scorecardresearch
 

গুলি খেয়েও পোস্ট ছাড়েননি! ভারত-পাক যুদ্ধের যদুনাথের বীরগাঁথা

১৯৪৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। ঘটনাস্থল জম্মু ও কাশ্মীরের নৌসেরা সেক্টরের ভারতীয় সেনার পোস্ট। সেখানে জখম অথবা মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন ভারতীয় জওয়ানরা। সামনে থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে করতে পোস্ট দখলের লক্ষ্যে এগিয়ে আসছে পাকিস্তানি জওয়ানরা। মাত্র কয়েক কদম দূরেই তারা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দখল করে নেবে নৌসেরার এই পোস্ট। ঠিক তখন ভারতীয় পোস্ট থেকে শুরু হল গুলিবর্ষণ। অবিরাম।

Advertisement
যদুনাথ সিং যদুনাথ সিং
হাইলাইটস
  • উত্তরপ্রদেশের শাহাজাহানপুরের খাজুরি গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম রঘুনাথ সিংয়ের
  • ছোটো থেকেই দেশসেবার স্বপ্ন দেখতেন যদুনাথ
  • তাঁর প্রচেষ্টাতেই নৌসেরা সেক্টর ভারত নিজের দখলে রাখতে সক্ষম হয়

১৯৪৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। ঘটনাস্থল জম্মু ও কাশ্মীরের নৌসেরা সেক্টরের ভারতীয় সেনার পোস্ট। সেখানে জখম অথবা মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন ভারতীয় জওয়ানরা। সামনে থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে করতে পোস্ট দখলের লক্ষ্যে এগিয়ে আসছে পাকিস্তানি জওয়ানরা। মাত্র কয়েক কদম দূরেই তারা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দখল করে নেবে নৌসেরার এই পোস্ট।  ঠিক তখন ভারতীয় পোস্ট থেকে শুরু হল গুলিবর্ষণ। অবিরাম। ঝড়ের গতিতে। চমকে গেল শত্রুপক্ষ। তারা দেখল, একজন মাত্র ভারতীয় জওয়ান হাতে বন্দুক নিয়ে তাদের দিকে অবিরাম গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে শত্রুপক্ষের কয়েকজনকে মাটিতে শুইয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন ভারতের সেই বীর জওয়ান। সংখ্যায় শতাধিক হলেও পাকিস্তানি জওয়ানরা প্রমাদ গুনল। তারা পিছু হটতে থাকল। এভাবেই নৌসেরা পোস্ট অক্ষত রেখেছিলেন রাজপুত রেজিমেন্টের নায়েক যদুনাথ সিং। যখন ভারতের আরও জওয়ান নৌসেরা পোস্টে পৌঁছল ততক্ষণে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন যদুনাথ। সতীর্থরা দেখেন, যদুনাথের শরীর ঝাঁঝরা করে দিয়েছে গুলি। বুক ও মাথা ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছে বুলেট। কিন্তু, জখম যদুনাথ পোস্ট ছাড়েননি। ওই অবস্থাতেই বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। শত্রুপক্ষকে পিছু হটতে বাধ্য করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৪৭-৪৮ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের জন্য সবথেকে কঠিন দিন ছিল সেই ৬ ফেব্রুয়ারি। সেদিন যদুনাথ একা না লড়তে পারলে নৌসেরার তানধরের পোস্টটি দখল করে নিতে পারত পাকিস্তানি সেনা। কিন্তু, যদুনাথ একাই শত্রুপক্ষকে রুখে দিয়ে অসাধ্যসাধন করেছিলেন। সেদিনের অবদানের জন্য নায়েক যদুনাথ সিংকে মরণোত্তর পরমবীর চক্র দেয় ভারত সরকার। 

