ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে একাধিক কিংবদন্তির জন্ম হয়েছে, তবে বিরাট কোহলি একজন এমন ব্যাটসম্যান, যিনি শুধু সাদা বলের ক্রিকেটে নন, লাল বলেও ভারতের গর্ব হয়ে উঠেছেন। তাঁর টেস্ট কেরিয়ারে রয়েছে এমন কিছু ইনিংস, যা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।
এই প্রতিবেদনে আমরা ফিরে দেখব বিরাট কোহলির ছয়টি সেরা টেস্ট ইনিংস, যেগুলি শুধু রানের হিসাবেই নয়, মানসিক দৃঢ়তা, নেতৃত্ব, এবং বিদেশের কঠিন কন্ডিশনে জ্বলে ওঠার গল্প বলে।
২০১৩ সালে প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েই কোহলি বুঝিয়ে দেন যে তিনি টেস্ট ক্রিকেটে এসেছেন রাজত্ব করতে। জোহানেসবার্গের বাউন্সি উইকেটে, ডেল স্টেইন, ভারনন ফিল্যান্ডার, এবং মর্নে মর্কেলের মতো ভয়ঙ্কর বোলারদের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে ১১৯ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৬ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলেন তিনি। এই ম্যাচেই ভারত ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারত, কিন্তু শেষমেশ তা ড্র হয়। তবে কোহলির ব্যাটিং পারফরম্যান্স সকলের নজর কাড়ে এবং তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন ভারতের নতুন টেস্ট স্তম্ভ।
এই ম্যাচটি ছিল কোহলির জীবনে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। মহেন্দ্র সিং ধোনির অনুপস্থিতিতে প্রথমবার টেস্ট অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পান তিনি। অ্যাডিলেডের সমতল উইকেটে প্রথম ইনিংসে ১১৫ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ১৪১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন কোহলি।
দ্বিতীয় ইনিংসটি ছিল আরও বেশি সাহসী। ম্যাচ জয়ের আশায় আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করেন কোহলি, যদিও শেষমেশ ভারতের পরাজয় ঘটে ৪৮ রানে। তবুও, কোহলির আগ্রাসী মানসিকতা ও নেতৃত্বের পরিচয় ছিল এই ম্যাচেই।
ঘরের মাঠে খেলার বাড়তি সুবিধা থাকলেও ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মুম্বই টেস্টে কোহলির ২৩৫ রানের ইনিংস ছিল অবিশ্বাস্য। স্পিন-বান্ধব উইকেটেও তাঁর নির্ভার ব্যাটিং, চমৎকার ফুটওয়ার্ক, এবং ধৈর্য ছিল দেখার মতো।
এই ইনিংসের জোরেই ভারত করে ৬৩১ রান এবং ইনিংস ও ১৩০ রানে জিতে সিরিজটিও নিজের করে নেয়। ওই বছরই কোহলি টানা তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি করেন, যা ছিল ভারতের কোনও অধিনায়কের পক্ষ থেকে প্রথমবার।
২০১৪ সালের ইংল্যান্ড সফরে ব্যর্থতার পর ২০১৮ সালে সকলের চোখ ছিল কোহলির দিকে। এজবাস্টনের প্রথম টেস্টেই সেই প্রত্যাবর্তনের জবাব দিয়ে দেন বিরাট। কঠিন কন্ডিশনে, সুইং ও সিমে নাচানো বলের বিরুদ্ধে জেমস অ্যান্ডারসন ও স্টুয়ার্ট ব্রডের বোলিং সামলে ১৪৯ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংস খেলেন।
ভারতের একের পর এক উইকেট পড়ছিল, কিন্তু কোহলি একাই টিকেছিলেন এবং টেলএন্ডারদের নিয়ে দলকে প্রায় জয়ের মুখে পৌঁছে দেন। যদিও ভারত ৩১ রানে ম্যাচ হারে, কিন্তু কোহলির ইনিংস ক্রিকেটবিশ্বে দারুণ প্রশংসিত হয়।
২০১৯ সালের এই ইনিংসটিই কোহলির টেস্ট ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পুনে টেস্টে তিনি অপরাজিত ২৫৪ রান করেন। তাঁর এই ইনিংসটি ছিল কার্যত এক প্রদর্শনী, কীভাবে ধৈর্য, কৌশল ও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং মিলিয়ে একটি ইনিংস খেলতে হয়।
৩৩টি চার ও ২টি ছক্কায় ভরা ছিল ইনিংসটি, আর এই ইনিংসের সাহায্যে ভারত ৬০১/৫ স্কোর করে ইনিংস ও ১৩৭ রানে ম্যাচটি জিতে নেয়। এই ইনিংস প্রমাণ করে দেয়, কেন কোহলি শুধু দলের নেতা নন, বরং ভারতের ব্যাটিং ব্যাকবোন।
বিরাট কোহলির টেস্ট ইনিংসগুলো শুধুই রানের খতিয়ান নয়। প্রতিটি ইনিংসের পিছনে রয়েছে মানসিক শক্তি, নেতৃত্বের ছাপ, কঠিন কন্ডিশনের বিরুদ্ধে জেদ, এবং দেশের জন্য কিছু করে দেখানোর অদম্য ইচ্ছা।
এই ছয়টি ইনিংসই প্রমাণ করে, বিরাট কোহলি ভারতের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে শুধু সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন নন, বরং একজন যোদ্ধাও— যিনি ব্যাট হাতে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন যতক্ষণ না জয়ের আশা থাকে।
কিং কোহলি শুধুই একজন ব্যাটসম্যান নন, একজন অনুপ্রেরণা