
মতুয়াদের মতই দুই দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশী ভোটশীতলকুচির ঘটনা নিয়ে তৃণমূল ‘ভোটব্যাঙ্ক’-এর রাজনীতি করছে। অভিযোগ স্বয়ং দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা অমিত শাহের। যিনি ভোটবাংলায় বর্তমানে ডেইলি প্যাসেঞ্জারে পরিণত হয়েছেন। ১০ এপ্রিল চতুর্থ দফায় ভোট শুরু হতে না হতেই কোচবিহারের শীতলকুচিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ১৮ বছরের আনন্দ বর্মনের। সেখানে থেকেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত জনতা-বাহিনী খণ্ডযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় আরও চার জনের। এই ঘটনা নিয়েই এখন উত্তাল বঙ্গরাজনীতি। গেরুয়া শিবিরের অভিযোগ শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে ৪ জনের মৃত্যুর আগেই বুথের লাইনে আনন্দের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু আনন্দ রাজবংশী হওয়াতেই তাঁর মৃত্যু নিয়ে উদাসীন রয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। শীতলকুচির ঘটনা নিয়ে তোষণের রাজনীতি করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বারবার ভোটপ্রচারে এসে এমনটাই দাবি করছেন অমিত শাহ। দিদির ভোটব্যাঙ্ক না হওয়াতেই রাজবংশী আনন্দের মৃত্যু নিয়ে মন্তব্য করেননি মমতা, এমনটাই অভিযোগ শাহী শিবিরের। উত্তরবঙ্গে কিন্তু রাজবংশী ভোটব্যাঙ্ক একটা বড় ফ্যাক্টর। যা অনেক হিসেব নিকেশ বদলে দিতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে উত্তরবঙ্গের ৫৪টি আসনের মধ্যে ৩২টি আসনেই রাজবংশীদের প্রভাব রয়েছে।
মতুয়াদের মতই গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশীরা
দক্ষিণবঙ্গে যেমন রাজনৈতিক দলগুলির কাছে ফ্যাক্টর মতুয়া ভোট উত্তরবঙ্গে ঠিক তেমনি প্রভাব রয়েছে রাজবংশীদের। তাই এরাজ্যে ভোট এলেই মতুয়াদের মত বাড়তি গুরুত্ব পায় রাজংবশী সম্প্রদায়। একুশের ভোটে উত্তরবঙ্গের দখল কার হাতে থাকবে তার নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে চলেছে রাজবংশীরাই। উনিশের ভোটে কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারে রাজবংশী সম্প্রদায়ের সমর্থনের বেশিরভাগটাই গেছিল গেরুয়া শিবিরের দিকে। আর তার জেরেই উনিশের ভোটে উত্তরে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসকে।

উত্তরবঙ্গের ৬টি জেলায় রাজবংশী প্রভাব
উত্তরবঙ্গের ছয়টি জেলা যথাক্রমে কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিংয়ের সমতলভূমি, উত্তর দিনাজপুর এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের কিছু অংশ জুড়ে বাস রাজবংশী সম্প্রদায়ের। সমীক্ষা অনুযায়ী উত্তরবঙ্গের ৫৪টি আসনের মধ্যে ৩২ টি আসনের মোট ভোটারের ২০ শতাংশই রাজবংশী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। এই ৩২ আসনের মধ্যে আবার কোচবিহারে রয়েছে ৯টি আসন, আলিপুরদুয়ারে ৩টি, জলপাইগুড়িতে ৬টি, দার্জিলিংয়ে দুটি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে রয়েছে ৬টি করে আসন।
রাজবংশী ভোট এবার কোন দিকে?
উত্তরবঙ্গে রাজবংশী ভোট প্রায় ৩৪ শতাংশ।এরমধ্যে কোচবিহার জেলায় রাজবংশী ভোট প্রায় ৬২ শতাংশ। জলপাইগুড়িতে রাজবংশী ভোট প্রায় ৫০ শতাংশ। আলিপুরদুয়ারে ৩৮ শতাংশ ৷ উত্তর দিনাজপুরে ৫২ শতাংশ ৷ দক্ষিণ দিনাজপুরে ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ উত্তরবঙ্গ দখলে রাখতে গেলে রাজবংশী ভোট বিজেপির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে ভোট ঘোষণার আগেই রাজবংশীদের মন জয়ে একগুচ্ছ ঘোষণা করতে দেখা গেছে অমিত শাহকে। এরমধ্যে অন্যতম হল আড়াইশো কোটি টাকা খরচ করে পঞ্চানন বর্মার মূর্তি তৈরি ৷ পঞ্চানন বর্মার মূর্তি তৈরির জন্য ২৫০ কোটি টাকা খরচ করবে কেন্দ্র এমন আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে ৷ নারায়ণী সেনার বীরত্ব মনে রাখতে আধাসামরিক বাহিনীতে নারায়ণী ব্যাটেলিয়ন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদী সরকার। বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নাম রাজবংশী বীর চিলা রায়ের নামে রাখা হয়েছে। এদিকে পিছিয়ে নেই তৃণমূলনেত্রীও। পঞ্চানন বর্মার জন্মদিনে ছুটি ঘোষণা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য পুলিশে নতুন তিনটি ব্যাটালিয়ান গড়ার ঘোষণা করেছেন মমতা। এরমধ্যে অন্যতম হল নারায়ণী ব্যাটেলিয়ান ৷ জানিয়েছেন কোচবিহারের নতুন বাহিনীর নাম রাখা হবে নারায়ণী ব্যাটালিয়ান।
রাজবংশী ও নাগরিকত্ব আইন
তবে বর্তমানে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল হোক বা তাদের প্রতিপক্ষ, কেউই রাজবংশীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সেই আস্থা অর্জন করতে পারেনি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ১০ বছরে রাজবংশীদের উন্নয়নে সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি রাজ্যের শাসক দল। এদিকে গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ভোট বিজেপির দিকে গেলেও প্রতিবেশী রাজ্য অসমে নাগরিকত্ব আইনের ফলে রাজবংশী সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ বাদ পড়েছেন তালিকা থেকে। যা বাংলার রাজবংশীদের মনে বড় আশঙ্কা তৈরি করেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। এই ইস্যু নিয়ে উত্তরবঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বিজেপিকে আক্রমণ করে প্রচার করেছে তৃণমূল।

