আগেও বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে এরাজ্যে। ২০১১ সালে তৃণমূলনেত্রী নিজেই ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন। দেখতে দেখতে মমতা জমানারও ১০ বছর হয়ে গেল। আগামী পাঁচ বছরের জন্য তিনি নবান্নে ফিরবেন কিনা তা জানতে আরও মাস খানেক অপেক্ষা করতে হবে। তবে এবারের বিধানসভা নির্বাচন তৃণমূলনেত্রীর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তা মানতেই হবে। ২০১১ সালে যখন বাংলা ক্ষমতার হাতবদল দেখেছিল তখন তিনি ছিলেন বিরোধী আসনে, পাল্টেছিলেন ইতিহাস। ২০১৬ সালে বাম-কংগ্রেস জোট গড়লেও সেভাবে বিরোধী শক্তি হাজির ছিল না বাংলায়। তবে চিত্রটা বদলেছে ২০২১। প্রধান বিরোধী দলের আসনে এখন বিজেপি। তৃণমূলকে সমানে সমানে টক্কর দিতে ময়দানে নেমে পড়েছে গেরুয়া শিবির। শাসকের আসনে থেকে ক্ষমতা ধরে রাখা এবার মমতার কাছে অন্যরকম চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আদিবাসী ভোট ব্যাঙ্ককেই টার্গেট করতে চাইছেন তৃণমূলনেত্রী। কিন্তু সেই ভোট ব্যাঙ্ককে টার্গেট করে বসে আছে বিজেপিও। তাই ভোটঅঙ্কে একে অপরকে কীভাবে টেক্কা দেওয়া যায়, সেই গুটি সাজাতে শুরু করে দিয়েছেন একদিকে অমিত শাহ অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিজেপি আদিবাসী ভোট টানতে ইতিমধ্যে ময়দানে
গত লোকসভা ভোটে আদিবাসী ভোটের একটা বড় অংশ গিয়েছিল গেরুয়া শিবিরের ঘরে। উত্তরবঙ্গ থেকে জঙ্গলমহল যার সুফল তুলেছিল বিজেপি। রাজ্যে মোট আদিবাসী আসন রয়েছে ৮৪টি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন তফশিলী জাতি,উপজাতির মানুষের ভোট চলতি বছরে হতে চলেছে সরকার গঠনের নির্ণায়ক। এমনটা মনে করছে বিজেপিও। তাই আদিবাসী এলাকাগুলি প্রচারে বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সফরে। নভেম্বরে বঙ্গ সফরে এসে বাঁকুড়ায় গিয়েছিলেন অমিত শাহ। জানুয়ারিতে উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে রথযাত্রার উদ্বোধন করবেন তিনি। সঙ্গে যাবেন মতুয়া অধ্যুষিত ঠাকুরনগরেও। আদাবিসী ভোট যে তাঁর নবান্ন দখলের স্বপ্ন বায়স্তবায়িত করতে পারে তা ভালই জানেন বিজেপির চাণক্য। সেই কারণে প্রতি বঙ্গ সফরে এসে নাড্ডা থেকে শাহ সবাই পাত পেড়ে খাচ্ছেন আদিবাসী বাড়িতে। এরাজ্যে আদিবাসীদের প্রতি বঞ্চনা নিয়ে সরব হচ্ছে গোবলয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দল হিসাবে পরিচিত বিজেপি। বাংলা দখলে নিজেদের রণকৌশল পাল্টেছেন শাহ-নাড্ডারা। তাই উত্তরবঙ্গ থেকে জঙ্গলমহল সবখানেই পদ্ম শিবিরের নজরে এখন সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ভোটব্যাঙ্ক।
ময়দানে নেমে পড়েছেন তৃণমূলনেত্রী
