scorecardresearch
 

'পুরীর রথযাত্রার ডায়েরি' শেষ পর্ব: জগন্নাথ প্রভুর মহাপ্রসাদ পুলিশের চোখের সামনে লুঠ হয়ে গেল

অধরা পান্নার উপাদান হল দুধ, মাখন, মিছরি, কলা, কাজুবাদাম সর্বোপরি চিনি তো আছেই। এই মিশ্রণে আবার একটু গোলমরিচের একটা ফ্লেভার দেওয়া হয়। ছড়িয়ে দেওয়া হয় তুলসি পাতা আর কর্পূর। এই পান্নার প্রসাদ বিতরণ করাও হয়। আর তারসঙ্গে দেওয়া হয় খাবার জল। এইভাবে যাত্রা শুরু হয়।

Advertisement
Puri Ratha Yatra 2024 Puri Ratha Yatra 2024
হাইলাইটস
  • জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ কীভাবে হয়?  
  • এইবার তিনটি রথ এসে দাঁড়াল মন্দিরের সামনে
  • ছাপান্ন ধরনের মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয়

ভাইবোনদের তিনটি বিশালাকায় রথ। শ্রীক্ষেত্রের শ্রীমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা থেকে। লাখ লাখ মানুষ উল্টোরথ দেখতে এসেছেন। এরপর জগন্নাথদেব গর্ভগৃহে আবার অধিষ্ঠিত হচ্ছেন আজ। আগামিকাল (মঙ্গলবার) তিনি রাজেবেশ ধারণ করবেন। তারপর ভক্তরা পাবেন মহাপ্রসাদ‌।
 
জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ কীভাবে হয়?
 

যখন জগন্নাথের মন্দির থেকে প্রসাদ নিয়ে পুরোহিতরা আসেন বিমলা মায়ের কাছে। বিমলামা এই মন্দিরের তন্ত্রশক্তির প্রতীক। বিমলা মায়ের কাছে সেই প্রসাদ দেওয়া হলে বিমলা মা সেই প্রসাদ গ্রহণ করবেন। তারপর সেই প্রসাদ আবার আসবে প্রভুর কাছে। প্রভুর কাছে সেই প্রসাদ নিবেদন‌ করা হলো। প্রভুর প্রসাদ গ্রহণের পর সেই প্রসাদ হয়ে উঠবে মহাপ্রসাদ। আসলে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথায় একটা বৈষ্ণব ধর্ম ও শাক্ত ধর্মের তান্ত্রিক‌ প্রথার মিলন আছে। বিমলা দেবীর মন্দিরে নীরবে নিভৃতে বলি দেওয়ার প্রথা ছিল। এখনও ওই মন্দিরে বলি দেওয়া হয় কিনা আমি জানি না। সেকথা না হয় পরে আলোচনা করা যাবে। ফিরে আসি উল্টোরথের কাহিনিতে।
 
আসার আগে এক সহকর্মী বন্ধু জিজ্ঞাসা করছিল ছুটিতে কোথায় যাচ্ছেন? বিদেশে না দেশে? আমি বললাম, না না। আমেরিকা, ইংল্যান্ডে নয়। একেবারেই স্বদেশে। তখন বললেন পাহাড়ে‌? নাকি কেরলের নীরব কোনও সমুদ্রেতটে? আমি বললাম, না। আমি যাচ্ছি পুরীর জগন্নাথধামে রথ দেখতে। সে আঁতকে উঠল। বলল এই গরমের মধ্যে আর ওই ভিড়ের মধ্যে ছুটি কাটাতে। আমি বললাম যার যা প্রারব্ধ! আসলে আমার তো ভিড় ভাল লাগে। ঠিক যেভাবে অর্ধকুম্ভে হরিদ্বারে,মহাকুম্ভে এলাহাবাদ নগরীতে গেছি,যেভাবে বারাণসীতে শ্রাবণ মাসে ভক্তদের ঢল দেখেছি। আসলে ভারতে‌ তো ১৪৭ কোটি মানুষের দেশ। এখানে ভিড় মানেই তো একটা গণতন্ত্রের স্বাদ। আপামর মানুষের স্রোত বয়ে চলেছে। কত রকমের মানুষ। তারমধ্যে কত কালকূটেরাও হেঁটে চলেছে আমরা, তাদের জানি না। কত রকমের মানুষ দেখলাম। আমি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। আমাদের ল্যাবরেটরি তো এই সমাজ। ধর্মকে বাদ দিয়ে কোন সমাজ। কোথায় যাব?

Advertisement

এইবার তিনটি রথ এসে দাঁড়াল মন্দিরের সামনে
 
এখানে এসে মনে হচ্ছে পুরীর মানুষ প্রভু জগন্নাথদেবের সঙ্গে একই সঙ্গে বসবাস করে। সবাই যে প্রতিদিন মন্দিরে যাচ্ছেন তা নয়। কিন্তু উৎকলবাসী প্রভুর সঙ্গে তাদের যাপনকে যুক্ত করেছেন। সকলেই খবর রাখেন। কেউ টিভির স্থানীয় চ্যানেল থেকে,কেউ ওড়িয়া কাগজ পড়ে,কেউ রেডিও শুনে, কেউ মোবাইলে ভাইরাল হয়ে যাওয়া নানা ভিডিও থেকে জানতে পারেন। এইবার প্রভু মাসির বাড়ি থেকে রওনা দিলেন। এইবার তিনটি রথ এসে দাঁড়াল মন্দিরের সামনে। এইবার প্রভু অধিষ্ঠিত হচ্ছেন।‌ এইরকম আর কী। হোটেলের লিফ্টে উঠতে উঠতেও স্থানীয় কর্মী জানাচ্ছেন,খবর পেয়েছেন তো?

