scorecardresearch
 

'জঙ্গলমহলের মা' থেকে সম্পর্ক তলানিতে, ভারতী-মমতা ঘনিষ্ঠতা তাল কেটেছিল কিসে?

ভারতী ঘোষের উত্থান শুরু হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। তার আগে বাম জমানায় তিনি ছিলেন সিআইডির সন্ত্রাসদমন শাখার অফিসার। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের পর ভারতীকে ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার অতিরিক্ত সুপার (সদর) পদে নিয়ে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৩-র অগস্টে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এসপি হন ভারতী।

Advertisement
এমন কী হল যাতে সম্পর্কের সুর কেটে গেল ? এমন কী হল যাতে সম্পর্কের সুর কেটে গেল ?
হাইলাইটস
  • মুখ্যমন্ত্রীকে 'জঙ্গলমহলের মা' বলে সম্বোধন করেছিলেন ভারতী
  • পাল্টা প্রশংসা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও
  • তারপর এমন কী হল যাতে সম্পর্কের সুর কেটে গেল

প্রাক্তন আমলাদের অনেককেই রাজনীতির ময়দানে নামতে দেখা যায়। সেই দলে রয়েছেন ভারতী ঘোষ। প্রাক্তন এই আইপিএসকে এবার ডেবরা বিধানসভা আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার টিকিট দিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। তবে এই প্রথম নয়, এর আগে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রথমবার ভোটের ময়দানে দেখা গিয়েছিল ভারতীকে। সেবার ঘাটাল থেকে বিজেপির হয়ে ভোটে লড়েছিলেন তিনি। জীবনের প্রথম ভোটে ভাল ফাইট দিলেও শেষপর্যন্ত অবশ্য তৃণমূলের তারকা প্রার্থী দেবের কাছে হারতে হয় প্রাক্তন এই আইপিএস-কে। এবার ফের একবার ভোটের লড়াইতে নেমেছেন ভারতী। একুশের ভোটে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আবারা আরেক প্রাক্তন আইপিএস কর্তা হুমায়ুন কবীর। হুমায়ুন আবার ডেবরার ভূমিপুত্র। তাই নন্দীগ্রামের থেকে লড়াইয়ের রোমাঞ্চ কিছু কম হবে না ডেবরাতেও। রাজনীতিতে আসার আগে থেকেই সংবাদ মাধ্যমের কাছে পরিচিত নাম ভারতী ঘোষ। একসময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বহু চর্চিত হয়েছে। সেখান থেকে সম্পর্কে দূরত্ব। তবে সম্পর্কে দূরত্ব একসময় নিজের বিশ্বস্ত সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গেও হয়েছে মমতার। যার পরিণতি নন্দীগ্রামে একদা দুই সহযোদ্ধার সম্মুখ সমর। কিন্তু যে ভারতী মুখ্যমন্ত্রীকে 'জঙ্গলমহলের মা' বলে সম্বোধন করতেন তার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরত্ব বাড়ান কারণ কী ছিল?

বিজেপির হয়ে ময়দানে নেমেছেন ভারতী
বিজেপির হয়ে ময়দানে নেমেছেন ভারতী

১৯৬২ সালের ৯ এপ্রিল জন্ম ভারতী ঘোষের। ইকোনমিক্সে স্নাতক ভারতী পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডি বিভাগে কর্ম জীবন শুরু করেন।  ভারতী ঘোষের উত্থান শুরু হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। তার আগে বাম জমানায় তিনি ছিলেন সিআইডির সন্ত্রাসদমন শাখার অফিসার। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের পর ভারতীকে ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার অতিরিক্ত সুপার (সদর) পদে নিয়ে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১২ সালের এপ্রিলে ঝাড়গ্রামের এসপি হন তিনি। ২০১৩-র অগস্টে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এসপি হন ভারতী। সেইসঙ্গে ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার ভারপ্রাপ্ত এসপিরও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ২০১৩ থেকে ২০১৭— পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন ভারতী ঘোষ। তার আগে সামলে এসেছেন  ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপারের দায়িত্বও। গোটা পর্বেই জঙ্গলমহলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন তিনি। শাসক দল তৃণমূলের ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, বলা ভাল ‘নেত্রী’ স্থানীয়। তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা, বিশেষ করে জঙ্গলমহলের খুঁটিনাটি বিষয়ে ভারতীর উপর মমতার আস্থা সেই সময়ে  বারবার প্রকাশ্যে এসেছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মেদিনীপুরে জঙ্গলমহল কাপের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানেই প্রথম মুখ্যমন্ত্রীকে 'জঙ্গলমহলের মা' বলে সম্বোধন করেছিলেন ভারতী। ভারতীর মুখে কখনও শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী, ‘বাংলার নবরূপকার’, কখনও বলেছেন, ‘আমাদের পরমপ্রিয়’।  পাল্টা প্রশংসা ফিরিয়ে দিতেন মমতাও। সেই কালপর্বে একবার মজা করে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘ভারতী অ্যাঙ্কর হিসেবেও ভাল কাজ করেছে। পুলিশে কাজ করলেও অ্যাঙ্কর হওয়া যায়। সব কাজ সবাই করতে পারে। যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।’