রাজংবশীদের ইতিহাস
রাজবংশী সম্প্রদায়ের উৎস ও ইতিহাস ঘিরে নানাবিধ তত্ত্ব রয়েছে। উনিশ শতকের শেষদিকের আদমশুমারি অনুযায়ী, ব্রিটিশরা এই সম্প্রদায়কে কোচ আদিবাসীদের মতো অনার্য বলে চিহ্নিত করে। যদিও রাজবংশীরা এর প্রতিবাদ করে। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার নেতৃত্বে শুরু হয় সামাজিক আন্দোলন। ইতিহাসে যা ক্ষত্রিয় আন্দোলন বলেও পরিচিত। এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ, ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে ব্রিটিশরা কোচ ও রাজবংশী সম্প্রদায়কে পৃথক শ্রেণিতে ভাগ করতে একপ্রকার বাধ্য হয়। এদিকে স্বাধীনতার মাত্র দেড় শতকের মধ্যে রাজবংশীরা আবারও একটি আন্দোলন করে। এবারের সংগ্রাম শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে রাজবংশী ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে। পরবর্তীতে রাজবংশী আবেগকে সংঘবদ্ধ করে কামতাপুরী পিপলস পার্টি । সেই আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও আবেগ এখনও উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় ভীষণভাবে সক্রিয়। এদিকে পৃথক রাজ্যের দাবিতে বেশ কিছু দিন ধরেই জোট বেঁধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন এবং কামতাপুর প্রগ্রেসিভ পার্টি (কেপিপি) । পৃথক রাজ্যের পাশাপাশি ভাষার স্বীকৃতি, পাঠ্যক্রম চালু ইত্যাদি নিয়েও তৎপরতা দেখা গিয়েছে ।সাধারণত রাজবংশীরা চেহারায় খর্বকায়। এঁরা হয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী নয়তো শিবের উপাসক।

আনন্দ বর্মন ও একুশের রাজবংশী ভোট
গত ১০ এপ্রিল জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে গিয়ে বুথের লাইনে দাঁড়িয়েই মৃত্যু হয় ১৮ বছরের আনন্দ বর্মনের। আনন্দ রাজবংশী সম্প্রদায়ের যুবক। দিদির ভোটব্যাঙ্ক নয়। সেই কারণেই তাঁর মৃত্যু নিয়ে কোনও মন্তব্য করছেন না মমতা, শীতলকুচি কাণ্ডের পর এমনটাই অভিযোগ ছিল অমিত শাহের। এদিকে রবিবার মমতা শীচলকুচি যাবেন ঘোষণা করলেনও কমিশনের নিষেধাজ্ঞায় সেই সফর বাতিল করতে হয়। রবিবার শীতলকুচিতে সিআরপিএফের গুলিতে নিহত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪ ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন তৃণমূলনেত্রী। সেদিন বর্মন পরিবারের কাছে কোনও কল আসেনি। মমতার এই পদক্ষেপ বিরোধীদের ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির অভিযোগকেই মান্যতা দিচ্ছিল। যদিও সমোলাচনার মুখে দাঁড়িয়ে তৃণমূলনেত্রী জানান, তিনি আনন্দের পরিবারের সঙ্গেও দেখা করতে চান। বুধবার শীতলকুচি গিয়ে আনন্দের দাদু ও মামার সঙ্গে দেখা করেন মমতা। আশ্বাস দেন আনন্দের খুনিদেরও ধরা হবে। তৃণমূল যখন উত্তরবঙ্গে ফের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছেন, তখন পাল্টা জমি ধরে রাখতে মরিয়া বিজেপিও। এই প্রেক্ষাপটে আনন্দ বর্মনের মৃত্যু নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভোটের আগে সব পক্ষই মরিয়া সব সম্প্রদায়ের ভোটব্যাঙ্ককে নিজেদের দিকে টানতে। এই আবহে দেখার এখন দেখার কোন দিকে যায় রাজবংশী ভোটব্যাঙ্ক।