এবার প্রভু স্নান করে রাজেবেশ ধারণ করবেন আগামিকাল। একেই বোধহয় বলে দেবতার মানবায়ন। রত্ন ভাণ্ডারের বাক্সগুলো কোথায় নিয়ে যাওয়া হল? সেই রত্নভাণ্ডার থেকে কী ঐশ্বর্য প্রকাশিত হবে? তার জন্য অজানা কৌতুহল। কাতারে কাতারে মানুষ এসে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁরা কি কেউ রত্নভাণ্ডারের কোনও হদিস পাচ্ছেন? তবু কত মিথ্। তাকে ঘিরে মানুষের কত কল্পনা,কত প্রার্থনা। এই ভারতীয় মননকে বোঝা প্রয়োজন। কেননা ভারতের গণতন্ত্রের সঙ্গে ভারতের রাজনীতির সঙ্গেও মানুষের এই অন্ধবিশ্বাস,সংস্কার,ভাল লাগা স্বর্গীয় অনুভুতি সব মিলে মিশে আছে। তার মধ্যে কিছু ভুল, কিছু ঠিক। প্রথমেই না না করতে করতে এগোতে চাইলে কিন্তু বিপদ। না পান্না,না হিরে,না আমি,না তুমি? সেসব তো অনেক পরের কথা।
 
আজ তো উল্টোরথ। এবার প্রভু জগন্নাথ দেবের শ্রীমন্দিরে ফিরে এসেছেন। মাসির বাড়ি থেকে তাঁর যাত্রা শুরু হয় কাল। এবং একইভাবে পথের দু'ধারে হাজার হাজার মানুষ এর উপস্থিতিতে গুন্ডিচা মন্দির থেকে তিনি এলেন রাজপথে। একে বলা হয় বহুদা যাত্রা। সিংহদ্বার পর্যন্ত পৌঁছানো এটাই হল উল্টো রথের যাত্রা।
 
যাত্রা শুরুর মুহূর্তে প্রভুকে দেওয়া হল এক স্বর্গীয় পানীয়। এই স্বর্গীয় পানীকে বলা হয় অধরা। কী এই অধরা রস? আসলে এটা হল একধরনের পান্না। অধরা পান্নার উপাদান হল দুধ, মাখন, মিছরি, কলা, কাজুবাদাম সর্বোপরি চিনি তো আছেই। এই মিশ্রণে আবার একটু গোলমরিচের একটা ফ্লেভার দেওয়া হয়। ছড়িয়ে দেওয়া হয় তুলসি পাতা আর কর্পূর। এই পান্নার প্রসাদ বিতরণ করাও হয়। আর তারসঙ্গে দেওয়া হয় খাবার জল। এইভাবে যাত্রা শুরু হয়।

আরও পড়ুন

ছাপান্ন ধরনের মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয়, এবং নানা ধরনের পানীয় তৈরি করা হয়
 
পুরীর বিভিন্ন মঠ রাঘবদাস মঠ, বড় উড়িয়া মঠ, এইরকম নানারকমের মঠের পক্ষ থেকে এই মাটির বড় বড় হাঁড়িতে করে বিভিন্ন ধরনের প্রসাদ দেওয়া হয় প্রভু জগন্নাথকে। এই প্রসাদ বিতরণ চলতে থাকে উল্টো রথের পরেও। তার যে রাজবেশ ধারণ এবং তারপরে মিষ্টান্ন ভোগ যাকে অনেকে ছাপ্পান্ন ভোগও বলে থাকেন। ছাপান্ন ধরনের মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয়, এবং নানা ধরনের পানীয় তৈরি করা হয়। এই সমস্ত পানীয় গুলি বণ্টন করা হয় ভক্তদের মধ্যে। একটা ঐশ্বরিক অনুভূতি তৈরি হয়।  অসাধা শুক্লপক্ষ ত্রয়োদশী এবং এই তিনজন ঈশ্বর জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা তাঁরা যাত্রা শুরু করেন এক সাংঘাতিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে পসেসন চলতে থাকে একে বলা হয় গতি পাহানডি। খুব মৃদু ছন্দে স্থানীয় লোকশিল্পীরা নাচ, গান নানানরকম উৎসবে মাতিয়ে তোলে এই প্রাঙ্গণ। ঠিক যেমনটা হয়েছিল শুরুর সময় মূল জগন্নাথ মন্দিরে।
 
