scorecardresearch
 

মনে রাখিনি আমরা, দেশের ভোট ব্যবস্থার রূপকার ছিলেন কিন্তু এক বাঙালি

একুশের নির্বাচনের মাঝপথে বাংলা। আটদফা ভোটের চার দফা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাকি রয়েছে আর চার দফা। বাংলার মসনদ এবার কার তা নিয়ে প্রহর গুনছে সব রাজনৈতিক দলগুলিই। ভারতে এই গণতন্ত্রের উৎসবের সূচনা হয়েছিল কিন্তু এক বঙ্গ সন্তানের হাত ধরেই। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সেই দুরূহ কাজের জন্য ভরসা করেছিলেন বর্ধমানের এক বাঙালির উপর। দেশর প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন কীভাবে অসাধ্য সাধন করেছিলেন চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই গল্প।

Advertisement
ভারতীয় গণতন্ত্রের নেপথ্যের নায়ক বলা যায় সুকুমার সেনকে ভারতীয় গণতন্ত্রের নেপথ্যের নায়ক বলা যায় সুকুমার সেনকে
হাইলাইটস
  • ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৫১-৫২ সালে
  • এক বাঙালির নেতৃত্বেই আয়োজন করা হয়েছিল মহাযজ্ঞের
  • ভারতীয় গণতন্ত্রের নেপথ্যের নায়ক বলা যায় তাঁকে

একুশের নির্বাচনের মাঝপথে বাংলা। আটদফা ভোটের চার দফা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাকি রয়েছে আর চার দফা।  বাংলার মসনদ এবার কার তা নিয়ে প্রহর গুনছে সব রাজনৈতিক দলগুলিই। ভারতে এই গণতন্ত্রের উৎসবের সূচনা হয়েছিল কিন্তু এক বঙ্গ সন্তানের হাত ধরেই। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সেই দুরূহ কাজের জন্য ভরসা করেছিলেন বর্ধমানের এক বাঙালির উপর।  দেশর প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন কীভাবে অসাধ্য সাধন করেছিলেন চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই গল্প।

১৯৫১ সালে গঠিত হয় ভারতের নির্বাচন কমিশন
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই দেশজুড়ে নির্বাচন করানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। সেই মত ১৯৫১ সালে গঠিত  হয় ভারতের নির্বাচন কমিশন।  সদ্য স্বাধীন ভারতে  তখন হাজারো সমস্যা। খাদ্য-সহ নানা বিষয়ে দেশ তখন স্বনির্ভর নয়। উপরন্তু শিক্ষার হার মাত্র ১৫ শতাংশ। ফলে লোকসভা নির্বাচন কী, কিই বা তার প্রয়োজনীয়তা, সাধারণ লোককে তা বোঝানোই ছিল দুরুহ কাজ। বেশ কয়েক দফা আলোচনার পর ঠিক হয় যে নির্বাচন কমিশনের মাথায় বসানো হবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যসচিব , ১৯২১ ব্যাচের আই সি এস সুকুমার সেনকে। জানা যায় দেশের প্রথম নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব হাতে পাওয়ার দিন পনেরোর মাথায় সুকুমারবাবুর ডাক পড়েছিল  প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর অফিসে। বৈঠকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বেঁধে দেন সময়সীমা। ১৯৫২’র মার্চের মধ্যেই শেষ করতে হবে ভারতের প্রথম লোকসভা নির্বাচন।

 

সুকুমার সেনের কথা নেহেরুকে বলেন বিধানচন্দ্র রায়
সুকুমার সেনের কথা নেহেরুকে বলেন বিধানচন্দ্র রায়

বিধান রায়ের পরামর্শেই সুকুমার সেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়
বিধান রায়ের সঙ্গে নেহরুর নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল এবং অনেক বিষয়ে তিনি ডাক্তার রায়ের পরামর্শ নিতেন৷ ১৯৫০ সালে নেহরু বিধান রায়কে  জানান ভোট পরিচালনা করার জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা ৷ আর সেজন্য কাকে নির্বাচন কমিশনার করা যায় সে ব্যাপারে ডাক্তার রায়ের পরামর্শও চান৷  তখন সুকুমার সেন ছিলেন রাজ্যর মুখ্যসচিব ৷ বিধান রায়ের সেই সময় নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সুকুমার সেনকেই যোগ্য মনে হয়েছিল এবং সে কথা তিনি নেহেরুকে জানান৷ ফলে এই বঙ্গ সন্তানকেই বেছে নেওয়া হয় এই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য৷

