scorecardresearch
 

Anup Kumar: 'আংটি চাটুজ্জের ভাই'-কে যোগ্য সম্মান দিতে পারেনি বাংলা সিনেমা

হয়তো বাংলা ছবির জগৎ যোগ্য সম্মান দিতে পারেনি এই বর্ণময় অভিনেতা তথা মানবিক অনুপকুমারকে। সেই ক্ষোভ তাঁর নিজের মধ্যেও ছিল। সেই জন্যই ১৯৯৮-র ৩রা সেপ্টেম্বর তাঁরই নির্দেশমতো তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হয়নি। অভিনয় জগতও তাঁকে সীমিত রেখেছে কৌতুকাভিনেতার গণ্ডিতে। অথচ আজীবন একজন শিল্পীশ্রমিক ও ভালমানুষ হিসেবে নিজের সেরাটা দিয়ে গেছেন তিনি।

Advertisement
অনুপ কুমার অনুপ কুমার
হাইলাইটস
  • নায়ক বা ভিলেন কোনও চরিত্রেই খুব বড় ভূমিকায় তাঁকে মনে না রাখলেও, বাঙালির রান্নায় যেমন হলুদগুঁড়োর ব্যবহার, তেমনই অনস্বীকার্য বাংলা চলচ্চিত্রে অনুপ কুমার নামের এক অনিবার্য অভিনেতার।
  • মৃণাল সেন-গীতা সেনের সংসারও চালিয়েছেন বহুদিন নিজের অভিনয়ের অর্থোপার্জন থেকে। তিনি অনুপকুমার।
  • বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম বহুমুখী প্রতিভাশালী অভিনেতা, যাঁর ক্ষুরধার অভিনয়ের দীপ্তিতে নিজে ঢাকা পড়ে যাওয়ার ভয়ে স্বয়ং উত্তমকুমার তাঁকে বাদ দিতে বলেছিলেন একটি ছবি থেকে।

একজন স্বনামধন্য অভিনেতা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে সন্ধ্যাবেলা শ্যামবাজারের কাঠমিস্ত্রীদের দোকানঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছেন। কেন? কারণ ঋত্বিক ঘটক নাটকের রিহার্সাল করাবেন। – দৃশ্যটা খানিক অভাবনীয় বটে তবে অসম্ভব নয়; অন্তত ছিল না অনুপ কুমারের পক্ষে। অভিনেত্রী গীতা দে’র মেয়ের অ্যাপেনডিক্স অপারেশন হবে। টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন কে? অনুপ কুমার। অভিনেতা শমিত ভঞ্জের মেয়ের অন্নপ্রাশনের উদ্দেশ্যে জোগাড় করা টাকা রাস্তায় পকেটমার হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নিজের পকেট থেকে সাত হাজার টাকা বার করে দিয়েছিলেন অনুপ। নিজের পরিচালিত ‘তুমি যে আমার’ নাটকে যখন প্রযোজক সময় মতো টাকা দিতে পারছিলেন না, তখন নিজের জমি বেচে কলাকুশলীদের অর্থ মিটিয়েছিলেন তিনি। অজিত গাঙ্গুলি যেদিন মান্না দে কে দিয়ে গান রেকর্ড করিয়ে পেমেন্ট করতে পারছিলেন না, সে দিনও এগিয়ে এসেছিলেন ইন্ডাস্ট্রির সকলের প্রিয় অনু দা।

নানা রকমের চরিত্রে নানা ঘরানার ছায়াছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। নায়ক বা ভিলেন কোনও চরিত্রেই খুব বড় ভূমিকায় তাঁকে মনে না রাখলেও, বাঙালির রান্নায় যেমন হলুদগুঁড়োর ব্যবহার, তেমনই অনস্বীকার্য বাংলা চলচ্চিত্রে অনুপ কুমার নামের এক অনিবার্য অভিনেতার। ১৯৩০ সালের আজকের দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৯৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন। জীবিত থাকলে আজ তাঁর ৯১তম জন্মদিন হতো।

