেহবুবা মেহবুবা’ গানের আগে ফাঁকা বোতলের শব্দ, ‘পড়োসন’ সিনেমায় ‘মেরে সামনেওয়ালি খিড়কি’ গানের আগে চিরুনি ঘষার শব্দ, ‘ইঁয়াদো কি বারাত’ সিনেমায় ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যো দিল কো’ গানের আগে বোতলের গায়ে কাঁটা চামচ ঠোকার শব্দ।

এক ফ্রেমে চারজন লেজেন্ড

হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে ‘শোলে’ হল এমন একটা সিনেমা যার পর থেকে হিন্দি সিনেমার একটা নতুন ধারা তৈরি হয়ে ছিল। সিনেমার গান নিয়ে কিছু বলার নেই। সব গানের মধ্যে সেরা ছিল ‘মেহবুবা মেহবুবা’ গানটি। গানটি পঞ্চম লিখেছিলেন আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য। কিন্তু আশাজি বেঁকে বসেন ওই চড়া সুর শুনে। তখন নিজেই গানটি রেকর্ড করেন আর সিনেমায় চালিয়ে দেন যা সুপার ডুপার হিট হয়ে যায়। শোলের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বানিয়েছিলেন হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘গুড ব্যাড আগলি’-র অনুকরণে। আর অমিতাভের লিপের মাউথ অরগ্যানের সেই সুর আজও বহু মানুষের সেলফোনের রিংটোন হিসাবে বেজে চলে। এটাই আর ডি, যার সুর আজকেও ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক।

Advertisement

সত্তরের দশকে ভারতীয় সিনেমার গানে প্রায় রাজত্ব করে গিয়েছেন। বিশেষত হিন্দি ছবির গানে। সেই রাহুলদেবকে আশির দশকে অপেক্ষা করতে হত কাজের জন্য। জানি না কী ভাবে, তবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একটা ধারণা রাতারাতি তৈরি হয়েছিল, রাহুলদেব বর্মনকে দিয়ে সুর করালে সে ছবি চলবে না। ভাবা যায়! নির্জনতা, শরাব আর নিজের সৃষ্টিতে সে সময় ডুবে থাকতেন পঞ্চম। তবুও আশির দশকে যে সমস্ত ছবিতে তিনি সঙ্গীত দিয়েছিলেন তা একের পর এক হিট। তালিকার দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে, ‘শান’, ‘বরসাত কি এক রাত’, ‘রকি’, ‘কালিয়া’, ‘ সত্তে পে সত্তা’, ‘সনম তেরি কসম’, ‘মাসুম’, ‘বেতাব’, ‘জিভা’, ‘সাগর’, ‘ইজাজত’, ‘পরিন্দে’।

৩৩০ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার পর, অসংখ্য পুরস্কার জেতার পর হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন আর ডি। কেউ কাজ দিতে চাইতেন না। তাঁর ৩৩১ নম্বর এবং শেষ ছবি 1942 A Love Story. শেষ ছবিতেও তিনি কত বড় সুরকার তার প্রমাণ রেখে গিয়েছেন। ১৯৯৫ সালের ফিল্মফেয়ারের অডিটোরিয়ামে সেদিন তাঁর গানগুলোর হয়তো থাকাই হত না যদি না বলিউডের এক উঠতি পরিচালক ইন্ডাস্ট্রির ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে তাঁর সুরের উপর বিশ্বাস রাখতেন। অনুষ্ঠান শুরু হলে দেখা যায় সমস্ত সিনেমাকে পিছনে ফেলে একটার পর একটা অ্যাওয়ার্ড জিতে চলেছে বিধু বিনোদ চোপড়ার (উঠতি পরিচালক) ১৯৪২-এ লাভ স্টোরি। এবার এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! রাখী গুলজারের গলা দিয়ে বেরিয়ে এল সেই বছরের সেরা মিউজিক ডিরেক্টরের নাম, আর ডি বর্মন। গোটা ভারতের প্রিয় ” পঞ্চম”দা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তিনি সিনেমা মুক্তি পাওয়ার তিন মাস আগেই ইহলোক ত্যাগ করে চলে যান। যাবতীয় অপমান বঞ্চনার জবাব তাঁর শেষ অ্যাওয়ার্ডে দিয়ে গিয়েছিলেন রাহুলদেব বর্মন।

 

Advertisement