প্রতি বছর মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানে যত জন সামিল হন, তার থেকে কম মানুষের পা পড়ে এই গুহায়। এতটাই দুর্গম সে গুহা। ভিয়েতনাম ও লাওসের সীমান্তে হাং সং ডুং বা সং ডুং গুহা বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গুহা। স্থানীয় ভাষায় এর নামকরণের অর্থ পাহাড়ের গুহা বা পাহাড়ি নদীর গুহা।
ভিয়েতনামের কোয়াং বিন প্রদেশে হোং হা কে বাং জাতীয় উদ্যানে এই চুনাপাথরের গুহার বয়স ২০ থেকে ৫০ লাখ বছর। দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এই গুহা ১৯৯১ সালে আবিষ্কার করেন স্থানীয় এক কৃষক।
হো হান নামে ওই কৃষক দুষ্প্রাপ্য ভেষজের খোঁজে গভীর জঙ্গলে ঘুরছিলেন। আচমকাই বৃষ্টি শুরু হয়। আশ্রয়ের খোঁজে থাকা হো তখন এই গুহার সন্ধান পান। হো-এর কানে আসে তীব্র বেগে নদী বয়ে যাওয়ার শব্দ। সেই শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে তিনি এই গুহার সন্ধান পান। তিনি আশ্চর্য হয়ে যান গুহার ভিতরে মেঘ ভেসে থাকতে দেখে!
তবে গুহায় তিনি প্রবেশ করেননি। দুর্গম উৎরাইয়ে অনেকটা পথ নামতে হবে দেখে তিনি পিছিয়ে যান। কিন্তু এরপর বন থেকে বেরিয়ে তিনি গুহার পথ হারিয়ে ফেলেন। আবার ১৮ বছর পরে শিকার করতে গিয়ে ফের এই গুহার সন্ধান পান। এবার আর গুহার অবস্থান তিনি ভুলে যাননি। তার মাধ্যমে লুকিয়ে থাকা এই গুহার খবর পৌঁছায় বাইরের বিশ্বের কাছে। ভিয়েতনামের এই গুহা স্বীকৃতি পায় বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গুহা হিসেবে। তার আগে অবধি এই শিরোপা ছিল মালয়েশিয়ার ডিয়ার কেভ-এর। ব্রিটিশ কেভ রিসার্চ এর অভিযাত্রীরা ভিয়েতনামের এই গুহায় অনুসন্ধান চালান ২০০৯-এ। কিন্তু সে বার টানা কয়েক দিনের অভিযান আটকে যায় বিশাল এক চুনাপাথরের প্রাচীরের সামনে। ওই প্রাচীরের নাম দেওয়া হয় ‘গ্রেট ওয়াল অব ভিয়েতনাম’। কিন্তু এই বাধার কাছে হার মানতে রাজি ছিলেন না ব্রিটিশ অভিযাত্রীরা। পরের বছর ফের অভিযান শুরু হয়। এবার তারা গুহার এক মাথা থেকে অন্য দিক অবধি অনুসন্ধান শেষ করেন।
এই গুহা প্রায় ৬৬০ ফিট উঁচু। চওড়ায় ৪৯০ ফুট। ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট গুহাটির ছাদে দু’টি বিশাল সিঙ্কহোল বা গহ্বর আছে। সেখান দিয়ে সূর্যালোক প্রবেশ করে। ফলে গুহায় উদ্ভিদের বংশ বিস্তার হতে সমস্যা হয়নি। ২০১৯ সালে জানা যায়, ভিয়েতনামের সং ডুং গুহা স্থানীয় আরও একটি গুহার সঙ্গে সংযুক্ত। বিশ্বের বৃহত্তম কিছু স্ট্যালাগমাইট অর্থাৎ চুনাপাথরের স্তম্ভ আছে এই গুহায়। এখানে সর্বোচ্চ স্ট্যালাগমাইটের উচ্চতা ২৬২ ফুট। বাধা বলতে শুধু এই চুনাপাথরের স্তম্ভ। না হলে বোয়িং ৭৪৭ উড়ে যেতে পারত এই গুহাপথে। ৪০ তলা উঁচু স্কাইস্ক্র্যাপারকে আশ্রয় দিতেও প্রস্তুত এই গুহা।
বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এই গুহার নিজস্ব আবহাওয়া চক্র আছে। গুহার ‘আকাশে’ তৈরি হয় মেঘ-ও। নিজের নিয়মেই চলে গুহার জীবন। গুহার ছাদে সিঙ্কহোল দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করে। ভিতরে নদী থাকায় জলীয় বাষ্পের অভাব হয় না। ফলে মেঘ তৈরির সব উপাদানই মজুত এই গুহায়।
২০১৩ থেকে শুরু হয়েছে এই গুহা ঘিরে পর্যটন। প্রতি বছর খুব সীমিত সংখ্যক পর্যটক অনুমতি পান গুহায় পা রাখার। তবে সাধারণ পর্যটকদের এই সফরে আসতে নিরুৎসাহী করা হয়। কারণ টানা দু’দিন গভীর বৃষ্টি অরণ্যের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে তবেই পৌঁছানো যায় গুহা মুখে। তারপর গুহার ভিতরের পথও অত্যন্ত দুর্গম। ফলে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সমর্থ না হলে এই গুহায় অভিযানের অনুমতি পাওয়া যায় না।
স্থানীয় প্রশাসনের পরিকল্পনা, সং ডুং গুহায় ভবিষ্যতে কেবল কার বা রোপ ওয়ে চালু করার। কিন্তু তাতে আপত্তি জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। তাদের মতে, পর্যটকেদর সংখ্যা বাড়লে গুহার ভিতরে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, এই গুহায় পর্যটন শুরু হওয়ার পরে স্থানীয় অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। কারণ প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এখানে অভিযাত্রীরা আসেন। কিন্তু পর্যটকদের সংখ্যা সীমিত থাকার পক্ষেই সহমত হয়েছেন পরিবেশবিদরা।