Advertisement

 

বিধানচন্দ্র রায়
বিধানচন্দ্র রায়

কে এই সুকুমার সেন?
বর্ধমানের মানুষ সুকুমার সেন ছিলেন ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় মেধাবী। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অঙ্কে তিনি গোল্ড মেডেল পাওয়া স্নাতক। সুকুমার সেনের জন্ম ১৮৯৯ সালে। তিনি শুধু নয় তাঁর অন্য ভাইরাও স্বনামধন্য ছিলেন  নিজ নিজ কাজের জগতে৷  সুকুমার সেনরা তিন ভাই।  মেজভাই অশোক সেন বিশিষ্ট আইনজীবী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি পরবর্তীকালে ভারতের আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর ছোটোভাই অমিয়কুমার সেন বিশিষ্ট চিকিৎসক। রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসাও করেছিলেন  অমিয়কুমার সেন। সুকুমার ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্বর্ণপদক পান তিনি ৷ তারপর ১৯২১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে হয়েছিলেন বাংলার মুখ্যসচিব।

সুকুমার সেন
সুকুমার সেন

কীভাবে হল অসাধ্য সাধন?
 সুকুমার সেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার পদে ছিলেন ২১ মার্চ ১৯৫০ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৫৮। তিনি ভারতের প্রথম দুটি সাধারণ নির্বাচন অর্থাৎ ৫১-৫২ এবং ৫৭  সালের ভোট পরিচালনা করেন। বিশেষত ১৯৫১-৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করাটা ছিল বেশ কঠিন কাজ৷ কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের তুলনায় খুবই খারাপ ছিল তা বলাই বাহুল্য৷ ফলে অনেক বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতরা মনে করেছিলেন নির্বাচনের নামে ছেলে খেলা হবে৷ তাই সুকুমার সেনের কাজটা ছিল রীতিমতো কঠিন। তার মধ্যে চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়ে  দেশের ১৭.৬ কোটি ভোটারের ৮৫ শতাংশ ছিলেন নিরক্ষর ৷

প্রচারে ঝড় তুলেছেন 'বাংলার ক্রাশ', জানেন তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ?

নেহেরুর নির্দেশ পাওয়ার পর  সুকুমার সেন প্রথমেই হাত দেন ভোটার তালিকা তৈরিতে। দেশের পঁচাশি ভাগ মানুষ লেখাপড়া জানেনা। ফলে অত্যন্ত ধৈর্য ধরেই এগোতে হয়েছিল। কিন্তু তাতেও বিপত্তি। সেই সময়ে তালিকা তৈরি করতে যাওয়া সরকারি প্রতিনিধিদের সামনে গ্রামের মহিলারা নিজেদের নাম বলতেও নারাজ ছিল। কোথাও আবার পরপুরুষের সামনে আসাও মানা। ফলে সুকুমার সেনের টেবিলে যে লিস্ট পৌঁছেছিল তাতে অনেকের নামই ছিল ‘হরিদাসের বৌ’ বা ‘ জুলফিকারের বিবি’। এই পরিচয়ে তো আর গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করা যায় না। সুকুমারবাবু তাই সটান ওই ধরণের নাম কেটে বাদ দিয়ে দেন। এভাবে নাকি প্রায় ২৮ লাখ নাম বাদ গিয়েছিল সেই সময়ে।

সুভাষের ডানহাত থেকে দিদি'র দমকলমন্ত্রী, লড়াই এবার কতটা কঠিন?

