উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমা অঞ্চলে তৈরি হয় মেখলি। মেখলি একসময় সেখানে বেশ জনপ্রিয় ছিল। এই মেখলি থেকেই এসেছে মেখলিগঞ্জের নাম। কালের নিয়মে আধুনিক সব সামগ্রীর সঙ্গে পেরে উঠছে না এই মেখলি। তবুও মেখলিগঞ্জের নাম ধরে রাখতে সেখানকার বহু মহিলা এখনও মেখলির চর্চায় মেতে আছেন। মেখলিগঞ্জের এই নামকরণের পেছনে রয়েছে মেখলিশিল্প। মেখলিগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করেছেন, তাঁদের অনেকের কলমেই বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে মেখলিশিল্প থেকে মেখলিগঞ্জ নামকরণের কথা।
কোচবিহারের বিস্তীর্ণ এলাকাতেই পাট উৎপাদিত হয় প্রচুর পরিমাণে। পাট থেকে বের করা সুতো দিয়ে মেশিনের সাহায্যে তৈরি করা হয় বিছানার চাদর থেকে শুরু করে ব্যাগ, মোবাইলের খাপ, পাপোশ সহ ঘর সাজানোর অনেক উপকরণ। সেই পাট থেকে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির এই পদ্ধতির নাম - মেখলি।
কবে শুরু এই মেখলির কাজ, তা সঠিক বলা যায় না। তবে জানা যায়, কোচবিহারের রাজার আগের সময়ের অনেক আগেই তা শুরু হয়েছিল। মেখলিগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে প্রাচীন এই শিল্পকলার চর্চা আজও আছে। কুচলিবাড়ি, বাগডগরা, ফুলকাডাবরি, নিজতরফ, ভোটবাড়ি প্রভৃতি অঞ্চল রয়েছে। বিভিন্ন বাড়িতে গ্রামের মহিলারা কাজের ফাঁকে পাট থেকে সুতো বের করে এর কাজে নামেন।
একসময় কোচবিহারের মেখলিগঞ্জে ব্যাপকমাত্রায় পাট চাষ হত। অতিরিক্ত পাট থেকে সুতো তৈরি করে বিভিন্ন জিনিস বানাতে শুরু করেন স্থানীয়রা। এখনকার প্লাস্টিকের মতো সহজলভ্য বিকল্প জিনিস না থাকায় পাটের তৈরি জিনিস খুব সহজে এলাকায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। সেসময় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মেখলা প্রদান একটি সম্মানের বিষয় ছিল। পাশাপাশি তৈরি করা হত পাপোশ, ব্যাগ, পর্দা, আসন প্রভৃতিও। আগে পাটের সঙ্গে রং ব্যবহার করা হলেও রঙের বদলে এখন বিভিন্ন রঙের উল ব্যবহার করা হয়। বাঁশ, কাঠ ব্যবহার করে মেখলিশিল্পের যন্ত্র তানাশাজ তৈরি করা হয়। নীচে বাঁশের খুট থাকে। সেখানে দ্যান্নেতের খাটি, ভোল্লোসের খাটির মতো চারটে বাঁশের লাঠি/কাটি ব্যবহার করা হয়। সেই যন্ত্রে পাটের তন্তু দিয়ে হাত দিয়ে মেখলি বোনেন শিল্পীরা।
একটা মেখলা তৈরি করতে পাট থেকে সুতো কাটা, তারপর জিনিসপত্র তৈরি করতে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত লেগে যায়। কিন্তু তার বিনিময়ে যে পারিশ্রমিক মেলে, তাতে আর এখন সংসার চলে না মেখলি শিল্পীদের। শিল্পীরা জানাচ্ছেন, এখন গ্রামাঞ্চলে বিয়ের মরশুম ছাড়া এই শিল্পের কদর তেমন নেই বললেই চলে। বাণিজ্যিকভাবেও এর কদর তেমন নেই। তবে বিদেশে বিক্রি করতে পারলে, কিছু মুনাফা হতো। কোচবিহারের পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে যদি কাউন্টার করে তৈরি করা যেত, তাহলে তা থেকে বিক্রি হতে পারতো।
ইতিহাস গবেষক ও কোচবিহার বাণেশ্বর সারথিবালা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুপম বিশ্বাস মনে করেন, এই ধরণের বাংলার দেশীয় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি বিভিন্ন মেলা ও সংস্থায় এগুলিকে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি জীবন ধারণের জন্য যাতে লড়াই করতে না হয়, তার জন্য তালিকা তৈরি করে প্রকৃত শিল্পীদের ভাতা প্রদান করতে হবে। তাহলে তাঁরা শিল্পের প্রতি নিজেদের উৎসর্গ করতে পারেন। পাশাপাশি বৈশ্বিক মঞ্চে এটিকে প্রচার করতে হবে। লোকসংস্কৃতির গবেষক শচীমোহন বর্মন একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছেন, মাস্টারপ্ল্যান করে মেখলিশিল্পকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে সরকারকে। তাহলেই এই শিল্প বাঁচবে। বিভিন্ন মেলা, বিভিন্ন জায়গায় সরকারি স্টল তৈরি করে এটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে প্রাথমিক চাঙ্গা করার বিষয়টি দেখলে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হবে। নইলে হারিয়ে যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
বাজারে এই মেখলি বিক্রি করার কোনও কাউন্টার নেই। বিয়ের মরশুম এলে অবশ্য এর একটা বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। রাজবংশিদের মধ্যে বিয়ের মরশুমে এই মেখলা উপহার দেওয়ার একটা রীতি আজও চলে আসছে। অন্নপ্রাশনেও এর উপহার দেওয়া হয়। একেকটি মেখলি বিছানার চাদর ১৫০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। আর আসন বিক্রি হয় দেড়শ টাকায়। তবে একটি সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আলাদাভাবে চালু হলে তাঁদের অনেক সুবিধা হয় বলে দীপিকা জানান।
মেখলি বাঁচিয়ে রাখতে প্রশাসন কিছু কিছু কর্মসূচি নিয়েছে। অনেক স্বনির্ভর গোষ্ঠী বা সমবায় তৈরি হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওমেন স্টাডি বিভাগের তরফে এলাকায় যায় সমীক্ষা করতে। তাঁরা আশ্বাস দিয়ে আসে যে তাদের ইন্দোআমেরিকান প্রকল্পের মধ্যে মেখলির কাজে যুক্ত মহিলাদের কাজে লাগানো হবে। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এখন প্রশাসন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। তবে মেখলিগঞ্জে কোনও শিল্প নেই। ফলে মেখলির কাজের জন্য আধুনিক মানের মেশিন নিয়ে আসার তাগিদ কেউ অনুভব করছেন না। মেশিনের দাম এতটাই বেশি, তা ব্যক্তিগত ভাবে বসানো মুশকিল। এখন সবাই