শিলিগুড়ি লাগোয়া সেবক থেকে সিকিমে প্রবেশদ্বার রংপো। সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘন্টার রাস্তা যেতে সময় লাগবে মাত্র দুঘন্টা। চলছে কাজ জোরকদমে। পাহাড় ফাটিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে, গাছ কেটে বনবস্তিবাসীদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে চলছে মহা কর্মযজ্ঞ। কাজ শেষ হতে বড়জোর আর এক বছর।
তারপর মন চাইলেই হল, নিজের নিকটবর্তী স্টেশন থেকে টিকিট কেটে বা বাড়ি বসে অনলাইনে টিকিট কিনেই একেবারে পা রাখতে পারবেন শৈলরাজ্যে। শুধু একবার শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন বদলাতে হবে। তাতে অসুবিধা নেই। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে অন্য প্লাটফর্মে যেতে হবে বড়জোর। ব্যাস, তাহলে আর কী! এখন থেকেই ব্যাগ গোছানো আরম্ভ করে দিলেও অসুবিধা নেই। বলছে রেল মন্ত্রক।
সিকিমের মূল ভিত্তি যে পর্যটন, তার দুয়ার আরও হাট করে খুলে যাবে। শিলিগুড়িতে নেমে ট্যাক্সি ধরার হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় নেই। দরদামে ঠকে যাওয়ার ভয় নেই। শুধুই ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ। শুধু কি পর্যটন! সিকিমের বাণিজ্য ও অন্য সমস্ত দিক থেকেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হতে চলেছে।এমনকী বাড়বে নাথুলা সীমান্তের সুরক্ষাও। সেনাবাহিনীর নজরদারির সামগ্রী ও অত্য়াধুনিক সমরাস্ত্র পৌঁছে যাবে সীমান্তে। ফলে আরও সুরক্ষিত হবে দেশ।
নর্থইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ে শিলিগুড়ি লাগোয়া সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত এই ব্রডগেজ রেললাইন পাতছে। টয় ট্রেনের শৌখিন যাত্রা নয়।ছুটবে পেল্লায় পুরোদস্তুর প্রথাগত রেলগাড়ি। তা বলে এই প্রকল্পের সূত্র গাঁথা অনেক আগেই। ২০০৮ সালে এই প্রকল্প অনুমোদন পায় রেলমন্ত্রকের। ২০০৯ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে রেললাইন অবশ্য বাইরে থেকে দেখা যাবে না। কারণ বেশিরভাগটাই পাহাড়ের বুক চিরে অন্তঃসলিলা থাকবে। টানেল তৈরি হচ্ছে সে কারণেই।
মোট প্রায় ৪৫ কিলোমিটার রেলপথের নব্বই শতাংশই এ রাজ্যের দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রয়েছে মোাট ১৪ টি টানেল। থাকবে ২৮টি রেলসেতু। চারটি লেবেল ক্রসিং। ফলে ভিতর দিয়ে গেলেও অন্যরকম অনুভূতি হবে। শিলিগুড়ি থেকে সিকিমের পথে দু ঘন্টার যাত্রাপথ হয়ে উঠবে অন্য়রকম অভিজ্ঞতার সাক্ষী।
এই প্রজেক্টের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ৯৮.৯৪ হেক্টর জমি। যার মধ্যে ২.৭৭ হেক্টর জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। ১৮.৪ হেক্টর সরকারি খাসজমি ও প্রায় ৮.৪৯ হেক্টর জমি বন দপ্তরের আওতাধীন। ৭৭.৭৭ হেক্টর জমিতে রয়েছে বনগ্রামগুলি।
যদিও এই প্রকল্প চালু করতে কম বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। দীর্ঘদিনের বাসস্থান ছাড়তে নারাজ ছিলেন বনবস্তিবাসীরা। রাজ্য সরকার ওই সব বস্তিবাসীদের উচ্ছেদে শামিল হবেন না বলে জানিয়ে দিলে। জমি পেতে অসুবিধা হচ্ছিল। কেন্দ্র থেকে সরাসরি চাপ দেওয়া হয় কাজ করার জন্য। পরে জেলাশাসকদের দিয়ে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করা হয়।
কয়েকদিন আগে নির্মীয়মান টানেলে ধস নামে। তাতে দুজনের মৃত্যু হয়। কয়েকজন জখম হন। আপাতত কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে এ সব বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছে না রেল। কেন ঘটনাটি ঘটেছে, তার প্রকৃত তদন্ত করে, তারপর সেখানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে। ফের চালু হবে টানেল তৈরির কাজ।
এই প্রকল্পের ফলে দুটি জায়গা ব্যপকভাবে গুরুত্ব লাভ করবে। এক সেবক স্টেশনটি। অন্যটি হল নতুন স্টেশন হিসেবে অবতীর্ণ হওয়া রংপো। ওদিকে রংপোতে স্টেশন তৈরির কাজও চলছে জোর কদমে। প্লাটফর্ম, টিকিট কাউন্ডার, ভিআইপি লাউঞ্জ,ওয়েটিং রুম তৈরির কাজ শেষের পথে। অন্যদিকে সেবকের মতো ছোট হল্ট স্টেশনটি একটি পূর্ণাঙ্গ স্টেশন হিসেবে উঠে আসছে। ফলে এই জায়গার গুরুত্বও বাড়ছে। তবে পাহাড়ি এলাকা যাতে ওভার ক্রাউডেড না হয়ে যায় তার দিকেও নজর রাখা হচ্ছে।
এই প্রকল্প আরও আগে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাতেও তাতে বাদ সাধে উদ্যোগহীনতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে মনোযোগ দেন। সেই সঙ্গেই এই প্রকল্পটি ধামাচাপা পড়ে যায়। দীর্ঘদিন পর প্রকল্পটি নিয়ে ২০১৬ থেকে ফের উদ্যোগ শুরু হয়।
তারপরও নানা রকম সমস্যা তৈরি হয়, পরিবেশপ্রেমী সংগঠন থেকে বনবস্তিবাসীদের বিরোধে। প্রকৃতি নষ্ট হবে না এবং স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় থাকবে বলে ব্লু প্রিন্ট জমা দিয়েই ছাড়পত্র মেলে প্রকল্পের।
বলা হয়, টানেলের ভিতর দিয়ে যাওয়ার ফলে বাইরের ধস যেমন প্রভাব ফেলবে না, তেমনই নতুন করে ধসের সম্ভাবনাও কম থাকবে। পাশাপাশি বাইরের দুর্যোগ টানেলের ভিতরের যন্ত্র শকটকে ছুঁতে পারবে না। ফলে যাতায়াতে সম্ভব হবে না।