এরমধ্যে এই নন্দিঘোষ রথ লর্ড জগন্নাথের ওপর  নজর রাখছেন এমনটাই বলা হয়। জগন্নাথ যখন রথযাত্রায় আসেন, তখন মূল যে মন্দির, সেই মন্দিরে মাধব ও শ্রীদেব থাকেন। মাধব তখন দেখাশোনা করার জন্য থেকে যান। যখন বলভদ্র, দেবী সুভদ্রা এবং সুদর্শন খুব সহজে তাঁরা মন্দিরে প্রবেশ করতে চাইবেন। সুদর্শন চক্রকেও কিন্তু জগন্নাথ দেবের সঙ্গে প্রদক্ষিণ করানো হয়। কথিত আছে, রথযাত্রা করে তিনি যখন মাসির বাড়ি যান তখন সেই ন দিন তাঁর রথযাত্রায় হয় মাধুর্যলীলা। এই ঐশ্বর্যলীলা ত্যাগ করে মাধুর্যলীলায় আসায় মা লক্ষ্মী ক্ষুব্ধ হয়ে যান এবং তখন ক্ষুব্ধ দেবী তাদের আটকান, তখন তাঁকে মিষ্টি ও নানান রকমের বরণ করবেন মালক্ষ্মী। গুন্ডিচা মন্দিরে লক্ষ্মী তাঁর স্বামীকে দেখতে পারবেন। তখন মহাচূর্ণ ছড়িয়ে দেবেন। অঘন মালা দেবেন তিনি, তাঁর স্বামী জগন্নাথকে। তখন জগন্নাথ রাজি হবেন আবার ফিরে যেতে। এইরকমভাবে তাঁর দুতরফেরই অভিমান ভঙ্গ হবে। এবং যখন মালক্ষ্মী রেগেছিলেন তখন নন্দীঘোষ অর্থাৎ জগন্নাথের যেই রথ সেই রথের একটি পায়া তিনি ভেঙ্গে দেন। সেটা আজও একটা অনুষ্ঠান হয় এইভাবে দুজনের মধ্যে কথোপকথন হবে। এই অনুষ্ঠানটাকে বলা হয় বচনিকা। এই বচনিকার অনুষ্ঠান অর্থাৎ লক্ষ্মী এবং জগন্নাথের যে কথোপকথন সেগুলি পরিচালনা করবেন জগন্নাথের পুরোহিতরা তখন সেই কথোপকথনের পর রসগোল্লা বিতরণ হবে। মা লক্ষ্মীকে প্রথম রসগোল্লা দেওয়া হবে কেননা এটি তাঁর সব থেকে প্রিয় মিষ্টি। মালক্ষ্মীর প্রিয় মিষ্টি রসগোল্লা। সবশেষের মিষ্টি টুকরোটা নেবে জগন্নাথ। এইভাবে এই দম্পতি একজন আরএকজনের প্রতি ভালোবাসা এবং মান- অভিমান মুছিয়ে আবার ফিরবেন মূল মন্দিরে।
 
এবার ৪৬ বছর পর খোলা হয়েছে পুরীর রত্নভান্ডার। রত্নভান্ডারের রহস্যভেদ ১৪ জন সদস্যের প্রশাসনিক শীর্ষ কমিটি একথাও জানিয়েছেন যে শুধু রত্ন রত্নভাণ্ডারের হিসেব-নিকেশ নয়, যে কক্ষে এই রত্নভাণ্ডার ছিল তার দেওয়াল ভেঙে গেছে দীর্ঘদিনের অবহেলায় সেই সমস্ত ভাঙা পাথর মেরামত করা হবে। বহু জায়গায় জল লিক করছে সেগুলো যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঠিক করা হবে। কত বছর পর আবার এই স্বর্ণমন্দিরের প্রতি নজর পড়েছে। ৪৬ বছরের প্রতীক্ষা তারপর এই রত্ন ভান্ডার এখন শুধু হিসেব-নিকেশ নয় এখানে মেরামতির কাজও হবে। বিশেষজ্ঞদের কমিটি আছে। স্ট্রাকচারাল এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা আছেন, সার্ভেয়ার আছেন, ড্রাফট ম্যান আছেন, পুরাতত্ত্ববিদরা তো আছেনই সুতরাং সবদিক বিচার করে রত্নভান্ডার-এর বিষয়টি এখন সংস্কার হবে। রত্নভান্ডারের ভেতরের সমস্ত মূল্যবান জিনিসপত্র বের করা সম্ভব হয়েছে। একটি অস্থায়ী স্ট্রংরুম তৈরি করে সেখানে এগুলোকে রাখা হয়েছে। না! এই রত্নভান্ডারের ভিতর থেকে না কোন সাপ বেরিয়েছে না কোনো কঙ্কাল না কোন নরমুন্ডু বেরিয়েছে। এই সমস্ত জল্পনা কল্পনা গুজবকে শেষ করে দিয়ে এবার আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সুপারিনটেন্ডিং আর্কিওলজিস্ট যিনি পুরি সার্কেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই ডি বি গড়নায়ক বলেছেন যে কোনো চিন্তা নেই, আমরা সবদিক থেকে বিষয়টা দেখছি। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে একটা থ্রিডি লেজার দিয়ে স্ক্যান করছে পুরো পাহাড়ের ভিতর যে শরীর সেই শরীরটা। যাতে রত্ন ভান্ডারের ভিতরে কোথাও কোনরকম ভাঙ্গন বা কোনোরকম চির ধরার ব্যাপারও না থাকে। কেননা এটা একটা অন্ধকূপের মত মানুষের পক্ষে সবটা দেখা খালি চোখে সম্ভব হয় না। জগন্নাথ মন্দিরের প্রশাসনও এই কাজে সবরকম সহায়তা করছে বলে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে। পুরীর রাজার এই কমিটির চেয়ারম্যান দিব্য সিংহ দেব তিনিও এইরত্ন ভান্ডারের যে নিরাপত্তা, সেই নিরাপত্তা দেখার জন্য তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন এখনই এগুলো মেরামত হওয়ার দরকার। সুতরাং থ্রিডি লেসার স্ক্যানিং এবং ফোটোগ্রাম্যেট্রিক সার্ভে এএসআই যেটা করবে এই সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এএসআই ২৮ ও ২৯ শে নভেম্বর গত বছরের শেষে কিছু ক্র্যাক হয়েছে বলে আশঙ্কা জানিয়েছিল সেগুলো এবারে প্রসেস করা হবে অর্থাৎ একটা  স্ক্যানিং এবং ফোটোগ্রাম্যেট্রিক সার্ভে গত বছরে যেটা হয়েছিল, এবার আরও বেশি করে দেখা হবে। সেই স্ক্যানিং এর ওপর ভিত্তিতে কাজকর্ম শুরু হবে। লেসার স্ক্যানিংয়ের যে রিপোর্ট সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে প্লাস্টার করা হবে। এমনভাবে এই দেওয়ালের প্লাস্টার করা হবে যাতে কোনো ভাঙ্গা না থাকে আর সেগুলো যাতে দেখা না যায়। তবে ওই দেওয়ালের ভাঙ্গন থেকে জলের যে সিপেজ হওয়ার সম্ভাবনা সেটা যাতে না থাকে সেগুলো সমস্ত দেখা হবে। রত্নভান্ডারের ভেতরে এই জগমোহন নামক স্থানটি সেটাকে আরও শক্তিশালী করা যাতে সেখানে জল কোনোভাবে ঢুকতে না পারে। এটাকে বলা হয় ডিপ্লাস্টারিং।  এই বাইরের যে তিনটি দেওয়াল আছে সেগুলোকে ডিপ্লাস্টারিং করে ঠিক ঠিক সংরক্ষণে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে সংস্কার কাজ পুরো শেষ হয়ে যাবে, তখন এটাকে আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে দেখার উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করা হবে। ফুল প্রুভ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

