scorecardresearch
 

Chhabi Biswas: ছবি বিশ্বাস না থাকায় কিছু ছবি তৈরিই করেননি সত্যজিৎ

ভারতীয় সিনেমায় ছবি বিশ্বাস (Chhabi Biswas) একজনই ছিলেন। কিছু চরিত্রের তিনি কতটা অপরিহার্য ছিলেন তা স্বয়ং সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) স্বীকার করে গিয়েছেন। মাত্র ৬২ বছর বয়সে তাঁর অকালে চলে যাওয়ার ফলে এই বিশ্ববরেণ্য চিত্রনির্মাতা কিছু ছবি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ ছবি বিশ্বাস ছাড়া সে ছবিগুলি সম্পূর্ণ করার মতো অভিনেতা ছিলেন না।

Advertisement
জলসাঘর ছবিতে ছবি বিশ্বাস জলসাঘর ছবিতে ছবি বিশ্বাস
হাইলাইটস
  • আজকের দিনে ১৯০০ সালে জন্ম ছবি বিশ্বাসের। যদিও তাঁর জন্মের সাল নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কারও মতে তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯০২ সালে।
  • স্বয়ং সত্যজিৎ রায় পরে বলেছিলেন, “ছবিবাবু না থাকলে ‘জলসাঘর’-এর মতো চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হত কিনা জানি না। বোধ হয় না।
  • ১৯৫৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর মাইলস্টোন ছবি তপন সিংহ পরিচালিত 'কাবুলিওয়ালা'। এতেও তিনি নামভূমিকায়। রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে উচ্চ প্রশংসিত এই ছবি।

ছবির মতো সুন্দর ছিলেন। তাই ডাক নাম হয়ে গিয়েছিল ছবি। বাড়ির অন্দর থেকে সেই ডাকনামেই তাঁর নামডাক। ভারতীয় সিনেমায় ছবি বিশ্বাস (Chhabi Biswas) একজনই ছিলেন। কিছু চরিত্রের তিনি কতটা অপরিহার্য ছিলেন তা স্বয়ং সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) স্বীকার করে গিয়েছেন। মাত্র ৬২ বছর বয়সে তাঁর অকালে চলে যাওয়ার ফলে এই বিশ্ববরেণ্য চিত্রনির্মাতা কিছু ছবি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ ছবি বিশ্বাস ছাড়া সে ছবিগুলি সম্পূর্ণ করার মতো অভিনেতা ছিলেন না।

আজকের দিনে ১৯০০ সালে জন্ম ছবি বিশ্বাসের। যদিও তাঁর জন্মের সাল নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কারও মতে তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯০২ সালে। বাবা ভূপতিনাথ বিশ্বাস। মা কাত্যায়নী বিশ্বাস। তাঁর আসল নাম শচীন্দ্রনাথ। কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হলেন ছবি নামেই। ছবি বিশ্বাসের অভিনয় স্পৃহা ছিল ছোট থেকেই। যৌথ পরিবারে ভাই-বোন সবাই মিলে আবৃতি, গান, নাটক উৎসাহ নিয়ে করতেন। পাশাপাশি পড়াশোনাও চলত। মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। হিন্দু স্কুল থেকে পাশ করার পর ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু বন্ধুদের জন্য প্রেসিডেন্সি ছেড়ে গেলেন বিদ্যাসাগর কলেজে।

১৬০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে দিল্লির সম্রাট আকবরের কাছ থেকে ‘বিশ্বাস’ উপাধি পেয়েছিলেন তিতুরাম দে। তাঁর উত্তরপুরুষ রামকান্তের পুত্র চণ্ডীচরণ দে বিশ্বাস ১৭০০ সালে বড় জাগুলিয়া থেকে ২৪ পরগনার বারাসতের ছোট জাগুলিয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। বসতবাড়িটির নাম ‘কালীনিকেতন’। এর পর সামন্ততান্ত্রিক পরিচয়কে পিছনে ফেলে শিক্ষা ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারটি কলকাতায় চলে এল। জাগুলিয়ায় যাতায়াত রইল, তবে সে কেবল পুজো-পার্বণে।