গত লোকসভা ভোটে বিজেপি রাজ্য থেকে ১৮টি আসন পেয়েছে। যার সিংহভাগ এসেছে উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহলের তিন জেলা থেকে। ভোটের সমীকরণটা ভালই বুঝতে পেরেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একসময় তার দখলে থাকা আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ক যে বেহাত হয়ে গিয়েছে সেটা গত লোকসভা ভোটের পরেই স্পষ্ট। সেই ভোটব্যাঙ্ক ফেরাতে এবার মরিয়া তৃণমূলনেত্রী। তাই নিজের ভোটপ্রচার এবার জঙ্গলমহলের বাঁকুড়া থেকেই শুরু করেছেন মমতা। জঙ্গলমহলে প্রচার চালিয়ে উত্তরবঙ্গে ছুটেছেন তৃণমূলনেত্রী। সমীকরণ সেই চলে যাওয়া আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ককে ফিরিয়ে আনা। উত্তরের আদিবাসী ভোট ব্যাঙ্ক অটুট রাখতে গত তিনদিন ডুয়ার্সে সফর করেছেন তিনি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার জেলায় আদিবাসী মানুষের আস্থা অর্জনই রয়েছে এর পেছনে। এমনকি ফালাকাটায় রাজ্য সরকার আয়োজিত গণ বিবাহের অনুষ্ঠানেও দেখা গেছে মমতাকে। গত লোকসভা ভোটে উত্তরে একটি আসনও পায়নি মমতার দল, সেই মেরামতি আদিবাসী ভোটকেই ঘরে ফিরিয়ে করতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাই বৃহস্পতিবার বিকেলেই উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে কলকাতায় তৃণমূলের তফশিলি জাতি, উপজাতি সম্মেলনে হাজির থাকবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কঠিন ভোটঅঙ্ক
এরাজ্যে লোকসভা ভোটের নিরিখে বর্তমানে যা পরিস্থিতি তাতে ৮৪টি আসনের মধ্যে ৪৭টি আসন বিজেপির দখলে। তৃণমূলের দখলে ৩৭টি আসন। ভোট শতাংশের হিসাবে বিজেপির দখলে ৪৮.৪৩ শতাংশ ভোট। তৃণমূলের দখলে ৩৮.২৪ শতাংশ ভোট। তফসিলি উপজাতি আসনের ক্ষেত্রে গত লোকসভায় ১৩টি ছিল গেরুয়া শিবিরের দখলে। মাত্র ৩টি আসন পেয়েছে তৃণমূল। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক এখনও এরাজ্যে তৃণমূলের দিকেই রয়েছে। তবে ২০১৯-এর লোকসভায় দেখা গিয়েছে মতুয়া ও আদিবাসীদের একাংশ সরে গিয়েছে তৃণমূলের দিক থেকে। এবার সেই আদিবাসী মন পেতে মরিয়া তৃণমূল। সম্প্রতি শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে সাংসদ সুনীল মণ্ডল, প্রাক্তন সাংসদ দশরথ তিরকের মতো নেতারা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। এই অবস্থায় তৃণমূল কমিটি গড়ে জঙ্গলমহলের বাঁকুড়া-পুরুলিয়াসহ প্রান্তিক এলাকাগুলিকে টার্গেট করেছে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসী ভোট ফেরাতেও তারা বিশেষ নজর দিয়েছে। টিএমসির নয়া কমিটির সভাপতি করা হয়েছে দেবু টুডুকে। কমিটিতে রয়েছেন ৬ জন সহ সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক ৯ জন। সদস্য কথা হয়েছে ৮ জনকে। এই কমিটিতে উল্লেখযোগ্য নাম জেমস কুজুর, বুলুচিক বারিক, জ্যোৎস্না মান্ডি, পাসাং লামা, রাজেশ লাকড়ার মতো আদিবাসী নেতারা ।
বাংলায় সাতটি জেলায় আদিবাসীরা ফ্যাক্টর। কুর্মি-সহ একাধিক আদিবাসী জনজাতিকে তাই তৃণমূল-মুখো করার প্রয়াস নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। তৃণমূল সতর্ক হয়েই নেমেছে আদিবাসী ভোটকে ফেরাতে। শুভেন্দুর দখল রয়েছে দক্ষিণবঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়। আবার তাঁর হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন উত্তরবঙ্গের আদিবাসী নেতারাও। এই আবহে আদিবাসী ভোটে যাতে ফাটল না ধরে, যাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তাঁদের যাতে ফেরানো যায়, সেই চেষ্টাই এখন লক্ষ্য তৃণমূলনেত্রীর।