Advertisement

এখন মূল প্রশ্ন হল চাবি হারিয়ে গেল কী করে?
 
দুপুর ১ টা বেজে ২৮ মিনিটে এই মন্দিরের রত্নভান্ডারের জয় জগন্নাথ ধ্বনি উঠলো এবং রত্নভান্ডার থেকে এটা খোলা হলো তারপরে এই ১১ জন সদস্যের টিম তাঁরা যখন সিংহ দার থেকে বেরিয়ে এলো তখন বাজে ৫ টা বেজে ২০ মিনিট। সমস্ত কাজ শেষ করে। তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটার শুরুর আগে অর্থাৎ রত্নভান্ডার খোলার আগে লোকনাথ মন্দিরে পুজো হয়। লোকনাথ মন্দিরের পুরোহিতদের সেই পুজো করার কারণ হল লোকনাথ মন্দিরের প্রধান যে মহাদেব তিনি হলেন, এই রত্নভান্ডারের প্রধান রক্ষক। সেইকারণে তাঁকে আগে পুজো দেওয়া হবে এটা হল প্রথা। সকাল ১০টায় পুরোহিতরা সেখানে চলে আসে অগান মালা (agyan mala ) পড়ানো হয় লর্ড লোকনাথকে। তিনিই হলেন রক্ষাকর্তা এই রত্নভাণ্ডারের। হর হর মহাদেব ধ্বনি উঠল জয় জগন্নাথের ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে। মিশে গেল দুটি ধ্বনি তারপর জগন্নাথ দেবের রত্ন ভান্ডারে এই ১১ জন সদস্যের টিম গেল রত্নভান্ডার খুলল। আর এই সাপ আছে এই যে একটা মিথ সেই মিথটাও যে সত্য নয় এটাও কিন্তু আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এখন মূল প্রশ্ন হল চাবি হারিয়ে গেল কী করে? তিনটি তালা ভাঙতে হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে হারিয়ে যাওয়া চাবি নিয়ে। কেননা রত্নভাণ্ডার ৪৬ বছর পর যখন খোলা হল তখন সেই বিতর্কের মধ্যে বড় প্রশ্ন হল যে তিনটে তালা ভাঙা হল সেই ভেতরের যে চেম্বার তার ভিতরেও যে রত্নভান্ডার আছে। ২০১৮ সালে ১৪ এপ্রিল প্রথম জানা যায় আগের সরকার এই রত্ন ভান্ডার খুলতে গিয়ে চাবি খুঁজে পায়নি তখন বলা হয়েছিল চাবি হারিয়ে গেছে। সেই কারণে ডুপ্লিকেট চাবি করার কথা বলা হয়েছিল। সেই ডুপ্লিকেট চাবিও ছিল। ডুপ্লিকেট চাবিও পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন হল ২০১৮ সালের ৬ই জুন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক তিনি একটি বিচারবিভাগীয় কমিশন এক অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারক রঘুবীর দাসের নেতৃত্বে নিয়োগ করেছিলেন। শুধুমাত্র সেই হারিয়ে যাওয়া চাবির রহস্য উদঘাটন করতে। সেই কমিশন রিপোর্ট একটা দিয়েছে সরকারকে ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর। কিন্তু সেই রিপোর্টে কি আছে, কে দায়ী? সেই রিপোর্ট আজও প্রকাশ্যে আসেনি। রত্নভান্ডার নিয়ে এবারের নির্বাচনে বিজেপির একটা মস্ত বড় ইস্যুও হয়েছিল। সেইকারণে রত্নভান্ডারের চাবির রহস্য সমাধান করা দায়িত্বও তাদের।
 