জলসাঘর ছবির শুটিংয়ে সত্যজিতের সঙ্গে ছবি বিশ্বাস

ছবি বিশ্বাস সঙ্গীতচর্চাও করেছিলেন। নাড়া বেঁধেছিলেন ওস্তাদ জামিরুদ্দীন খাঁ সাহেবের কাছে। অভিনয় জীবনের হাতেখড়ি মদন মিত্র লেনে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বৈঠকখানায় বারবেলা বৈঠক ক্লাবে। এখান ছিল শখের অভিনয়। করেছিলেন নাটক ‘ভীষ্ম’। ১৯৩৮-এ নাট্যনিকেতন মঞ্চে পেশাদারি শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ।

Advertisement

সিনেমায় অভিনয় করাটা হঠাৎই। একদিন ছবি বিশ্বাস কর্নওয়ালিস ক্রাউন (উত্তরা) সিনেমার সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় বুকিংয়ে বসেছিলেন পরিচালক প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ডাকলেন ছবি বিশ্বাসকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিনেমা করবেন?’ ছবি বিশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানালেন। পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তী তখন করছিলেন ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’। লম্বা সুদর্শন নায়ক খুঁজছিলেন তিনি। ছবি বিশ্বাসকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন প্রিয়নাথ। পরিচালকের পছন্দ হল ছবি বিশ্বাসকে। কালী ফিল্মসের ব্যানারে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ (১৯৩৬) ছবি বিশ্বাসের প্রথম ছবি।

অভিনয়ের জন্য প্রশংসা পেলেও বেশ কিছু দিন সিনেমার প্রস্তাব তাঁর কাছে আসেনি। কারণ তিনি যে চরিত্রেই অভিনয় করতেন, তাতেই জমিদারি আভিজাত্য ফুটে উঠত। এই সময় নিজের অভিনয়, হাঁটাচলা, বাচনভঙ্গি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন ছবি। বাংলা সিনেমায় যে ক'জন অভিনেতা যাত্রার ছায়া ছেড়ে পর্দার অভিনয়ের আলাদা জগৎ তৈরি করেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রমথেশ বড়ুয়া একেবারে প্রথম সারিতে থাকবেন। একই সঙ্গে থাকবেন ছবি বিশ্বাসও।

বাংলা ছবিতে ছবি বিশ্বাসের আভিজাত্যপূর্ণ চেহারার অভিনেতা আসেননি। আসেননি এমন বড় মাপের অভিনেতা। তিনি ছিলেন একটা যুগ। বাংলা ছবিতে চলনবলন, পোশাকে এনেছিলেন পরিবর্তন। তাঁর অভিনয় ছিল ভীষণই সিনেম্যাটিক। থিয়েটারি প্রভাবকে একেবারে ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন।

আভিজাত্যের সঙ্গে তাঁর কথা দিয়ে কথা রাখার জ্ঞানও ছিল প্রবল। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অভিনয় করানোর জন্যে সত্যজিৎ রায় কথা বলতে গেলেন। চিত্রনাট্য পড়ে বেশ খুশি হলেন ছবি। কিন্তু যেই শুনলেন শুটিংয়ের জন্যে দীর্ঘদিন আউটডোরে থাকতে হবে সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বসলেন। সত্যজিৎ রায়কে তিনি বলেন, 'সোম থেকে বুধ আউটডোরে শুটিং ঠিক আছে কিন্তু বৃহস্পতিবার আমাকে কলকাতা ফিরতেই হবে কারণ প্রত্যেক সপ্তাহে বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার আমার থিয়েটার আছে।' সব শুনে সত্যজিৎ রায় বললেন এটা অসম্ভব। সঙ্গে সঙ্গে তিনিও বলে দিলেন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অভিনয় করা তার পক্ষেও অসম্ভব। খালি হাতে ফিরে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। পর দিন ছবি বিশ্বাস থিয়েটারের সবাইকে জানান এই কথা। শুনে সকলেই অবাক! থিয়েটারের অভিনেতারাই তাকে বোঝালেন, এমন প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। থিয়েটার আসবে যাবে, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় অভিনয়টা ইতিহাসে থেকে যাবে।

