মহানায়ক উত্তম কুমার, গায়ক উত্তম কুমার, পরিচালক-প্রযোজক উত্তম কুমার - এ সব নিয়ে বহু কথা, লেখায় বহু নিউজ প্রিন্ট খরচ হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কাটাছেঁড়া কম হয়নি। কখনও কুৎসা রটেছে, কখনও অপবাদ। কিন্তু উত্তম কুমারের মানবিক দিক নিয়ে তেমন একটা আলোচনা শোনা যায়নি। নিঃশব্দে কাউকে না জানিয়ে বহু জায়গায় দান করেছেন উত্তম কুমার। বহু কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার হাতে প্রয়োজনের সময় তুলে দিয়েছেন অর্থ। কিন্তু এ সব গোপন রাখতে চাইতেন মহানায়ক। তাঁর শর্তই থাকত, এ সব কথা যেন পাঁচকান না হয়। কিন্তু কৃতজ্ঞতায় আটকানো জিভ কোনও না কোনও সময় ঠিক খুলে যায়। আর সত্যিটা বেরিয়ে আসে দিনের আলোর মতো। অনেকটা লোকমুখেই প্রচার পেয়েছিল উত্তমের এমন বহু গোপন সাহায্যের কথা, যা তিনি বেঁচে থাকতে কেউ বলেননি।
প্রথম ঘটনা তাঁর সহকর্মী মণি শ্রীমানির মেয়ের বিয়ের কথাই ধরা যাক। চরিত্রাভিনেতা মণি-র মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিন্তু বিয়ের খরচ সামাল দেওয়ার মতো টাকা তাঁর হাতে নেই। কোনও সূত্রে খবর পেলেন উত্তম কুমারের ভাই তরুণ কুমার। দাদাকে গিয়ে সমস্ত কথা জানালেন তরুণ। দুই ভাইয়ের মধ্যে পরামর্শ হল রাতভর। আসল কারণ জানিয়ে সকলের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হলে মণি বাবুর আত্মসম্মানে আঘাত লাগতে পারে, এই ভেবে সে চিন্তা বাতিল করেন উত্তম।।
তার বদলে উত্তমকুমার আর এক অসামান্য অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়-কে নিয়ে এক জমজমাট জলসার আয়োজন করলেন বিশ্বরূপা থিয়েটারে। সঙ্গে ছিলেন তরুন কুমারও। নিজে সমস্ত শিল্পীকে অনুরোধ করেছিলেন উত্তমকুমার। কোনও শিল্পী পারিশ্রমিক নেননি। জলসায় বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে নিয়েও গান গেয়েছিলেন উত্তমকুমার। তবলা সঙ্গতে ছিলেন অসিতবরণ। অনুষ্ঠান থেকে সংগৃহীত অর্থ মণি বাবুর মেয়ের বিয়ের ভার অনেকটাই বহন করেছিল।
দ্বিতীয় ঘটনা লাইট ম্যান কালী-র। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে ‘যদুবংশ’ ছবির শুটিং চলছে। উত্তম কুমার শটের টেকনিকাল বিষয় খু্ব ভালো বুঝতেন এবং খেয়ালও রাখতেন। সে দিনের শুটিংয়ে একটা শটের পর উত্তম কুমার লক্ষ্য করেন সেটের উপর থেকে একটা আলো পড়ার কথা ছিল সেটা জ্বলেনি। সেই আলো জ্বালানোর কথা যাঁর, সেই লাইট ম্যান কালী আনমনা। সেটে কিছু বললেন না উত্তম। শুটিং শেষে তাঁকে মেক-আপ রুমে ডাকেন উত্তম।
ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দাদার শটে এতো বড়ো ভুল। মাথা নিচু করে তিনি গেলেন মেক-আপ রুমে। উত্তম কুমার গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, কিছু হয়েছে?’ মহানায়কের সামনে কেঁদেই ফেলেন কালী। আবার উত্তম জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোকে আজ আনমনা মনে হল কালী,কি হয়েছে রে?’