রত্নভান্ডারের যেটা বাইরের স্তর যাকে বলে আউটার চেম্বার সেখানে তিনটে তালা ছিল। এই তিনটি তালার মধ্যে একটা পুরির রাজার কাছে তার চাবি আছে। অন্য যে চাবিগুলো সেগুলো মন্দির প্রশাসনের কাছে ছিল আর ছিল ভাণ্ডারমেকআপ অর্থাৎ কেয়ারটেকার যাকে বলা হয় তাঁর কাছে। ভেতরের যে চেম্বার সেটার ডবল লক সিস্টেম আছে। যার চাবি জেলার ট্রেজারির কাছে আছে। এখন এই টিমের সদস্যরা চাবি তালার রহস্যটা ভেদ করার চেষ্টা করছে। এই চাবিগুলো হারালো কার কাছে! কোন চাবি হারাল? কার কাছে কোন চাবি আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
 

Advertisement

পুরীর জগন্নাথধামকে কেন্দ্র করে কত রকমের জনজীবন
 
 প্রত্যেক বছর কিন্তু নুতন রথ তৈরি হয়। এবারে যে রথে প্রভু ফিরলেন তার জন্মস্থান থেকে শ্রীমন্দিরে। এরপর এই রথটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হবে।‌ এটাই প্রথা। এটাই হয়ে আসছে। এবার রথযাত্রায় শুধু প্রভুর সঙ্গে দেখা হলো কথা হলো তা তো নয়। প্রভু কতরকমের মানুষের হৃদয়ে বসবাস করছেন সেরকম কত মানুষের দেখা পেলাম। জগন্নাথ মন্দিরের কাছেই একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। সেই চায়ের দোকানটি চালায় এক মহিলা। বয়স কত হবে? পঞ্চাশের কম। নাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন আমার নাম জিনা। তার একটি ছোট্ট মেয়ে আছে। সে এসেও মাঝে মাঝে তাকে সাহায্য করছে। কিন্তু সে বড় রুগ্ন। কিন্তু মুখটা মহালক্ষ্মীর মত।

Advertisement


সমগ্র পুরীধামে ঠিক মোট কতটি চায়ের দোকান আছে তার পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর। বলা যেতে পারে হাজার হাজার। শুধু তীর্থযাত্রীদের চা বিক্রি করে কত সংসার চলছে এই জগন্নাথধামে। জগন্নাথ মন্দিরের দিকে এগিয়ে চলেছি। দুধারে কত শত দোকান। জিবেগজার দোকান।‌ মহাপ্রসাদ বিক্রি হচ্ছে ছোট ছোট পুঁটলি করে ১০ টাকা,১৫ টাকা মূল্যে। আবার বাসন-কোসন। ঠাকুরের বাসনের দোকান। তারই মধ্যে আছে হোটেল রেস্তোরা। আবার সম্ভবত বিদেশীদের আকর্ষণ করার জন্য ছোট ছোট কাফে-বার ইত্যাদি। এইরকম চায়ের দোকানে কাপে দুধ চা ১০ টাকা,মাটির ভাঁড়ে খেলে ১৫ টাকা। ভাঁড়ে খাওয়ার মজা একটু আলাদা। একটা মাটির সোঁদা গন্ধ পাওয়া যেতে পারে। চায়ের দোকানটি চালাচ্ছিলেন এক মহিলা। চায়ের দোকানের উল্টো দিকে যে বাড়ি সেই বাড়ির নীচের সিঁড়িতে আমার দাম্পত্য সঙ্গীনী বসলেন তো চায়ের দোকানের মহিলা একদম হাহা করে উঠলেন। বললেন ওখানে বসবেন না বসবেন না। কারণটা জানা গেল যে বাড়িওয়ালী উপরের জানলা দিয়ে দেখে আর যেই কেউ ওখানে বসবে সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে চীৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেবে চাওয়ালীর সঙ্গে। সে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দিল। সেইখানে বরং বসলে কোন বিপদ নেই। চায়ের দোকানে হরেকরকমের স্থানীয় (লোকাল বেকারি)বিস্কুট পাওয়া যায়।এমনটা সব জায়গাতেই অবশ্য পাওয়া যায়। প্লাস্টিকের জার তাতে নানান রকমের বিস্কুট থাকে। সব চায়ের দোকানেই নানান রকমের চা পাওয়া যায়। যেমন দুধ চা,কালো চা,লেবু দেওয়া চা,চিনি ছাড়া কালো চা,চিনি ছাড়া দুধ চা,দুধ কফি,কালো কফি,মশলা দেওয়া চা। আজকাল চিনি ছাড়া চা দোকানগুলিতে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ ফ্লাক্সে ভরে রাখে,কেউ কেউ সঙ্গে সঙ্গে বানিয়েও দেয়। ফ্লাক্সে বানানো চা কিছুক্ষণের মধ্যে একটু তেঁতো তেঁতো স্বাদ হয়ে যায়। এবং সেই কারণে অনেকে টাটকা চা খেতে চায়। এইরকমভাবে পুরীর জগন্নাথধামকে কেন্দ্র করে কত রকমের জনজীবন। আগে যখন ছোটবেলায় পুরীতে আসতাম তখনও অনেক বেশি ফটোগ্রাফার ছিল পুরীর সমুদ্রে। সেই ফটোগ্রাফারেরা এসে ফটো তুলতে চাইত। এখনও যে নেই তাই নয়। বিশেষ‌ করে পুরীতে বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমাতে এসে ছবি না তুলে কোন বাঙালি দম্পতি চলে গেছে এরকম নজির তো তখন ছিলই না। এখন অবশ্য মোবাইল হয়ে যাওয়ায় মোবাইলে ছবি তোলাটা এত সহজ হয়ে গেছে যে ছবি তুলতে কোন অসুবিধা হয়না। বললে‌ও অন্য কোন সহযাত্রী ছবি তুলে দেয়। আগে সমুদ্রের মধ্যে অনেক ঝিনুক পেতাম। আমরা শৈশবে সেইসব ঝিনুক প্লাস্টিকের থলেতে করে ভরে নিয়ে আসতাম কলকাতায়। ঝিনুকে ঝিনুকে ছয়লাপ ছিল। এখন পুরীর বালুকাবেলায় ঝিনুক অদৃশ্য। কারণটা সঠিকভাবে আমি জানিনা। তবে অনেকে বলেন যে দূষণের জন্য ক্লাইমেট পরিবর্তনের জন্য সমুদ্রে এখন শামুকের সংখ্যাও কমে গেছে। অন্তত সমুদ্রের উপরিতলে আসে না। ঢেউয়ের সঙ্গে সেইসব শামুক গুলো এসে যে ঝিনুক দিয়ে যাবে সে আর পাওয়া গেল না। ‘মুক্ত’ ছিল না বলে গানে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন  পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়,নচিকেতা ঘোষের কম্পোজিশনে , বনশ্রী সেনগুপ্তের কন্ঠে সেই বিখ্যাত গান—- ‘এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না যেখানে মুক্ত আছে’। ঝিনুক এখন আর সমুদ্র‌ বালুকায় পাওয়া যায় না। কিন্তু সমুদ্রের ধারে কিছু দোকানে,(যেমন দার্জিলিংয়ের মোমো জীবনে যা কখনও দেখিনি তাও এখন এখানে বিরাট ভাবে বিক্রি হচ্ছে) সেইভাবে অনেক ছোট,বড়,মাঝারি ঝিনুক একত্রিত করে ছোট ছোট প্যাকেটে করে ৮০ টাকা,১০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এখন ঝিনুক এখানে এসে মানুষকে কিনতে হচ্ছে।
 