যদুনাথ সিংয়ের প্রস্তর মূর্তি
যদুনাথ সিংয়ের প্রস্তর মূর্তি

১৯১৬ সালের ২১ নভেম্বর। উত্তরপ্রদেশের শাহাজাহানপুরের খাজুরি গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম রঘুনাথ সিংয়ের। বাবা বীরবল সিং রাঠৌর ও মা যমুনা কানওয়ার। দম্পতির আট সন্তানের মধ্যে যদুনাথ ছিলেন তৃতীয়। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন যদুনাথ। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় পরিবারে আর পড়াশোনা এগোইনি। নাবালক যদুনাথ বাবার সঙ্গে চাষের কাজ করতেন। গ্রামে শরীরচর্চার পরিমণ্ডল ছিল। সেই আবহে বেড়ে ওঠা যদুনাথ অল্প বয়সেই শারীরিক সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে শুরু করেন। সেই সময় উত্তরপ্রদেশের গ্রামগুলিতে কুস্তির আখড়া ছিল। বাড়ির ছেলেরা আখড়ায় যেত। যদুনাথও তার ব্য়তিক্রম নন। তিনিও আখড়ায় যেতেন ও নিয়মিত চর্চা করতেন। খুব অল্প বয়সেই নিজের এলাকায় কুস্তিবীর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। গ্রামের লোকজন তাঁকে হনুমান ভগৎ ভাই ব্রহ্মচারী বলে ডাকতেন। পবনপুত্র হনুমানের শক্তির সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এই নাম রাখা হয়েছিল যদুনাথের। হনুমানের মতো যদুনাথও বিয়ে করেননি । 

Advertisement
মরণোত্তর পরমবীর চক্র দেওয়া হয়েছিল যদুনাথ সিংকে
মরণোত্তর পরমবীর চক্র দেওয়া হয়েছিল যদুনাথ সিংকে

ছোটো থেকেই দেশসেবার স্বপ্ন দেখতেন যদুনাথ। সেই মতো পঁচিশ বছর বয়সে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির সেভেন রাজপুত রেজিমেন্টের ফার্স্ট ব্যাটেলিয়নে যোগ দেন। সালটা ১৯৪১। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। পরেরবছর আরাকান অঞ্চলে জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন যদুনাথ। সেখানে নিজের দক্ষতার প্রমাণ রাখেন। যদুনাথের দলও বীরবিক্রমে লড়াই করে। ১৯৪৫ সালে যদুনাথ সিংয়ের ব্যাটেলিয়নকে সেকেন্ড ইন্ডিয়ান ইনফেনটারি ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ও আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পাঠানো হয়। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অনেকটা অংশ তখনও জাপানি সৈন্য দখল করে রেখেছিল। জাপানি জওয়ানদের পিছু হটতে বাধ্য করেন যদুনাথ ও তাঁর সতীর্থরা। দেশে ফেরার পর যদুনাথকে নায়েক পদবী দেওয়া হয়। দেশভাগের পর সেভেন রাজপুত রেজিমেন্টকে ইন্ডিয়ান আর্মির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটলিয়নে থেকে দেশসেবা করতে থাকেন যদুনাথ।     

যদুনাথের নামে ডাক টিকিটও প্রকাশিত করেছিল কেন্দ্র সরকার
যদুনাথের নামে ডাক টিকিটও প্রকাশিত করেছিল কেন্দ্র সরকার

১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাস। ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের মাত্র দু'মাস পর জম্মু ও কাশ্মীরে আক্রমণ করে পাকিস্তান। তৎপরতার সঙ্গে পাকিস্তানের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হয় ভারতও। ক্যাবিনেট ভারতীয় সেনাকে যোগ্য জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। তাঁদের বিভিন্ন পোস্টের দিকে এগোতে থাকা পাকিস্তানি সেনাকে দূর হটাতে শুরু করে ভারতীয় জওয়ানরা। সেই বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় ফিফটিথ প্যারা ব্রিগেডের রাজপুত রেজিমেন্টকে নৌসেরার ঝাঙ্গারে একটি পোস্ট তৈরি করে জায়গাটিকে শত্রুপক্ষের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু, খারাপ আবহাওয়ার জন্য তা করতে সক্ষম হয়নি ভারতীয় জওয়ানরা। নৌসেরার ঝাঙ্গর সেক্টরটি দখল করে বসে পাকিস্তান। মীরপুর ও পুঞ্চের মধ্যে যোগাযোগ মাধ্যমকে কবজায় নিতে সক্ষম হয় তারা। আর যাতে পাকিস্তান এগোতে না পারে সেজন্য সেই মাসেই নৌসেরার উত্তর পশ্চিমে একাধিক অভিযান চালায় ভারত। ব্রিগেডিয়ার মহম্মদ উসমান এর নেতৃত্ব দেন। ছোটো ছোটো দলে জওয়ানদের ভাগ করে তিনি বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করেন।   