Advertisement

যোগীর কটাক্ষ! 'পরিবর্তনের ঝড়, মমতাও যাচ্ছেন মন্দিরে'

ভারতীর আধিপত্য বরাবরই প্রশাসনিক কাজের সীমারেখা ছাপিয়ে শাসক বৃত্তে ঢুকেছে। তা নিয়ে বিতর্কও বেধেছে বারবার। কখনও আদালতে তিনি ভর্ৎসিত হয়েছেন, কখনও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সবংয়ে ছাত্র পরিষদ কর্মী খুনে অভিযুক্ত টিএমসিপি কর্মীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। মানুস ভুঁইয়া কংগ্রেসের বিধায়ক থাকাকালীন  ভারতী তাকে হুমকি দিয়েছিলেন বলে  অভিযোগও উঠেছিল। সেই সময় পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছিলেন মানসবাবু। তারপরেও স্বমহিমায় সরকারি মঞ্চে একাধিকবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে  ‘জঙ্গলমহলের মা’ বলে সম্বোধন করার রীতি বজায় রেখেছিলেন ভারতী। ২০১৪-র লোকসভা এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের সময় নির্বাচন কমিশন তাঁকে পুলিশ সুপারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।  পঞ্চায়েত হোক বা পুরসভার ভোট, ভারতী তৃণমূলের হয়ে কাজ করছেন বলে বারবার সরব হয়েছে বিরোধীরা। সেই ভারতীই লোকসভা ভোটের আগে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লি গিয়ে যোগ দেন বিজেপিতে। তবে গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানোর আগে দীর্ঘদিন ধরেই তার বিজেপিতে যোগদান নিয়ে জল্পনা চলেছিল। 

দিল্লিতে গিয়ে মুকুল রায়ের উপস্থিতিতে ভারতী বিজেপিতে যোগ দেন
দিল্লিতে গিয়ে মুকুল রায়ের উপস্থিতিতে ভারতী বিজেপিতে যোগ দেন

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ভারতী ঘোষকে। ভারতীর জায়গায় পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার হন অলোক রাজোরিয়া।  ভারতী ঘোষকে পাঠানো হয় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে। ব্যারাকপুরে রাজ্য পুলিশের তৃতীয় ব্যাটালিয়নের কমান্ড্যান্ট পদে বদলি করা হয়েছিল ভারতীকে। রাজ্য পুলিশের তরফে রুটিন বদলি বলে উল্লেখ করা হলেও রাজনৈতিক মহলের পাশাপাশি পুলিশেরই একাংশ তা মানতে নারাজ ছিল। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা ছিল, সবংয়ের উপনির্বাচনের ফলের শাস্তি পেতে হয়েছিল ভারতী ঘোষকে৷ কারণ, সেখানে তৃণমূলের প্রার্থী গীতারানি ভুঁইয়া জিতলেও বামেরা দ্বিতীয় হয়৷ ভোট বাড়ে বিজেপিরও৷ ২০১৬ সালে বিজেপির ভোট ছিল ৫ হাজারের মতো, সেখানে ২০১৭ সালের উপনির্বাচনে তাদের ঝুলিতে আসে  প্রায় ৩৭ হাজার ভোট৷ এক বছরের মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ ভোট বাড়ে বিজেপির৷ যা নিঃসন্দেহে শাসকদলের মাথাব্যথার কারণ ছিল। জানা যায়, বিজেপির ভোট কী করে এতটা বাড়ল, তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ভারতী ঘোষ। সম্ভবত সে কারণেই কম গুরুত্বপূর্ণ পদে সরিয়ে একরকম শাস্তিই দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।

'চাচা' নেই, কংগ্রেসও নেই! খড়গপুরে বিজেপি বনাম তৃণমূলই

  বিভিন্ন ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছিল ভারতী ঘোষের। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদ হওয়ায় সেই সময় চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নেওয়ায় ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ ভারতী। তৎকালীন রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিত্‍‌ করপুরকায়স্থের কাছে নিজের ইস্তফাপত্রও পাঠিয়েছিলেন। এদিকে মেদিনীপুরে থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছিল তোলাবাজির অভিযোগ।  সোনা-প্রতারণাতেও নাম জড়ায় ভারতী ঘোষের। গ্রেফতার করা হয় তাঁর স্বামীকে। ভারতীকে গ্রেফতারের জন্যও ‘লুক আউট’ নোটিস জারি করতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানিয়েছিল সিআইডি। সেই সময় গা ঢাকা দিয়েছিলেন ভারতী ঘোষ। সেখান থেকেই  বারবার অডিয়ো বার্তায় বিস্ফোরক সব অভিযোগ করতেন, তুলোধনা করতেন সিআইডি-কেও। তখন থেকেই জোর জল্পনা শুরু হয় তিনি  শিবির বদল করবেন। মুকুল-ভারতীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তা আরও উস্কে দিয়েছিল। কারণ ততদিনে গেরুয়া শিবিরে চলে গিয়েছিলেন মুকুল রায়। আর ঠিক লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে প্রাক্তন আইপিএস অফিসার ভারতী ঘোষ যোগ দেন বিজেপিতে। দিল্লিতে ভারতীর গেরুয়া শিবিরে যোগদানের সময় পাশে ছিলেন সেই মুকুল রায়।

Advertisement


 

Advertisement