ভারতের জাতীয় পতাকা (The National Flag of India)-য় পরিবর্তন চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray)। কেন তা চেয়েছিলেন, তার যুক্তিও ছিল তাঁর কাছে। তবে শেষ পর্যন্ত সে কাজ আর এগোয়নি। তিনি কেন জাতীয় পতাকায় বদল চেয়েছিলেন? সত্যজিৎ-গবেষক দেবাশিস মুখোপাধ্য়ায় জানালেন সে ইতিহাস।
শুরুর কথা
সেটা ১৯৬৭ সালের পরের ঘটনা। সত্য়জিৎ রায় (Satyajit Ray) ভারতের জাতীয় পতাকায় কিছু পরিবর্তন চেয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর কাছ থেকে এ ব্যাপারে পরামর্শ চেয়েছিলেন। তিনি নিজের মতামত দিয়েছিলেন।
জাতীয় পতাকার বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভারতের পতাকার প্রথম নকসা করেন ভগিনী নিবেদিতা। সেটি ছিল আয়তাকার লাল রঙের। আর লালের ওপরে কেন্দ্রে হলুদ বজ্র চিহ্ন এবং সাদা পদ্মফুল। নীচে লেখা ছিল 'বন্দেমাতরম'। পরে সেটিও বদল করা হয়। এবং তখন সেটা হয়- মাঝে বজ্র, বাঁদিকে 'বন্দে' এবং ডানদিকে 'মাতরম'। আর তার চারদিকে ১০৮ অগ্নিশিখা। জানাচ্ছেন দেবাশিসবাবু।
শচীন্দ্রপ্রসাদ বসুর তৈরি পতাকা
১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু তৈরি করেন তিন রঙের একটি পতাকা। ওপরে সাদা, মাঝে হলুদ এবং নীচে সবুজ। পতাকার ওপরে ছিল ৮টি পদ্ম এবং নীচে দু'পাশে সূর্য এবং চন্দ্র।
পরে সেটার রঙ বদল করা হয়। ওপরে সবুজ, মাঝে হলুদ এবং নীচে লাল রঙের। এটি 'কলকাতা পতাকা' নামে পরিচিতি পায়।
ভিকাজি কামার তৈরি পতাকা
এর পরের বছর মাদাম ভিকাজি রুস্তম কামা এক পতাকার নকসা তৈরি করেন। সেটির ওপরে সবুজ, মাঝে গেরুয়া এবং নীচ লাল। সবুজের ওপরে ছিল ব্রিটিশ ভারতের ৮টি প্রদেশের প্রতীক হিসেবে ৮টি পদ্মফুল। গেরুয়ার ওপরে দেবনাগরীতে লেখা ছিল 'বন্দেমাতরম'। নীচে দুই কোণায় ছিল চাঁদ আর সূর্য। এই পতাকার নকসায় বীর সাভারকার এবং শ্যামজি কৃষ্ণ বর্মার আবেদনও মনে রাখতে হবে।
পতাকা নিয়ে বিতর্ক
ভারতের পতাকা তৈরির ব্যাপারে অনেকই আগ্রহ দেখান। এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত, বিতর্ক তৈরি হয়। দেবাশিস মুখোপাধ্য়ায় জানান, তাই ১৯৩১ সালের ২ এপ্রিল কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি ৭ সদস্যের এক কমিটি গঠন করে। তখন পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া তিন রঙের পতাকা তৈরি করেন। সেই পতাকাই এখনকার পতাকার উত্তরসূরি। তবে সেখানে আগে ছিল চরকার ছবি। এখন রয়েছে অশোকচক্র।
স্বাধীনতা ঘোষণা
ততদিনে ব্রিটিশরা ঘোষণা করে দিয়েছে ভারত স্বাধীন হচ্ছে। তখন গণপরিষদ পতাকা নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিল। ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই ওই কমিটি আমাদের জাতীয় পতাকা বা তিরঙ্গার অনুমোদন দেয়।
ফের বিতর্কের শুরু
ভারতের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৬৭ সাল নাগাদ সোসালিস্ট দলের নেতা রামমনোহর লোহিয়া কংগ্রেসের পতাকার সঙ্গে জাতীয় পতাকার সাদৃশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এবং এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। সমস্যা সমাধানে তৎপর হন ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi)। তিনি বিভিন্ন দল, শিল্পী এবং বিদ্বজ্জনের কাছে জাতীয় পতাকার সংশোধন বা নতুন পতাকার ব্যাপারে মতামত চান।
মতামত দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়
তখন এ বিষয়ে সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray)-এর মতামত বা 'সাজেশন' চেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi)। তাঁর মত চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। আর তিনি নিজের মত জানিয়েওছিলেন। পরে অবশ্য এই কাজ আর এগোয়নি।
কেমন দেখতে ছিল সত্যজিতের পতাকা?
দেবাশিস মুখোপাধ্যায় জানান, এ ব্য়াপারে কথায় কথায় তিনি ১৯৮০-র দশকে সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray)-এর কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন ' আপনার মতামতটা কী ছিল?'। জবাবে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, আমার মনে হয়েছিল, পতাকার কেন্দ্রে থাকে গোল অশোকচক্র। কিন্তু ওপরে-নীচে আয়তকারে থাকে দু'টি গাঢ় রঙ- গেরুয়া এবং সবুজ। দু'টি সরলরেখায় সাদার সঙ্গে তাদের পৃথক করে রাখা হয়।
ফলে ওই গোল চক্রটি ঠিক বৃত্তাকার মনে হয় না। ওপর-নীচে একটু চাপা লাগে। মানে অশোকচক্রটি তার বৃত্তত্ব হারায়। তাই আমার সাজেশন ছিল, চক্রের ওপর-নীচ যদি একটু কার্ভ করে দেওয়া যায়, তা হলে অশোকচক্রটি সম্পূর্ণ বৃত্তাকার মনে হবে।
পরিবর্তন হল না
১৯৬৭ সালে সেই বিষয়টা চাপা পড়ে গেলেও ১৯৭৭-এ কেন্দ্রে আসে অকংগ্রেসীয় সরকার। ফের বিষয়টি নিয়ে চর্চা হয়। তবে সেই চর্চা, বিতর্ক বেশি দূর এগোয়নি।
পতাকা ছবি সৌজন্য: দেবাশিস মুখোপাধ্যায়