অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ় জয় করার পর ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্ব। মহম্মদ সিরাজ, ঋষভ পান্থ কিংবা শুভমান গিলদের ভয়ডরহীন আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করেই ব্রিসবেন টেস্ট ম্যাচ জয় করেছে ভারতের তরুণ তুর্কিরা। তবে এই সিরিজ় জয়ের পরেই আরও একজনের নাম বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় যথেষ্ট প্রশংসিত হচ্ছে। তিনি আর কেউ নন, ভারতীয় ক্রিকেট দলের এই নবীন ব্রিগেডের গুরু দ্রোনাচার্য। তিনি রাহুল শরৎ দ্রাবিড়। বলতে বাধা নেই, দ্রাবিড়ীয় সভ্যতাতেই ভারতীয় ক্রিকেটের এই নবজাগরণ ঘটেছে।
ভারতীয় ক্রিকেট দলে যখন খেলতেন, তখন বেশিরভাগ সময়েই তিনি প্রচারের আড়ালে থাকতে পছন্দ করতেন। সৌরভ, সচিনদের তুলনায় কিছুটা নিভৃতেই থাকতেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের এই কঠিন দেওয়াল। ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরেও একইরকমভাবে প্রচারের আড়ালে থেকে কাজ করে গেছেন তিনি। প্রথমে ভারতীয় 'এ' ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে নিজের হাতে এই তরুণ ক্রিকেটারদের তৈরি করেছেন। আর এখন বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে তিনি দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
আসুন তাহলে দেখে নেওয়া যাক, সদ্য সমাপ্ত অস্ট্রেলিয়া সফরে রাহুল দ্রাবিড়ের হাত ধরে উঠে আসা এই পাঁচ ক্রিকেটারের সাফল্যের কাহিনী --
চেতেশ্বর পূজারা :
ভারতের এই তরুণ তুর্কিদের মধ্যে সবথেকে বেশি প্রভাবিত করেছেন দলের ওপেনার চেতেশ্বর পূজারা। সিরিজ়ের চারটে ম্যাচেই পূজারাকে খেলতে দেখতে পাওয়া গেছে। তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে পূজারার কাজটাই ছিল অজ়ি বোলারদের একেবারে ক্লান্ত করে দেওয়া। সেই কাজটা তিনি দারুণভাবে পালন করেছেন। অনেকে তো তাঁকেই রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেছেন।
ব্রিসবেন টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে পূজারা ২১১ বল খেলে ৫৬ রান করেন। তিনি একটা দিক ধরে রেখেছিলেন বলেই ঋষভ পান্থ, অজিঙ্কা রাহানে কিংবা শুভমান গিলের মতো ক্রিকেটাররা অন্যদিকে থেকে অজ়ি বোলারদের আক্রমণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
এই নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কোনও ইনিংসে মোট ছ'বার পূজারা ২০০-র বেশি বল খেললেন। ইতিপূর্বে বিরাট কোহলি পাঁচবার এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। শুধুমাত্র পূজারাই তাঁকে টপকাতে পেরেছেন।
ঋষভ পান্থ :
দ্রাবিড়ের কোচিং থেকে উঠে আসা আরও এক ক্রিকেটার হলেন ঋষভ পান্থ। ২০২০-২১ মরশুমে বর্ডার-গাভাসকার ট্রফিতে তিনি যে পারফরম্যান্সটা করলেন, তাতে আগামীদিনে দলের চূড়ান্ত একাদশে তাঁর জায়গাটা যে পাকা হয়ে গেল, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এমনকী, ২০১৮-১৯ মরশুমেও সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে একটি স্মরণীয় শতরান করেছিলেন পান্থ।
এই সিরিজ়ে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ৯৭ রান করে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে পরাজয়ের লজ্জা থেকে বাঁচিয়ে দেন। এরপর গাব্বাতেও তিনি ৮৯ রানে অপরাজিত থাকেন এবং ভারতীয় ক্রিকেট দল ঐতিহাসিক জয়লাভ করে।
এই প্রসঙ্গে আপনাদের একটা তথ্য দিয়ে রাখি। ঋষভই ভারতীয় ক্রিকেট দলের একমাত্র উইকেটরক্ষক যিনি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট ম্যাচে তিনবার ৫০-এর বেশি রান করেছেন।
