ছেলেবেলা থেকে আজ পর্য্যন্ত একটি অনুভূতি অপরিবর্তনীয় থেকে গেছে। পুজো পুজো গন্ধটাই কেমন যেন মনটাকে আনন্দমুখর করে তোলে। সোনালী রোদের ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো ধূসর মেঘেদের আনাগোণা। রোদ্দুরের রঙ সহসা বদলে যাওয়া, হঠাৎ করে একপশলা বৃষ্টি এসে পড়া, শহরতলীর মাঠে ঘাটে কাশফুলের সাথে চকিত হাওয়ার দুষ্টুমি আর বৃষ্টির শেষে নীলাকাশে আবার সাদা মেঘের ভেলাদের প্রত্যাবর্তন।
এভাবেই প্রতিদিনকার দিনগুলো আকাঙ্খিত উৎসবের অপেক্ষায় প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াতে থাকে। তারপর এসে পড়ে সেই বিশেষ দিন। রাতে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে বিছানায় যাওয়া আর রাত থাকতে থাকতে উঠে রেডিও চালানো। ইথার তরঙ্গে স্বর্গ থেকে দেবীর আগমন ধ্বনি বয়ে আনে এক বিপুল উদাত্ত কন্ঠ। সেই জলদগভীর কন্ঠকে অনুসরণ করে বেজে ওঠে হৃদয়মথিত করে দেয়া এক আশ্চর্য সঙ্গীত, "বাজলো তোমার আলোর বেণু "।
যে কোনো স্বপ্নের দিনের অপেক্ষায় দিন গোনাটাই আসল আনন্দ। দিন গুনতে গুনতে শেষে হুড়মুড় করে যখন স্বপ্নটা বাস্তব হতে শুরু করে, তখন যেন আনন্দের পরিধিটা একটু একটু করে কমতে থাকে। এভাবেই একদিন সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা আনন্দের দিনগুলো ফুরিয়ে যায়। স্বপ্নের বিলীন হবার সাথে সাথেই গ্রাস করে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। বিজয়া দশমীর দিন আমার ছোটবেলায় তেমনই এক স্বপ্নভঙ্গের বিষাদ এসে গ্রাস করত প্রতিবছর।
সারা বছর অপেক্ষায় থাকা গোটা চারেক দিনের জন্য। সেই একেকটা দিন যেন সোনার চেয়েও দামী। রাস্তায় জনস্রোত, আলোর রোশনাই, সুসজ্জিত নারী পুরুষসহ সব বয়সের মানুষজনের আনন্দদীপ্ত উজ্জ্বল মুখ, খাবারের মেলা, জলসা, নাটক, মাইকের অবিরাম বেজে চলার মধ্যে দিয়ে জেটের চেয়েও দ্রুতগতিতে এসে যেতো বিজয়া দশমী।
একটা দিনের কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। তখন বোধহয় ক্লাস সেভেনে পড়ি। দক্ষিণ কলকাতার একটি পাড়ায় থাকতাম, সেখানে ক্লাবের পুজোটা ছিল পাড়ার পুজো। পুজোর তিনদিন সন্ধেবেলা নতুন জামা প্যান্ট পরে পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলে বসে সমবয়সী বন্ধুদের সাথে আড্ডার শেষ ছিল না। দিনের বেলা ঠাকুর দেখে নিতাম। সন্ধে থেকে প্রায় মধ্যরাত অব্দি পাড়ার বন্ধুরাই ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
এইভাবে কোথা দিয়ে সময় বয়ে যেত আর হুট করে এসে যেত বিসর্জনের বাজনা। দশমীর দিন ঠাকুর লরিতে তোলার পর পাড়ার বড় দাদাদের কাছে আবদার করতাম আমরা ছোটরা লরিতে উঠে ভাসানে যাওয়ার জন্য। তুলতও। কিন্তু পাড়া পরিক্রমা করার পর নামিয়ে দিত আমরা ছোট বলে। আমাদের আর গঙ্গার ঘাটে ভাসানে যাওয়া হত না!
লরি থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর আমরা সাত আটজন পুঁচকে ফিরে আসতাম পুজোমন্ডপে। আজও মনে আছে সেই দশমীর সন্ধ্যার কথা। ফাঁকা মন্ডপ। জনহীন। শুধু মন্ডপের ঠিক মাঝখানে একটি বৃহৎ প্রদীপ জ্বলছে। তার পীত আলোতে এক অদ্ভুত বিষন্নতা মাখানো। মূর্তিহীন, জনহীন মন্ডপটি কেমন এক অনাদরে যেন পড়ে আছে। তখন বুঝিনি কিন্তু আজ বুঝি যে মানবজীবনটাও সেইরকম। জৌলুষ যখন ফুরিয়ে যায়, স্বপ্ন যখন শেষ হয়ে যায়, তখন এমনই শূন্যতা ভরে ওঠে জীবনে!
জানিনা কেন আমি কি আজও তাই বোধনের দিনই বিসর্জনের বাজনা শুনতে পাই? আনন্দে ভাসতে ভাসতেও বুকের প্রকোষ্ঠে অনুভব করি বেদনার সুর! এটাই কি সত্যি যে সব আনন্দের মধ্যেই বীজ লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের দুঃখের? ঠিক যেমন সব দুঃখের মধ্যেও আনন্দের বীজ লুকিয়ে থাকে, তেমন?
কোন এক সুদূর নক্ষত্র থেকে এসে পৌঁছেছি এই পৃথিবীতে আবার ফিরে যেতে হবে সেই নক্ষত্রমালাতে! এই কদিনের মাত্র সময় তাই নষ্ট করার নয়। এ হল সবার জন্য মঙ্গল কামনার সময়,সকলের জন্য কল্যান চাওয়ার সময়! এসময় বৃথা অতিবাহিত করার নয়!
সেইজন্যই আমি ব্যক্তিগতভাবে বছরে একদিন সে যেদিনই হোক আলাদা করে শুভেচ্ছা লেনদেনের বিরোধী কারণ আমার কাছে জীবনের প্রতিটি দিনই শুভেচ্ছা দেওয়া নেওয়ার দিন।
তবু মঝে মাঝে যখন এই সারসত্যটিই মানবজীবনের অহমিকায় ভুলতে বসি, তখন এমনই এক বিজয়া দশমীর রাতে পরিত্যক্ত কোনো মন্ডপের একলা প্রদীপ আমায় মনে করিয়ে দেয় সেই সার সত্যের কথা। সব আলোর নীচেই থাকে এক পরিত্যক্ত আঁধার। আলোর বর্ণচ্ছটায় ভুলে যেও না তার কথা। আলোর মতোন সেই অন্ধকারও এই জীবনের অঙ্গাঙ্গী অঙ্গ !
সকলের মঙ্গল হোক। জনহীন মন্ডপে জ্বলুক একাকী প্রদীপ। যে মন্ডপ থেকে বিসর্জন হয়েছে দেবী দুর্গার, সেই একই স্থানে অল্প কিছুদিন বাদেই আসবেন লক্ষীপ্রতিমা। আবার আলোর ধারায় সেজে উঠবে মন্ডপ। ততদিন পর্য্যন্ত আলো ছড়াক এই একলা প্রদীপ!
প্রতিবেদক- কবি/লেখক