কাঁদতে কাঁদতেই কালী উত্তর দিয়েছিলেন ‘আমার মেয়ের বিয়ের ঠিক হয়েছে দাদা। এখনও টাকা জোগাড় করতে পারিনি। সেই চিন্তা করতে গিয়ে ভুল হয়ে গেছে দাদা, আর কখনও ভুল হবে না।’ কালীর পিঠে হাত রেখে উত্তমকুমার তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। মুখে আর একটি কথাও বলেননি। পরদিন কালীকে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠান। খামে করে বিয়ের পুরো খরচের টাকা কালীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন উত্তম কুমার।
এমন অজস্র ঘটনা রয়েছে। আরও এখটা বিষয় না লিখলেই নয়, উত্তম কুমার কখনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না। তিনি সুপারস্টার বলে তাঁকে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দিতে হবে, আর বাকি শিল্পীরা বঞ্চিত হবেন, এটা মেনে নিতে পারতেন না উত্তম। হাজারিবাগে ‘জীবনমৃত্যু’ ছবির আউটডোরের ঘটনা। এই ছবির নায়ক-নায়িকা উত্তম-সুপ্রিয়াকে রাখা হয়েছিল বিলাসবহুল সরকারি ডাকবাংলোয়। অন্য দিকে বাকি শিল্পী ও কলাকুশলী রাখা হয়েছিল বাড়ি ভাড়া করে। উত্তম কুমার ছবির প্রযোজককে বলেছিলেন, তিনি আর সুপ্রিয়া দেবী কেন এই ঢাউস বাংলোয় একা থাকবেন? ছবির কাজে আসা সবাই থাকবে এই বাংলোতে।
কিন্তু প্রযোজক তাতে রাজি তাতে রাজি ছিলেন না। সরকারি বাংলোর ভাড়া ছিল অনেক বেশি। তাই অহেতুক খরচ বাড়াতে রাজি ছিলেন না তিনি। নাছোড়বান্দা উত্তম কুমারও। খানিক তর্কবিতর্কের পর উত্তমকুমার বলেন, ছবিতে কাজই করবেন না। মাথায় হাত প্রযোজকের। বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিলেন উত্তমের কথা। ভাঙাচোরা ভাড়াবাড়ি ছেড়ে বাকি টিম উঠে এল বিলাসবহুল ডাকবাংলোয়। শ্যুটিং শেষে রোজ জমজমাট আড্ডা হত। মধ্যমনি হিসাবে থাকতেন উত্তম কুমার।
একবার রাজ্যপালের আমন্ত্রণে নৈশাহারে যাচ্ছিলে ভাই তরুণের সঙ্গে। উত্তম কুমারের খেয়াল ছিল না সেই একই দিনে এক টেকনিশিয়ানের মেয়ের বিয়ে রয়েছে এবং তিনি যাবেন এমনটা কথা দিয়েছিলেন। রাজভবনের গেটের সামনে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা টালিগঞ্জে সেই বিয়ে বাড়িতে পৌঁছেছিলেন হাতে উপহার নিয়ে। নবযুগলকে আশীর্বাদ করে তার পর ফিরে গিয়েছিলেন রাজ্যপালের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে।
উত্তমের পাড়া ভবানীপুরে দুর্গাপুজোর সময় একবার মণ্ডপে আগুন লেগে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ষষ্ঠীর আগের দিন। প্যান্ডেল থেকে প্রতিমা কোনও কিছুই রক্ষা পায়নি। পাড়ার সকলের মন খারাপ। পুজোর দিনে মণ্ডপের জায়গাটা খা খা করবে এই ভাবনা নিয়েই সকলে বাড়ি ফিরে যান। পর দিন সকালে বাইরে বেরিয়ে দেখেন ভোজবাজির খেল! নতুন মণ্ডপ, নতুন প্রতিমা, আলোর রোশনাইয়ের ব্যবস্থায় পুরনো জেল্লা ফিরে এসেছে। কী ভাবে হল এই ঘটনা তখন জানা যায়নি।
এর বহু বছর পর অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায় এর পিছনের রহস্য ফাঁস করেন। অনেক রাত করে শুটিং সেরে বাড়ি ফেরার পথে পথে এই দৃশ্য চোখে পড়ে মহানায়কের। তিনি গাড়ি থেকে নেমে সটান পাড়ার গুটিকতক ছেলের সামনে আসেন। এবং বলেন, তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন এবং পুজোর জন্য যাবতীয় খরচ বহন করবেন। কিন্তু কথা যেন প্রকাশ না হয়। পাড়ার ছেলেরা সেই কথা রাজি হন। তাতেই ধুমধাম করে হয়েছিল পুজো।
উত্তম যতটা প্রচারের আলোয় থেকেছেন, তাঁর এই মানবিকগুলো ততটা থাকেনি। সে কারণেই হয়তো অনেকে এ সমস্ত ঘটনা জানেন না। বা কখনও এ সমস্ত ঘটনা আলোচনায় উঠে আসেনি।
কৃতজ্ঞতা: মহানায়ক উত্তমকুমার, সপ্তর্ষি প্রকাশন, ইন্টারনেট