মৃণাল সেন-গীতা সেনের সংসারও চালিয়েছেন বহুদিন নিজের অভিনয়ের অর্থোপার্জন থেকে। তিনি অনুপকুমার। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম বহুমুখী প্রতিভাশালী অভিনেতা, যাঁর ক্ষুরধার অভিনয়ের দীপ্তিতে নিজে ঢাকা পড়ে যাওয়ার ভয়ে স্বয়ং উত্তমকুমার তাঁকে বাদ দিতে বলেছিলেন একটি ছবি থেকে। এমনই অপরিহার্য অদম্য উপস্থিতির বিস্তার ছিল তাঁর। শুধু ক্যামেরার সামনেই নয়, ক্যামেরার পেছনেও ছোট থেকে বড় সকলের কাছেই তিনি ছিলেন ‘অনুদা’। শাম্মি কাপুর ‘মহাশয়’ ছবির শুটিং-এর সময়ে ক্যআমেরা ম্যানকে বলেছিলেন 'আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান। ব্যাপারটা কী হল? অনুপবাবু লাইট নিতে পারছেন না! উনি যেদিন লাইট নিতে পারবেন না, আমি সেদিন ফিল্ম করা ছেড়ে দেব।' এই একটা বাক্যই বুঝিয়ে দেয় ঠিক কতটা ভাল বোঝাপড়া আর ভরসা ছিল কলাকুশলীদের তাঁর ওপর!

Advertisement
রক্তদান করছেন সৌমিত্র। ভানু বন্দ্যোপাধ্যার পাশে দাড়িয়ে দেখছেন অনুপ।

এই 'গার্জেন গিরি'র জন্য শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় অনুপ কুমারের নাম রেখেছিলেন জেঠু। তার পর থেকে অনেকেই তাঁকে জেঠু বলে ডাকতেন। সবাই যেমন ভালবাসত, তেমন ভয়ও করত। সে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহরদা রায় পর্যন্ত।  ওঁরা তো খুব ড্রিংক করতেন, আর অনুপ কুমার ওসবের ধারকাছ দিয়ে যেতেন না। তিনি সামনে থাকলে ভানু-জহরদের কিচ্ছুটি করার উপায় থাকত না। লুকিয়ে চুরিয়ে, ডাবের ভেতর ভরে নিয়ে খেতেন। কত বার হয়েছে, আউটডোরে, কী কোনও কল শো-য় কলকাতার বাইরে যাচ্ছেন। ভানুদা-জহরদার স্ত্রীরা কেবলই তাঁকে বলতেন, “অনুপ, তুমি একটু দেখো বাবা।”

‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ছবিটার কথা মনে পড়ে। এলাহাবাদে গিয়ে শ্যুটিং হয়েছে। আবার হরিদ্বার থেকে শ্যুটিং করতে করতে ফিরেছে ইউনিট। ট্রেনেরই ভেতরে। পাশাপাশি টানা চারটে বগি নিয়ে কাজ। তাতে ভানু পড়েছিলেন মহা সমস্যায়। এত ক্ষণ মদ্যপান না করে থাকতেও পারছে না, আবার অনুপ কুমারের সামনে খেতেও পারছে না। শেষমেশ এক সহ অভিনেত্রীকে বলে ফেলেছিলেন, 'অনুপরে সরা তো এইখান দিয়া, আমি একটু ওই দিকে যামু।'

সুচিত্রা সেন-কে খানিকটা এড়িয়ে চলতেন অনুপ কুমার। তার কারণটা অবশ্য একেবারে অন্য। সুচিত্রা খুব পিছনে লাগতেন ওঁর। ফ্লোরে দেখা হলেই ডাকতেন, 'এই যে ভাল ছেলে, এ দিকে এসো।' কখনও ‘তুই’, কখনও ‘তুমি’। আড্ডায় বসলে সুচিত্রা নাকি ভীষণ আদিরসাত্মক কথা বলতেন। অনুপ কুমার এমনিতে খুব লাজুক প্রকৃতির ছিলেন, তাই ওর অল্পতেই লজ্জায় চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠত। তাই সুচিত্রার সামনে একটু গুটিয়েই থাকতেন অনুপ।

অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে

যে হেতু অর্থাভাবেই অভিনয় জগতে পেশাদারী প্রবেশ, সেহেতু প্রথমদিকে কোন ছবিই ফেরাতেন না অনুপকুমার। নায়ক হওয়ার সুযোগ এলেও, তা ধরে রাখতে পারেননি, কমেডিয়ানের রোলেই ফিরে যেতে হয়েছে তাঁকে। অনুপকুমার নিজে মনে করতেন, তরুণ মজুমদারের ‘বরযাত্রী’ ছবিটি তাঁকে কমেডিয়ানের তকমা দিয়েছিল, তাই যখন কৌতুক চরিত্রে হাঁপিয়ে উঠলেন, তখন সেই তরুণ মজুমদারই তাঁকে ফিরিয়ে আনলেন অন্য অবতারে – ‘পলাতক’, ‘ঠগিনী’, ‘নিমন্ত্রণ’– তিনটি ছবিতেই অনবদ্য নায়ক অনুপ কুমার। আর এই ছবি তিনটির সূত্র ধরেই হয়তো বাংলা ছবির পেতে চলেছিল সন্ধ্যা-অনুপ জুটিকে। কিন্ত বাধ সাধল সাংসারিক দায়িত্ব। শুধু নায়কে চরিত্রের জন্য অপেক্ষা করলে যে চলবে না। অতএব, ভেঙে গেল জুটি।

