ক্রিকেট মাঠে মৃত্যু নতুন কোনও ঘটনা নয়। এই প্রসঙ্গটা উঠলেই বারংবার আমাদের চোখের সামনে ফিল হিউজেসের স্মৃতিটা ভেসে আসে। কিন্তু, ভারতীয় ক্রিকেট দলেও এমন একজন খেলোয়াড় ছিলেন, যিনি ম্য়াচ চলাকালীন ফিল্ডিং করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। আমরা রমন লাম্বার কথাই আলোচনা করছি। ১৯৯৮ সালে আজকের দিনেই লাম্বা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
ক্রিকেটার হিসেবে যথেষ্ট আক্রমণাত্মক মেজাজের ছিলেন রমন লাম্বা। জাতীয় ক্রিকেট দলে তাঁর অভিষেকটাও যথেষ্ট ঈর্ষনীয়ভাবে হয়েছিল। ১৯৮৬-৮৭ মরশুমে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ছ'টি একদিনের ম্যাচে তিনি একটি সেঞ্চুরি এবং দুটো হাফসেঞ্চুরি করেছিলেন। কিন্তু, পরের পাঁচটা একদিনের ম্যাচে তিনি মাত্র ৮ রান করতে পেরেছিলেন। আর আটের দশকের শেষদিকে বেশ কয়েকটা সুযোগ তিনি পেলেও একটাকেও তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর আধিপত্য বজায় থাকলেও চারটে টেস্ট ম্যাচে তিনি কিছুই করতে পারেননি। এরপর তাঁকে আর জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ দেওয়া হয়নি।
এরপর তিনি আয়ারল্যান্ডে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে চলে যান। সেখানে একজন আইরিশ মহিলাকে বিয়েও করেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশেও ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন চুটিয়ে। তখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জায়গা হয়নি বাংলাদেশের। পূর্ববঙ্গের ক্রিকেট ক্লাবগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রিকেটারদের ভাড়া করে টুর্নামেন্টের আয়োজন করত। বেশ কয়েকজন বিদেশি তারকা এই টুর্নামেন্টে নাম করেছিলেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে প্রথমবার ক্রিকেট খেলতে আসেন রমন লাম্বা। তাঁকে সেইসময় ঢাকার ডন বলা হত।
Had *that* incident not taken place, Raman Lamba would have turned 59 today.
Lamba was a childhood hero.
slightly unusual one, but eye-witnesses will probably see reason in this.
I had grown up on stories about Pataudi and Jaisimha and Engineer and Baig.
+ pic.twitter.com/e3DaDcRMk0— Abhishek Mukherjee (@SachinAzharCT) (@ovshake42) January 2, 2021Advertisement
এরপর কেটে গেছে সাত বছর। সালটা ১৯৯৮, তারিখ হল ২০ ফেব্রুয়ারি। আবাহনী ক্রীড়া চক্রের হয়ে ফিল্ডিং করতে নেমেছিলেন লাম্বা। খেলা চলছিল মহমেডান স্পোর্টিংয়ের বিরুদ্ধে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ওই ম্যাচটি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয়েছিল। লাম্বাকে বাউন্ডারি লাইন থেকে সরিয়ে এনে শর্ট লেগে ফিল্ডিং করতে বলা হয়েছিল।
নিয়মিত অধিনায়কের পরিবর্তে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের অধিনায়ক ছিলেন খালেদ মাসুদ। ইএসপিএন ক্রিকইনফো'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, "আমি এক ওভারের জন্য বাঁহাতি স্পিনারকে আক্রমণে এনেছিলাম। তিন বলের পর আমি ফিল্ডিং কিছুটা বদল করি। আমি তাকাতেই চোখে পড়ে রমন লাম্বাকে। আমি তাঁকে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিই।" মাসুদ তাঁকে হেলমেট পরার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে রমন জানান যে "তিনটে বলই তো আর বাকি আছে, কোনও অসুবিধে হবে না।"
এরপর সইফুল্লা খানের শর্ট ডেলিভারিতে পুল শট মারেন মেহরাব হোসেন। শটটা যথেষ্ট জোরে ছিল, বল লাগে লাম্বার কপাল বরবার। বলটা এতটাই জোরে আঘাত করেছিল যে সেটা ফিরে আবার আবাহনীর উইকেটরক্ষক মাসুদের কাছে চলে যায়। তিনি সেই ক্যাচটি ধরেছিলেন। মাসুদ বলেন, "আমি জানতাম মেহরাব আউট ছিল। কিন্তু, যখন অন্য ক্রিকেটাররা আমাকে ঘিরে আনন্দ করছিল, আমার চোখ রামনের দিকে যায়। ও মাটিতে শুয়ে ছিল।"