আমরা তো এবারে  বালুকাবেলায় মুক্ত কেন? ঝিনুকই খুঁজে পেলাম না, সেই দুঃখটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
 
পুরী আর কাশী। কোথায় যেন একটা সংযোগ আছে। যখন জগন্নাথ মন্দিরের দিকে হেঁটে হেঁটে আমরা যাচ্ছি তখন একদম মন্দিরের গায়ের প্রাচীন দু-তিন তলা বাড়ি। খুপরি খুপরি ঘর। গরাদ দেওয়া জানালা। সেই জানালা দিয়ে হয়তো কোন বালিকা জগন্নাথদেবের মন্দিরের উপরে পতপত করে উড়তে থাকা পতাকার দিকে তাকিয়ে আছে। সমুদ্রের হাওয়া এসে উড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিক। আকাশে অসাধারণ মেঘমালা।‌ তখনিই যেন মনে হয় এই বাড়িগুলো বেনারসের দশ্বামেধ ঘাটের অথবা বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরের আশেপাশে প্রাচীন বাড়িগুলোর মত। ঠিক যেরকম কাশীর বসবাসকারীরা।
 
সাংবাদিক মার্ক টালির আত্মজৈবনিক গ্রন্থেও পড়েছিলাম প্রথম অধ্যায়টি ছিল পুরী আর বইটির শেষ অধ্যায় ছিল কাশী। মার্ক টালি কলকাতায় পড়াশোনা করেছিলেন। বাবা সেখানে কর্মরত ছিলেন। তখন মার্ক খুব ছোট তখন তাঁর বাবা পুরীতে বেড়াতে নিয়ে এসেছিলেন। সেই পুরীর দর্শনের মধ্য দিয়েই মার্ক টালির প্রথম ভারত চেতনার উন্মেষ হয়েছিল। আবার শেষ অধ্যায়ে ছিল কাশী। যেখানে মার্ক তার জীবনের সায়াহ্নের উপলব্ধির বর্ণনা দিয়েছেন। কাশীতে এসে মানুষ মুক্তি চাইছে‌। মোক্ষ চাইছে। মণিকর্ণিকা ঘাটে পুড়তে থাকা শবদেহ। জীবনের সার-সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে চলেছে।  জগন্নাথধামে এসে শ্রীশ্রী মায়ের কথা মনে পড়ে। কাশীতে এসেও মনে পড়ে মায়ের জীবনের নানা ঘটনা। যা কাশী আশ্রমের সঙ্গেও যুক্ত। জগন্নাথ দর্শনের সময় পুরীতে শ্রীশ্রীমা মন্দিরের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখে ছিলেন ভক্তদের ঢল নামছে। শয়ে-শয়ে নর-নারী জগন্নাথ দেখতে ছুটে আসছেন।‌ একসঙ্গে এত লোক দেখে মা আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। বললেন আহা বেশ। এতো লোক মুগ্ধ হয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে এই সত্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে  না যারা বাসনা শূন্য সেই এক আধটি মুক্ত হয়। স্বামী গম্ভীরানন্দের লেখা ‘শ্রীমা সারদা দেবী’ গ্রন্হে তো সে কথাই উল্লিখিত আছে। আসলে গীতাতেও তো সেকথাই বলা হচ্ছে। সেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কোন একজন আমাকে পাওয়ার জন্য যত্ন করে। আর সেই যত্ন কারীদের মধ্যেও হয়তো কোন একজন আমার শরণাগত হতে পারে। আমাকে জানতে পারে। গীতার সপ্তম অধ্যায়ে বর্ণিত।