মোট ৪ হাজার ৫০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। যার মধ্যে ৪৮৯টি লোকসভা আসন ছিল। বাকি বিধানসভার আসন। ভোট প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে গোটা দেশে ২ লক্ষ ২৪ হাজার বুথে ৫৬ হাজার প্রিসাইডিং অফিসার, ১৬ হাজার ৫০০ ক্লার্ককে নিযুক্ত করা হয়েছিল। শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য ছিল ২৭ হাজারের বেশী বুথ। গণনার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন ২ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ। ভোট পাহারায় মোতায়েন করা হয়েছিল ২ লক্ষ ২৪ হাজার পুলিশকর্মীকে। প্রতিটি প্রদেশে দু’জন করে আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশনার ও একজন করে মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুকুমার সেনকে সাহায্য করেছিলেন ভোট পরিচালনার কাজে।  ব্যালট বাক্স লেগেছিল ২০ লাখ। অশিক্ষায় জর্জরিত দেশের ভোট গ্রহণের জন্য আলাদা আলাদা রঙে আলাদা আলাদা দলের ব্যালট বাক্সের ব্যবস্থা করেছিলেন সুকুমার সেন। শুধু তাই নয় ১৯৫৭ সালের ভোটেও ওই বাক্সগুলিই ব্যবহার করা হয়েছিল যাতে খরচ বাঁচানো যায়। এই ভাবনাটিও ছিল সুকুমারবাবুর মস্তিষ্কপ্রসূত। এতেই শেষ নয়। কিভাবে ভোট দেবেন আমজনতা, তা বোঝানোর দরকার ছিল। সুকুমার সেনের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল প্রায় ৩০০০ নিউজ রিল। আকাশবাণী টানা তিনমাস লাগাতার রেডিওতে প্রচার করেছিল ভোট দেওয়ার পদ্ধতি। এতসব কর্মকান্ডের পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।  ১৯৫১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ভোট নেওয়া হয় মোট ৬৮ দফায়।

Advertisement

৬৮ দফায় ভোট হয়  ৭৩ দিন ধরে
প্রথমবার ভোট হয় ৭৩ দিন ধরে। শুরু হয় ১০ ডিসেম্বর, ১৯৫১ এবং শেষ হয় ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। ভোটার ছিল প্রায় সাড়ে সতেরো কোটি। নিয়ম ছিল, ২১ বছর বয়সি নারী বা পুরুষ হলেই ভোটদানের অধিকারী। গণতন্ত্রের পীঠস্থান ইংল্যান্ডে মেয়েদের ভোটাধিকার পাওয়ার আগে ৭০ বছর ধরে আন্দোলন করতে হয়েছে। পুলিশের গুলিতে আন্দোলনরতা ইংরেজ মহিলাদের মৃত্যুও হয়েছে। অথচ ভারতের সংবিধান প্রণেতা গণপরিষদ বা কন্সটিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি সব ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ সহ্য করে বয়সের ভিত্তিকেই ভোটের একমাত্র উপায় বলে স্থির করেছিল। তাঁর আগে ১৯৪৬ সালে এই গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল, শিক্ষা, সম্পত্তি ও আয়ের ভিত্তিতে। তখনকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ ভোটদানের অধিকারী ছিলেন।

নিরপেক্ষতা নিয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন ওঠেনি
বর্তমানে নির্বাচন  কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধীদের বারবার প্রশ্ন করতে দেখা যায়। কিন্তু আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে স্বাধীন ভারতে যেবার প্রথম ভোট নেওয়া হয়, তাতে ত্রুটি–‌বিচ্যুতির অভাব না থাকলেও, তদানীন্তন নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনের নিরপেক্ষতা ও সততা নিয়ে শাসক বা বিরোধী কোনও পক্ষই কোনও অভিযোগ তুলতে পারেনি। এমনকি ওই সময় যারা ব্যালটের মাধ্যমে ভোট করার কথা শুনে  ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছিলেন তারাও পরে স্বীকার করেছিলেন সেই সময় ভারতের গণতন্ত্রে সূচনাটা সফল ভাবেই হয়েছিল৷ যদিও দুটি সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করেই ইস্তফা দিয়েছিলেন সুকুমার সেন। পরে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া সুদানের প্রথম নির্বাচনও পরিচালনা করেছিলেন তিনি। পরবর্তী ক্ষেত্রে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতে ভোট ব্যবস্থার রূপকার সুকুমার সেনকে পদ্মভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে মাত্র ৬৫ বছর বয়সে প্রয়াত হন সুকুমার সেন। তাঁকে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান নেপথ্যের নায়ক বলে মন্তব্য করেছিলেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার হিসাবে অগ্নিপরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন দক্ষ বাঙালি আমলা সুকুমার সেন। এখন বাঙালি ব্যস্ত একুশের ভোটযুক্ত নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাড়ার চায়ের দোকান সবখানেই সরগরম আলোচনা 

Advertisement