বীর জওয়ানের নামে ভিত্তিপ্রস্তর
বীর জওয়ানের নামে ভিত্তিপ্রস্তর

তারপর আসে সেই দিন । ১৮৪৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি । ঘড়িতে সকাল ৬টা ৪০। তানধরে ২৭ জনকে নিয়ে নিজের পোস্ট সামলাচ্ছিলেন যদুনাথ। চারদিক কুয়াশায় ঢাকা। সামনের জনকেও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। ঠিক সেরকম পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি জওয়ানরা যদুনাথের পোস্ট লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। পাশাপাশি সেই পোস্ট দখলের লক্ষ্যে সামনের দিকে এগোতে থাকে। পাকিস্তানের তরফে মোট তিনবার আক্রমণ করা হয়। প্রথম আক্রমণেই ক্ষতবিক্ষত হন কয়েকজন জওয়ান। প্রথম আক্রমণের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই দ্বিতীয় আক্রমণ। পোস্টের ক্ষতি হয় খুব। তবে মনোবল না হারিয়ে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে বলেন যদুনাথ। ততক্ষণে মাটিতে পড়েছেন কয়েকজন। যাঁরা বেঁচেছিলেন, তাঁদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ার জন্য উৎসাহিত করেন যদুনাথ। দ্বিতীয় আক্রমণেই গুরুতর জখম হন যদুনাথ। এবার তৃতীয় হামলা। শতাধিক পাকিস্তানি জওয়ানের আক্রমণে ভারতীয় পোস্টের দায়িত্বে থাকা প্রায় সব সৈন্যই জখম কিংবা শহিদ হন। কার্যত একা হয়ে পড়েন যদুনাথ। তবে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাননি। এবার একাই পোস্ট থেকে বেরিয়ে আসেন। সামনে থেকে গুলি চালাতে শুরু করেন শত্রুপক্ষকে লক্ষ্য করে। এক যদুনাথের প্রতিরোধের মুখে পড়ে পিছু হটতে বাধ্য় হয় পাকিস্তানি জওয়ানরা। পোস্ট অক্ষত থাকে। কিছুক্ষণ পর ব্যাকআপ জওয়ানরা এসে দেখেন, ২৭ জনের মধ্যে ২৪ জন জখম অথবা শহিদ হয়ে পড়ে রয়েছেন। শহিদ হয়েছেন যদুনাথও। তাঁর বুকে ও মাথায় গুলি লেগেছে। 

Advertisement
যদুনাথ সিং
যদুনাথ সিং

১৯৫০ সালে মরণোত্তর পরমবীর চক্র দেওয়া হয় যদুনাথ সিংকে। সেনার তরফে বলা হয়, 'অসম সাহসিকতা ও নেতৃত্বে দক্ষতার জন্য যদুনাথ সিংকে পরমবীর চক্র দেওয়া হল। সঙ্গীরা জখম ও শহিদ হলেও তাঁদের ছেড়ে যাননি যদুনাথ। পোস্টকে রক্ষা করার কাজেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। শত্রুপক্ষের দ্বিতীয় আক্রমণে তিনি জখম হয়েছিলেন। তারপরও তিনি লড়াই চালিয়ে যান। তৃতীয় আক্রমণের পর কার্যত একা হাতে পোস্ট সামলেছিলেন। বন্দুক হাতে একাই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তার ফলে শত্রুরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। যদুনাথের এই অবদান অবিস্মরণীয় ও অভূতপূর্ব।' প্রসঙ্গত, যদুনাথের স্মৃতিতে শাহাজাহানপুরে একটি স্টেডিয়ামের নামকরণও করা হয়েছে। সৌধ স্থাপন করা হয়েছে তানধরে। 

সেনা বিশেষজ্ঞদের মতে, সেদিন নৌসেরার এই পোস্টটি পাকিস্তান দখল করে নিলে আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হত না। সেদিন গুলি খেয়েও যদুনাথ লড়াই চালিয়ে যেতে না পারলে ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হত। ভারতের সেই বীর সন্তান যদুনাথ সিংকে শ্রদ্ধার্ঘ। 

Advertisement