Advertisement

মায়াকে কর্মরূপ বন্ধন দ্বারা ছেদন করা যায় না


আসলে উৎকল খন্ডে প্রথম অধ্যায়ের ২৪ থেকে ২৫ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে -হে পরমেশ্বর,তুমি জগতের গতি। তুমিই পালন কর্তা। এবং তুমিই এর সাক্ষী। হে কৃপায়ময়,তুমি এই চরাচর জগতের গুরু ও সকল জীবের বীজ স্বরূপ। হে জগন্নাথ আমি নিয়ত তোমার শরণাগত,আমার প্রতি প্রসন্ন হও। ব্রহ্মার প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে শ্রীবিষ্ণু তাঁকে দর্শন দিলেন। আর বললেন তুমি যে কারণে আমার স্তব করছো তা আমার শক্তির অধীন নয়। মায়াকে কর্মরূপ বন্ধন দ্বারা ছেদন করা যায় না। সুতরাং সংসারে এই মায়ার প্রভাব থাকতে কি করে জন্ম মৃত্যু মুছে যাবে? তবে তুমি যদি সত্যি সত্যি জানতে চাও তবে যে নিয়মে জন্ম মৃত্যু না হয় তার কারণ আমি তোমাকে বলছি।– (এটাও উৎকল খণ্ড থেকে গৃহীত। খন্ড-১,২৮ থেকে ৩০ স্তব)। এই বলে শ্রীহরি সমুদ্র তীরের পুরী ধামের অবস্থান বর্ণনা করতে শুরু করছেন। সেখানে তিনি বলছেন সমুদ্রের উত্তর তীরে মহানদী নদীর দক্ষিণ প্রদেশটি পৃথিবীর মধ্যে সকল তীর্থের ফল দান করে। হে ব্রহ্মা সমুদ্রতীরে যে স্থানে নীলপর্বত বিরাজিত পৃথিবীর মধ্যে সেই স্থানটি গোপনীয় এবং অতি দুর্লভ। দেবতা অসুর কেইই সেই স্থানের খবর জানেন না। আমি নিজেই আমার মায়া দ্বারা সে স্হান আড়াল‌ করে রেখেছি। আমি সেই পুরুষোত্তম ক্ষেত্রেই দেহ ধারণ করে নিত্য অবস্থান করি। শ্রীক্ষেত্রের এই হলো মাহাত্ম্য। এখানে ‘রৌহিণ’ নামক যে কুন্ড, সেই কুন্ডের তীরে আমাকে চর্মচক্ষুতে দর্শন করে জীবেরা সেই কুন্ডের জলে পবিত্র নিস্পাপ হয়ে আমার সাযুজ্য লাভ করে। আজ যখন সেই কুন্ডের সামনে দাঁড়ালাম কোন ব্রাহ্মণ সেই জলধারা সারা শরীরে ছিটিয়ে দিল তখন উৎকল‌খণ্ডের এই স্তব মনে পড়বে। সমস্যা হচ্ছে পরিবেশ পরিস্থিতি সব কেমন বদলে গেছে। এমনকি যিনি জল ছেটাচ্ছেন তার সঙ্গে কোন এক ভক্ত ঝগড়া করছে যে তার গায়ে যথেষ্ট জলের ছিটে লাগেনি বলে। আরো বেশি বেশি করে জল ছেটানোর জন্য দাবি জানাচ্ছে। আর যে জল ছেটাচ্ছে সে জল ছিটিয়ে আশা করছে তাকে যথেষ্ট পয়সা যাতে দেওয়া হয়। সবটাই কেমন একটা বাণিজ্যিক এবং রূঢ় বাস্তবের স্বীকার। তবে মনটিকে ওই রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে যুক্ত করলেই বিপদ।‌ সেখান থেকে নিজেকে মুক্ত করে বৃহৎ ভাবনার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।
 

Advertisement

এখানে স্থানীয় মানুষেদের মধ্যেও কত জগন্নাথ ভাবনা,ঈশ্বর ভাবনা। চা খাচ্ছিলাম যখন তখন সেই চাওয়ালি বলেছেন,দেখেছো,শুনেছো বলরাম পড়ে গেলেন! ভগবান আমাদের চেতনা জাগ্রত করার জন্য কত কিছুই না করছেন। কিন্তু তবুও আমাদের চেতনা জাগ্রত হয় না। আমরা  বুঝতেই পারিনা আমরা কী ভুল করেছি। কত পাপ কত অন্যায় করে চলেছি। এইসব বলতে‌ বলতে হঠাৎ উপরে দেখি জানালার দিয়ে সেই ভদ্রমহিলা নিচে সিঁড়িতে নজর রাখছেন কেউ বসছে কিনা। না কেউ বসে নেই। তখন চাওয়ালি বলল কার বাড়ি কার ঘর,কি নিয়ে এসেছি,কি নিয়ে যাব? মনে মনে ভাবলাম যে এই চাওয়ালি তার কথা দিয়ে যেন আমাদের কত লোকশিক্ষা দিয়ে দিল। এমনটাই হয়। সেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের হিমালয় ভ্রমণের সময় সেই পাহাড়ের কোলে বসবাসকারী এক দরিদ্র পরিবারকে দেখে যেমন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষ কত কষ্টের মধ্যেও কত আনন্দ করে জীবন কাটাচ্ছে। এবারও তো তাই দেখছি কত গরীব মানুষ,কত প্রান্তিক মানুষ কি সাংঘাতিক লড়াই করছে। সমুদ্রের ধারে কত রকমের ছোট ছোট ব্যবসা‌ করে জীবন সংগ্রাম করছে। তার মধ্যে দিয়ে মানুষ জীবন সংগ্রাম করে হই করে আনন্দে করে বেঁচে আছে।
 