এরপর ধীরে ধীরে মাটি থেকে ওঠেন লাম্বা। তিনি দলের সতীর্থদের জানান যে সুস্থই আছেন। এরপর ধীরে ধীরে মাঠ ছেড়ে ড্রেসিংরুমের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। দলের চিকিৎসক তাঁকে ড্রেসিংরুমে শুয়ে থাকার পরামর্শ দেন এবম প্রচুর জল খেতে বলেছিলেন। কিন্তু, কয়েক মিনিটের মধ্যেই রামন দলের বাকী সতীর্থদের জানান যে তাঁর শরীর খারাপ লাগছে। সেইসময় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাস্তাতেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, তাঁর মস্তিষ্কের বাঁদিকে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। সেটা অপরেশনও করা হয়। দিল্লি থেকে এক চিকিৎসককেও উড়িয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু, তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন রমনকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়।
Today is the 20th anniversary of the death of @bcci & @Irelandcricket international Raman Lamba. https://t.co/bsU8WkwerQ pic.twitter.com/T9ANx0f0Wp
— Barry Chambers (@irishcricket1) February 22, 2018
এরপর তিনদিন হাসপাতালের বিছানায় কোমায় পড়েছিলেন তিনি। কৃত্রিমভাবে তাঁকে যন্ত্রের সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। পরিবারের সম্মতিতেই সেই যন্ত্র অবশেষে খুলে দেন চিকিৎসকেরা। দিল্লি থেকে বিমানে চেপে বাংলাদেশে আসেন তাঁর স্ত্রী কিম। সঙ্গে ছিল তাঁদের পাঁচ বছরের ছেলে এবং তিন বছরের মেয়ে।
পরবর্তীকালে মাসুদ জানান, "তাঁকে প্রথমে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু, ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। সেইসময় চিকিৎসা পরিষেবা অতটাও উন্নত না হওয়ার কারণে অবশেষে লাম্বা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।"
ওই সময় ভারতীয় ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার কপিল দেব বলেছিলেন, "রমনের মৃত্যুটা আমাদের সবাইকেই ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, গোটা পৃথিবীটাই যেন পায়ের তলা থেকে সরে গেছে। এটা প্রত্যেকটা ক্রিকেটারের কাছে একটা শিক্ষা ছিল। এমন ট্র্যাজেডি আটকানোর জন্য এরপর থেকে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হত।"
Oldest players to score a triple century in Indian F/C cricket.
— Rohit Bahirwani (@bahirwani_rohit) January 21, 2020
1) Raman Lamba: 35 yrs
2) Manoj Tiwary: 34 yrs & 67 days
3) Sagun Kamat: 33 yrs & 163 days
4) Aakash Chopra: 33 yrs & 89 days
5) Sunil Gavaskar: 32 yrs & 232 days
"Old is GOLD" @cricketaakash sir.
Continued.
তবে এই ঘটনায় সবথেকে বেশি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন মেহরাব। তিনি বলেন, "এই ঘটনার পর আমি ২-৩ রাত ঘুমোতে পারিনি।"
বাংলাদেশের প্রাক্তন অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম ওই সময় নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, লাম্বা মনেপ্রাণে চাইতেন বাংলাদেশ যাতে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনায় একটা জায়গা পায়। আজ যদি লাম্বা বেঁচে থাকত, তাহলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই উন্নতি দেখে ও মনেপ্রাণে খুশি হত। ও আমাদের প্রত্যেকেরই খুব প্রিয় ছিল। আমাদের অন্যতম কাছের বন্ধু ছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ওর অবদান অনস্বীকার্য। আজও আমি যখন রমন লাম্বাকে নিয়ে কোথাও লিখতে বসি, তখন আমার চোখে জল চলে আসে।