অন্যদিকে, ‘বসন্ত বিলাপ’ থেকে ‘দাদার কীর্তি’ কিংবা ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘আলোর পিপাসা’, ‘বালিকা বধূ’ – অনুপকুমারের মুকুটে যেন এক একটি স্বর্ণখচিত পালক। আবার তিনিই যখন ‘নূরজাহান’, ‘শ্যামলী’, ‘পরিণীতা’, ‘শ্রেয়সী’ নাটকে মঞ্চ মাতাতেন, বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে এই ‘মঞ্চনারায়ণ’-ই পর্দায় মানুষকে হাসান অবলীলায়। শ্রীরঙ্গম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কুড়ি বছর স্টারের সাথে পুনরায় যুক্ত ছিলেন। একই সঙ্গে গণনাট্য সঙঘের নাট্যকর্মী আন্দোলনের প্রথম সারির মুখও ছিলেন এই মানুষটিই। ছিলেন অসামান্য নাট্য-পরিচালকও। ‘হঠাৎ নবাব’, ‘নূরজাহান’, ‘ইন্দ্রাণী’, খুঁজে ফিরি’ – একের পর এক নাটক নির্দেশনার মধ্য দিয়ে বিচ্ছুরিত হয়েছিল তাঁর পরিচালন দক্ষতা। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের নাট্যদল ‘ভদ্রকালী নাট্যচক্র’। নাটক-সিনেমার কাজ শেষ হলে চলে যেতেন সেখানে। শুধু নাটক পরিচালনাই নয়, অভিনেতাদের মেকাপও করে দিতেন নিজের হাতে। এমনই অবিচ্ছেদ্য টান ছিল তাঁর নাটকের প্রতি।

Advertisement

‘সব্যসাচী’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘কিতনে পাশ কিতনে দূর’, ‘মহাশয়’ মিলে মোট ছয়টি হিন্দি ছবিতেও নিজের দুর্দান্ত অভিনয় প্রতিভার ছাপ রেখেছিলেন অনুপকুমার। করেছিলেন কিছু ওড়িয়া ছবিও। ১৯৬৪ সালে ‘পলাতক’ ছবির জন্য তাঁর ঝুলিতে এল বি এফ জে এ পুরস্কার। ‘নিমন্ত্রণ’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৭১ সালে। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে ‘দীনবন্ধু পুরস্কার’ প্রদান করা হয় তাঁকে।

তরুণ জীবনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব ভাই বোনেদের বিয়ে দিয়েছিলেন। নিজে বিয়ে করেছিলেন সবার শেষে। অভিনেত্রী অলকা গাঙ্গুলীকে। যদিও পারিবারিক দায়িত্ববোধ আজীবন তাঁর পিছু ছাড়েনি। শুধু পরিবার কেন, গোটা ইন্ডাস্ট্রি চিনত পরোপকারী ‘অনুদা’-কে। তাঁর পরোপকার বা দানশীলতার কিছু উদাহরণ তো প্রথমেই উল্লিখিত হয়েছে। খরা বা বন্যা বা মহামারীতে বিপর্যস্ত বাঙালীর পাশে বারবার দাঁড়িয়েছেন এই মানুষটি। অখ্যাত-অনামা সাধারণ ভক্তদের ডাকেও তাঁদের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন চিরকাল।

তবু, হয়তো বাংলা ছবির জগৎ যোগ্য সম্মান দিতে পারেনি এই বর্ণময় অভিনেতা তথা মানবিক অনুপকুমারকে। সেই ক্ষোভ তাঁর নিজের মধ্যেও ছিল। সেই জন্যই ১৯৯৮-র ৩রা সেপ্টেম্বর তাঁরই নির্দেশমতো তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হয়নি। অভিনয় জগতও তাঁকে সীমিত রেখেছে কৌতুকাভিনেতার গণ্ডিতে। অথচ আজীবন একজন শিল্পীশ্রমিক ও ভালমানুষ হিসেবে নিজের সেরাটা দিয়ে গেছেন তিনি। কত ছবিতেই দেখা গেছে নায়ক নায়িকার অভিনয়ের খামতি ভরাট করেছেন অনুপ কুমার। বাংলা সিনেমা তাঁর কাছে চিরঋণী। তবে সেই ঋণ মেটানোর কাজ করেনি বাংলা ইন্ডাস্ট্রি।

 

Advertisement