এবার আমার নটে গাছটি মুড়ানোর সময়। আজ রথযাত্রা ডায়েরি শেষ। শেষ পাতে এটাই শুধু বলার উপলব্ধি একটাই। আবেগ আর ভক্তি ভারতীয় মননের এ এক সহযাত্রা। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরের দশকে কোলকাতায় মিশনারী হয়ে কাজ করতে এসেছিলেন হ্যারিয়েট জি ব্রিটান (Harriet G.Brittan)। তিনি রথযাত্রা উৎসবের উপর গবেষণা করতে শুরু করেন। হ্যাঁ,ওনার এক ঔপনিবেশিক মিশনারী চোখ ছিল তবুও তাঁর বর্ণনা অনবদ্য। সমালোচনাও‌ ছিল। তিনি মনে করেছিলেন যে আমরা ভারতীয়রা এই রথযাত্রাকে মনে করি ঈশ্বরের কাছে গ্রহণযোগ্য আরাধনা। উনি বুঝতে ভুল করেছিলেন। শুধু রথযাত্রা নয়। ভারতীয় জীবনযাত্রার মধ্যে হিন্দুধর্মের আরাধনা লুকিয়ে রয়েছে। হিন্দু দেবতা এবং ধর্মীয় আচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে শ্রীরামপুর মিশনের বিখ্যাত ত্রয়ীর অন্যতম উইলিয়াম ওয়ার্ড(William Ward) যত্ন করে লিখেছিলেন মাহেশের রথের কথা।‌ তাঁর দেখা কাঠের রথের উচ্চতা ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুট। চাকার সংখ্যা ছিল ১৬। রথের সামনে কোচম্যান সহ দুটি ঘোড়ার মূর্তি থাকতো। রথে চড়ে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম মিলে রাধাবল্লভের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সেখানে তারা থাকেন আটদিন। সেসময় ভোগ তৈরির দায়িত্ব নেন‌ অন্তঃপুরবাসিনী ব্রাহ্মণীরা। এইসময় রথটি ফাঁকা দাঁড়িয়ে থাকে। লোক জড়ো হয়ে রথের চারপাশে আঁকা দেবদেবীর ছবি দেখে। আটদিন বাদে দেবতারা নিজেদের মন্দিরে‌ ফেরৎ যেতেন। সাহেব লক্ষ্য করেছিলেন,রথযাত্রার তুলনায় পুনর্যাত্রায় অর্থাৎ ফেরা যাত্রা উৎযাপনে মানুষের উদ্দীপনার ঘাটতি থেকে যায়। যাইহোক,রথের মেলায় অবশ্য খুব জুয়া খেলা হতো। আর সেই জুয়া সাংঘাতিক ভাবে প্রভাব ফেলেছিল সেই সময়কার সমাজে। এই জুয়ার যারপরনাই জনপ্রিয়তা অবশ্য সেকালের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার‌ও চোখে পড়েছিল। হুগলির কালেক্টর উইলিয়াম হার্শেল লিখেছিলেন যে নিরাপদ খাবার,জল,থাকার জায়গার অভাবে সুস্থ সবল মানুষ পুরীতে তীর্থ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এমনকি মারা যাচ্ছে। ১৯ শতক জুড়ে রথের সময় পুরীতে তীর্থ করতে যাওয়া যাত্রীদের স্বাস্থ্য নিয়ে বিচলিত হয়েছে সেই সময়কার প্রশাসন। পাশাপাশি রথের সামনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জনের একটা কুপ্রথা তৈরি হয়েছিল। মিশনারীরা যার কড়া নিন্দা করছেন। এইসব নিয়ে ভারতে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রথযাত্রা উৎসব থেকে গিয়েছে তাদের লেখালেখিতে।
 
আজ এত বছর পর পুরীর জগন্নাথ মন্দির এবং রথযাত্রা দেখে মনে হল আজও অনেক নেতিবাচক দিক আছে বটে। সে তো গুপ্তি পাড়ায় জগন্নাথ প্রভুর প্রসাদ পুলিশের চোখের সামনে লুঠ হয়ে গেল। এ এক ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্তের মনস্তত্ত্ব। যারা এসেছিলেন এই মহাপ্রসাদ লুঠ করতে তারা গায়ে তেল মেখে এসেছিল। যাতে তাদের কেউ ধরতে না পারে। আসলে পৃথিবীতে কোন কিছুই আদর্শ‌ হয় না। আজ এত বছর পর পুরীতে এসে মনে হচ্ছে যে কতকিছু খারাপ ছিল যা আজ নেই। কত ষকিছু ভাল হয়েছে। আবার এত কিছু ভালর মধ্যেও কত রকমের কুপ্রথা,কুসংস্কার আমাদের মানসিক অবনয়ন‌ সবকিছু তার সঙ্গে সঙ্গে চলছে। কজন আমরা পরমহংসের মতো শুধু জল ফেলে দিয়ে দুধটুকু নিতে পারি।

Advertisement

শেষ

Advertisement