হনুমা বিহারী
২০২০-২১ মরশুমের বর্ডার-গাভাসকার ট্রফিতে অ্যাডিলেড এবং মেলবোর্ন টেস্টে খুব একটা ভালো পারফরম্যান্স করতে পারেননি হনুমা বিহারী। এমনকী ভারতীয় ক্রিকেট দলে তাঁকে রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। কিন্তু, সিডনি টেস্টের পর গোটা ছবিটাই একেবারে বদলে গেল। হ্যামস্ট্রিং পেশিতে চোট নিয়েই ২৭ বছর বয়সি ক্রিকেটার দেখিয়ে দিলে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করা কাকে বলে। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সঙ্গে তিনি প্রায় আড়াই ঘণ্টা ব্যাট করেন। অস্ট্রেলিয়ার ৪০৭ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখে ভারতীয় দলের অলআউট হওয়া কার্যত তিনি রক্ষা করেছিলেন দাঁড়িয়েছিলেন দূর্গ হয়ে।
শুভমান গিল :
ভারতীয় ক্রিকেট দলের চূড়ান্ত একাদশে প্রবেশ করা শুভমান গিলের কাছে খুব একটা সহজ ছিল না। কারণ তাঁর আগে নির্বাচকদের পছন্দের তালিকায় ছিলেন পৃথ্বী শ, রোহিত শর্মা এবং ময়াঙ্ক আগরওয়াল। কিন্তু, অ্যাডিলেড টেস্টে পৃথ্বীর খারাপ ফর্মের কারণে তাঁকে দ্বিতীয় টেস্টে বাইরে রাখা হয়। এদিকে তখনও ভারতীয় দলের সঙ্গে যোগ দেননি রোহিত শর্মা। ফলে একমাত্র বিকল্প হিসেবে শুভমানই ছিলেন ওপেনারের তালিকায়। আর সুযোগ পেয়ে যে কামালটা তিনি করলেন, সেটা ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
অভিষেক টেস্ট ম্যাচেই তিনি ৪৫ রান করে সকলকে অভিভূত করে দেন। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে শুভমান তৃতীয় ভারতীয় ওপেনার যিনি এত রান করলেন। তবে সিডনি টেস্টে শুভমানের প্রতিভা একেবারে বিচ্ছুরিত হল। তিনি অস্ট্রেলিয়ার ওই আগুনঝরা বোলিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অসাধারণ একটা হাফসেঞ্চুরি করলেন। সেইসঙ্গে গড়লেন একটি রেকর্ডও। শুভমান ভারতের সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার যিনি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ৫০+ রান করলেন। এরপর আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারতীয় ক্রিকেট দলের ওপেনার হিসেবে গিল নিজের জায়গাটা পাকা করে ফেলেছেন।
মহম্মদ সিরাজ :
সিডনি টেস্ট শুরু হওয়ার আগে জাতীয় সঙ্গীত চলার সময় মহম্মদ সিরাজের সেই চোখের জলের কথা আপনাদের মনে আছে তো? নিশ্চয়ই মনে থাকারই কথা। নিজের বাবাকে হারিয়েও অস্ট্রেলিয়ায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই মনের অদম্য জেদ দ্রাবিড় ছাড়া আর কার কাছ থেকেই বা আসতে পারে। তাঁর বাবা একজন সাধারণ অটোচালক ছিলেন। নিজের ছেলের স্বপ্নপূরণ করার জন্য কোনও কসুর করেননি। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরাজ পা রাখার কয়েকদিন পরেই তাঁর বাবা মারা যান। এমনকী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকেও তাঁকে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, দেশের হয়ে খেলাটা তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বক্সিং ডে টেস্টে অভিষেক করার পর সিরাজকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি শুধুমাত্র জসপ্রীত বুমরাহের অনুপস্থিতিতে ভারতীয় বোলিং ব্রিগেডকে নেতৃত্বই দেননি, বর্ডার-গাভাসকার ট্রফিতে ভারতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটও শিকার করেন। তিনটে টেস্ট ম্যাচে তিনি মোট ১৩টি উইকেট শিকার করেছেন। ২০০৩ সালে জ়াহির খানের পর ব্রিসবেনে সিরাজই প্রথম ভারতীয় বোলার যিনি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এক ইনিংসে পাঁচটি উইকেট শিকার করেন।