গত শনিবার মেদিনীপুর কলেজ মাঠে মেগা ইভেন্টে অমিত শাহের হাত থেকে বিজেপির পতাকা তুলে নিয়েছিলেন একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর সঙ্গে একাধিক তৃণমূল বিধায়ক সেদিন দলবদল করেন। মনে করা হচ্ছিল শুভেন্দুর চলে যাওয়া ঘাসফুল শিবিরে বড় ধাক্কা। এর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাল্টা ধাক্কা দিল তৃণমূল। বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁয়ের স্ত্রী সোমবার তৃণমূলের সদর দফতরে গিয়ে সৌগত রায়ের হাত থেকে তুলে নিলেন দলীয় পাতাকা। বিজেপি সাংসদের স্ত্রীর এমন আচরণে কার্যত অবাক রাজনৈতিক মহল।
বছর দুয়েক আগে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দলের অঘোষিত দুনম্বর নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগরে দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন বিষ্ণুপুরের তৃণমূল সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। সেদনি সৌমিত্রর পাশেই ছিলেন স্ত্রী সুজাতা মণ্ডল খাঁ।
গত লোকসভা ভোটে সৌমিত্রকে বিজেপি প্রার্থী করেছিল বিষ্ণুপুর কেন্দ্রে। কিন্তু একাধিক মামলায় অভিযুক্ত সৌমিত্র বাঁকুড়া জেলার কোথাও, মানে বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছ’টি বিধানসভা ক্ষেত্রে প্রচারের জন্য ঢুকতেই পারেননি আদালতের নির্দেশে। সৌমিত্রর অনুপস্থিতিতে প্রচার করেছিলেন মূলত তাঁর স্ত্রী সুজাতা। প্রচারে কায়াহীন স্বামীর ছায়া হয়ে। কার্যত সুজাতার প্রচারেই বিষ্ণুপুর থেকে দ্বিতীয় বার সাংসদ হন সৌমিত্র। ২০১৪-তে হয়েছিলেন তৃণমূলের সাংসদ। ২০১৯-এ বিজেপির।
কেন্দ্রের প্রায় ৮০ শতাংশ জায়গায় প্রচার না করেও প্রার্থী জিতেছেন, এমনটা এই রাজ্যের লোকসভা ভোটে এক রকম নজিরবিহীন। বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে খণ্ডঘোষ বিধানসভা ক্ষেত্রটি পূর্ব বর্ধমান জেলায়। মামলায় অভিযুক্ত সৌমিত্র খাঁ আদালতের নির্দেশে সীমাবদ্ধ ছিলেন শুধু ওই কেন্দ্রে। অথচ, বিষ্ণুপুরের সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্রের মধ্যে কেবল ওই খণ্ডঘোষেই লিড পেয়েছে তৃণমূল। তা-ও আবার ৩০ হাজারের বেশি ভোটে। আর বাকি যে ছ’টি বিধানসভা ক্ষেত্র যেখানে সৌমিত্র ঢুকতেই পারেননি, তার প্রতিটিতেই তিনি লিড পেয়েছিলেন। সৌমিত্রর হয়ে কার্যত একাই বিজেপির প্রচার সামলান সুজাতা মণ্ডল খাঁ। ভোটের দিনও তৃণমূলের বাহিনীর বিরুদ্ধে একা লড়তে দেখা যায় তাঁকে। ভোটে জেতার জন্য যাবতীয় কৃতিত্ব সৌমিত্র স্ত্রীকেই দিয়েছিলেন। সেই সময় বিজেপির এক শীর্ষ নেতা মজা করে বলেছিলেন, ‘সৌমিত্রর উচিত সাংসদ পদটা ওর স্ত্রীকে দিয়ে দেওয়া।’
লোকসভা ভোটের পর দেড় বছর পার করেছে। সামনেই ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট। সেই ভোটকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছে বিজেপি শিবির। মাঠে-ময়দানে প্রচারের উত্তাপও বাড়তে শুরু করেছে। গেরুয়া শিবিরের অন্যতম সেনাপতি হয়েছেন সৌমিত্র। দলের শীর্ষনেতাদের সঙ্গেই দেখা যাচ্ছে তাঁকে। আর এই আবহে সৌমিত্র জায়ার ভোল বদল তাই সকলকেই অবাক করে তুলছে। রাজনৈতিক ও পারিবারিকভাবে স্বামীর সঙ্গে সুজাতার দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, সেই কারণেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে যোগ দিয়ে