'মহারাজা..... তোমারে সেলাম... সেলাম সেলাম সেলাম...'
সত্যজিৎ রায়কে মহারাজা বলে অনেকেই সেলাম করেন। কিন্তু যাঁর মুখ থেকে এই গান প্রথম শোনা, সেই ব্যক্তিকেও একটু কাছ থেকে চেনা প্রয়োজন বাঙালির। তপেন চট্টোপাধ্যায়। তিনি গুপীর জন্য সারাজীবন বাঙালির মননের সঙ্গে জড়ে গিয়েছেন। কিন্তু গুপী বাদ দিয়েও ব্যক্তি তপেন একজন আদ্যোপান্ত দায়িত্ববান ভদ্রলোক এবং আমুদে মানুষ ছিলেন, সে কথাও জানা প্রয়োজন বাঙালির। অত্যন্ত ঝেড়েবেছে সিনেমার চরিত্র বাছতেন তপেন। তাই তপেনের ফিল্মোগ্রাফিতে ১৮টির বেশি ছবির নাম নেই। কিন্তু ওই তালিকায় চোখ রাখলে বোঝা যাবে, তিনি যে কটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তার মধ্যে অনেকগুলি কাল্টের তকমা পেয়েছে।
তপেন চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, কালীঘাটের মাইশোর রোডের বাড়িতে। নলিনীরঞ্জন ও শোভনাদেবীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে তপেন ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁরা তিন ভাই ও দুই বোন। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক তপেন চট্টোপাধ্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা রাজেন্দ্র বিদ্যাভবনে। ছোট থেকেই অভিনয়ের দিকে ঝোঁক ছিল। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তপেন প্রথম মঞ্চে পা দিলেন, নাটকের নাম ‘অচলায়তন’। ছোট্ট চরিত্র হলেও দর্শকের মনে দাগ কেটে গিয়েছিল তাঁর অভিনয়। শীতকালে বা পুজোর সময় সেই নাটকের জন্যই ডাক পড়ত তপেনের। পরে শেখর চট্টোপাধ্যায়ের গ্রুপ থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন।
অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার তপেন খুব কম বয়সে এক সময়ে রাজস্থানের বিকানেরে চাকরি করতেন। সেখানকার জিপসাম মাইনস-এ রোজ দু’ টাকা দু’ আনা পারিশ্রমিক মিলত। বছর দুই চাকরি করার পর কলকাতায় ফিরলেন তিনি। তখনও কি জানতেন, এই রাজস্থানে এসই তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ চরিত্রের জন্য শুটিং করবেন, তা-ও সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায়!
তপেন চট্টোপাধ্যায়ের কাকা ছিলেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সেই সুবাদে তাঁদের বাড়িতে প্রায়ই কবিদের আড্ডা বসত। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র, সমর সেনরা তো থাকতেনই, সঙ্গে থাকতেন সত্যজিৎ রায়। সেখানেই তিনি প্রথম দেখেন গুপীকে। যদিও সে সময় ছবির কোনও স্ক্রিপ্ট তৈরি ছিল না।
সত্যজিত রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায় তাঁর স্মৃতিচারণা আমাদের কথায় লিখেছিলেন, 'বাঘার চরিত্রে রবিকে (রবি ঘোষ) নেওয়া প্রথম থেকেই ঠিক ছিল, কিন্তু গুপীর চরিত্রে কাকে নেবেন, মানিক ভেবে কিছুতেই ঠিক করতে পারছিলেন না। অনেক দেখানো হল, এমনকী একজনের স্ক্রিন টেস্ট নেওয়া হয়েছিল রবির সঙ্গে, যিনি এক ডেলি পেপারের সম্পাদক ছিলেন। কোনও ফল হয়নি।
চঞ্চলবাবুর (চঞ্চল চট্টোপাধ্যায়) ভাইয়ের ছেলে তপেন আমাদের বাড়িতে মাঝেসাঝে আসত। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে প্রথম দিকে ছিল। মানিক তাঁর অভ্যাস মতো গুপীর চরিত্রে যে-ধরনের মুখ ওঁর চাই, সেটা এঁকে রেখেছিলেন। চেহারার মধ্যে একটা গ্রাম্য ভাব থাকবে, বেশি চালাক চটপটে নয়। ভাগ্যক্রমে একদিন তপেন আমাদের বাড়িতে এসেছিল। মানিকের ঘরে ঢুকতেই মানিক ওর দিকে ফিরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ‘এই তো পেয়ে গেছি’ গোছের ভাব। তপেন এর আগে ‘মহানগর’ ছবিতে একটা ছোট্ট ভূমিকায় নেমেছিল।
তপেন আমাকে পরে বলেছিল, মানিক যখন ওকে জানালেন, ‘গুপী’-র চরিত্রর জন্য ওকে ভাবা হচ্ছে, তখন তপেন এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, বিশ্বাস করতে পারছিল না। যখন জানতে পারল যে, ওর মুখের সঙ্গে গুপীর মুখ প্রায় মিলে গেছে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে ফিরতে পারেনি। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চোখের জল চেপে রাখতে চেষ্টা করেছিল। প্রথমবারের পক্ষে তপেন সত্যি অসাধারণ অভিনয় করেছিল এবং বি.এফ.জে.এ-তে সর্বশ্রেষ্ঠ নতুন অভিনেতার জন্য পুরস্কৃতও হয়েছিল।'
গুগাবাবা মুক্তি পাওয়ার পর তো রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন ছবির দুই কীর্তিমান। ছবির মুক্তির ঘটনা নিয়ে বিজয়া রায় ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেছেন, “২৪ নভেম্বর ১৯৬৮ দিনটি মনে রাখার মতো। কারণ সকালে ‘গুগাবাবা’ দেখানো হল। এক কথায় সুপার্ব।” ৩০ নভেম্বর ১৯৬৮ তিনি লিখছেন, “প্রিয়াতে আবার ‘গুগাবাবা’ দেখানো হল। তুলনা হয় না। বারবার দেখেও আশ মিটবে না”। পরে এ কথা তিনি ‘আমাদের কথা’য় উল্লেখ করেছেন। কাজেই এ ছবি মুক্তি পাওয়ার পর তপেন চট্টোপাধ্যায়ের ‘গুপী’ নামেই তুমুল খ্যাতি মিলল। এমনকী বার্লিন থেকে ‘গুগাবাবা’র আমন্ত্রণ এল। সত্যজিৎ-বিজয়া ছাড়াও রবি ও তপেনকেও যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
সংবাদমাধ্যমে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তপেন চট্টোপাধ্যায় স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এক বার বলেছিলেন, “হঠাৎ এক দিন মানিকদা সিগারেট অফার করলেন। আমি তো কিন্তু কিন্তু করছি। উনি বললেন খাও না নাকি? খাও খাও মরবে না। তুমি জন্মেছ গুপী করার জন্য।” ঠিকই বলেছিলেন সত্যজিৎ। চরিত্রের নামে যদি কোনও অভিনেতা পরিচিতি লাভ করেন, তখন ধরে নিতেই হবে, সেই চরিত্র আর অভিনেতা মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছেন। ২০১০ সালে আজকের দিনে হৃদরোগে আক্রান্ত গুপী সত্যিই 'বহুদূর' চলে গিয়েছিলেন। সময়কে থামিয়ে বলেছিলেন, 'র র র... কোমরটা ধইরে গ্যাসে গো... যা যা... গেরামে ফিরে যা।'