শেষে তিনি আবার গেলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অভিনয় করতে সম্মতি জানালেন। আর বাকিটা সত্যিই ইতিহাস হয়ে থেকে গেল। এর পর সত্যজিৎ রায়ের সাথে তিনি ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’,‘পরশপাথর’-এর মতো চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় পরে বলেছিলেন, “ছবিবাবু না থাকলে ‘জলসাঘর’-এর মতো চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হত কিনা জানি না। বোধ হয় না। এক দিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃষ্যকারিতা, অন্য দিকে তাঁর পুত্রবাৎসল্য ও সঙ্গীতপ্রিয়তা এবং সব শেষে তাঁর পতনের ট্র্যাজেডি — একাধারে সবগুলির অভিব্যক্তি একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।”

১৯৫৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর মাইলস্টোন ছবি তপন সিংহ পরিচালিত 'কাবুলিওয়ালা'। এতেও তিনি নামভূমিকায়। রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে উচ্চ প্রশংসিত এই ছবি। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারতে হইচই পড়ে গিয়েছিল। কলকাতার বাইরেও বম্বে, দিল্লি, মাদ্রাজ, পুনে প্রভৃতি জায়গায় 'কাবুলিওয়ালা'র জয়জয়কার। একটি সাক্ষাৎকারে তপন সিংহ বলেছিলেন, "কাবুলিওয়ালা'র প্রতিটি ফ্রেমে অসাধারণ হয়ে ধরা দিয়েছেন ছবি বিশ্বাস। তবুও তার মধ্যে ছবিদার ডবল প্লে করার মুহূর্তটি অনবদ্য, যেখানে কাবুলিওয়ালা মিনিকে প্রথম দেখছে। আর দেখতে দেখতেই সুদূর আফগানিস্তানে তার নিজের মেয়ের কথা ভাবছে। একই দৃশ্যে দুটো দৃশ্য। প্যারালাল শটে বর্তমানকে ধরে অতীতে ফিরে যাওয়ার ওই রূপকল্পনায় ছবিদার অভিনয় অবিস্মরণীয়। ...আমার তো মনে হয় 'কাবুলিওয়ালা' আমার ছবি নয়, ছবি বিশ্বাসের ছবি।"

Advertisement

১৯৬২ সালের ১১ জুন ছোট জাগুলিয়ায় পৈতৃক বাড়িতে যাওয়ার পথে মধ্যমগ্রামের কাছে গঙ্গানগরে যশোর রোডে ছবি বিশ্বাসের গাড়িকে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মালবোঝাই লরি ধাক্কা মারলে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে তিনি নিজেই চালাচ্ছিলেন গাড়িটা। স্টিয়ারিংয়ের ধাক্কায় তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙে যায়। আর জি কর হাসপাতালে আনা হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নির্দেশে পোস্টমর্টেম করা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল তাঁর মরদেহ। এই ঘটনায় সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, "তাঁর অকালমৃত্যুজনিত ক্ষতি আমার কাছে অপরিমেয়, অপূরণীয়। তাঁর উপযুক্ত আরও অনেক চরিত্র, অনেক কাহিনি আমার পরিকল্পনায় ছিল। এ সবই তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার মন থেকে মুছে ফেলে দিতে হয়েছে।"

 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: নও শুধু ছবি/কল্যাণী মণ্ডল

 

Advertisement