সুজাতা বলেন, তিনি মহিলা হিসেবে সম্মান পেতে এবং একজন সৎ নেতার সঙ্গে কাজ করার জন্য দলে যোগ দিচ্ছেন। তাঁর অভিযোগ, বিজেপিতে থেকে তিনি সম্মান পাচ্ছিলেন না। নানা সমস্যার মধ্যে কাটাতে হচ্ছিল তাঁকে। তৃণমূলে ফিরে তিনি নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারছেন বলেও মন্তব্য করেন সুজাতা। তৃণমূলে ফিরে সুজাতা তাঁর স্বামীরও ঘরওয়াপসির ব্যাপারে আশাপ্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী এবং বর্তমান বিজেপি সাংসদের কিছুটা শুভবুদ্ধি হোক এবং উনিও আসল জায়গায় ফেরত আসুন। এদিন শুভেন্দু অধিকারীকে বিজেপিতে নেওয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন সুজাতা।
প্রশ্ন উঠছে , রাজ্য বিজেপির যুব মোর্চার সভাপতি সৌমিত্রের সঙ্গে আলোচনা করেই কি সুজাতা তৃণমূলে এলেন? কিন্তু স্ত্রীয়ের এভাবে দলবদলে অবাক নাকি সৌমিত্রও। সুজাতার দলবদলের অব্যবহিত পরেই সৌমিত্র তাঁকে বিবাহবিচ্ছেদের নোটিস পাঠিয়েছেন। ডিভোর্সের কথা বলতে গিয়ে এদিন কেঁদে ফেলেন সাংসদ। তাঁর কথায়, 'আমি ওকে স্বপ্নে, ভালবাসায় মুড়তে পারি। কিন্তু যেভাবে দল পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে আর কোনওদিন এক হওয়া যাবে না।'
পারিবারিক সম্পর্কে রাজনীতি এসেছে, তাই গত ৭ দিন নাকি দু'জনের কোনও কথা হয়নি। শুধু যোগাযোগের মাধ্যম ছিল হোয়াটসঅ্যাপ। তবে স্ত্রীর এমন সিদ্ধান্তে সৌমিত্র বাধা দেবেন না বলেই দাবি করছেন। সৌমিত্রের কথায়, বাচ্চা মেয়ে, ভুল করল। উচ্চাকাঙ্খা থেকেই তৃণমূলে গেলে বড় জায়গা পাবে এমন ভেবে সুজাতার এই চরম সিদ্ধান্ত বলেই মনে করছেন বিষ্ণুপুরের সাংসদ। তাই কান্না জড়ানো গলায় সৌমিত্র বলছেন, "আমি তোমাকে ভালবেসেছি, আমার লড়াই তোমার বিরুদ্ধে নয়, তৃণমূলের বিরুদ্ধে। একজনকে ভালবাসতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বপ্নকে হারিয়ে দিতে পারি না।"
এদিকে গত অক্টোবরেই দলের যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন সৌমিত্র। সংগঠনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়ে বেরিয়ে যান। যদিও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সিদ্ধান্ত বদলে নেন। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের দলের যুব মোর্চার সমস্ত জেলা কমিটি ভেঙে দিওয়াই ছিল এর পেছনে মূল কারণ। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে এসেই দলে বড় পদ পেয়েছিলেন সৌমিত্র খাঁ। সাংসদ হওয়ার পাশাপাশি তাঁকে রাজ্য বিজেপির যুব মোর্চার সভাপতি করা হয়েছিল।
আগামী দিনে তাঁর স্বামীও তাঁরই পথ অনুসরণ করবেন বলে আশাপ্রকাশ করছেন সুজাতা। অন্যদিকে সৌমিত্রর দাবি, তৃণমূলে ফেরা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনও কথা হয়নি। লোকসভা ভোটের সময় বিষ্ণুপুরে বিজেপির জন্য নয়, নিজের স্বামীর জন্য লড়েছিলেন সুজাতা। তারপরেও দলে বড় পদ না পাওয়ায় মনক্ষুন্ন হয়েছিল। সৌমিত্রর কথায়, বিজেপির নিয়ম নয় একই পার্টিতে দু’জন দুটো পদ পাবে। ভেবেছিলেন, জানুয়ারিতে বিয়ের অ্যালবাম বানাবেন, তা আর হল না, উল্টে ডিভোর্সের নোটিস পাঠাতে হল সাংসদ স্বামীকে। ভালবাসাকে পেছনে ফেলে স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক এই লড়াই রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যায় সেটাই এখন দেখার!