একুশের ভোটে সবার নজর নন্দীগ্রাম কেন্দ্রের দিকে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এর পাশাপাশি আরও একাধিক বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে যেখানে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হতে চলেছে। যার মধ্যে অন্যতম বিধাননগর বিধানসভা কেন্দ্র। যেখানে প্রার্থী স্বয়ং রাজ্যের দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু। একদা বাম নেতা সুভাষ চক্রবর্তী ঘনিষ্ঠ এই নেতা বর্তমানে তৃণমূলনেত্রীর আস্থাভাজন। দমকলমন্ত্রী হিসাবে কাজে সুনামও রয়েছে। তারপরও অবশ্য 'কিন্তু' থেকে যাচ্ছে। বিধাননগর কেন্দ্র থেকে জিতে তিনি হ্যাটট্রিক করতে পারবেন কিনা? কারণ, এবার সুজিতকে লড়তে হচ্ছে একদা তাঁর সহকর্মী বর্তামানে বিজেপি নেতা সব্যসাচী দত্তের বিরুদ্ধে। যিনি আবার বিধাননগরের ঘরের ছেলে। আর লোকসভা ভোটের হিসেবে বিধাননগর কেন্দ্র থেকে প্রায় কুড়ি হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। তাই এবার ঘাসফুল শিবিরের অন্যতম এই নেতার কাছে অগ্নিপরীক্ষা নিজের আসন ধরে রাখা। চলুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক সুজিত বসুর রাজনৈতিক যাত্রাপথ।
সুভাষ চক্রবর্তী আদর্শ ছিলেন সুজিতের
সুভাষ চক্রবর্তী ছিলেন বরাবরই বিতর্কিত কমিউনিস্ট নেতা। বাংলায় ভোটের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন বরাবরই একটা ফ্যাক্টর। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে, সে বার বেলগাছিয়া (পূর্ব) বিধানসভা থেকে জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন সুভাষ। ১৯৮২ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে বাম সরকারের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান সুভাষ চক্রবর্তী। সঙ্গে ছিল যুবকল্যাণ দফতরও। এরপর ১৯৯৬-সালে জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায় পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। ক্রীড়া দফতরের সঙ্গেই তাঁকে দেওয়া হয় পরিবহণ দফতরের দায়িত্বও। ২০০৯ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই মন্ত্রকগুলোর দায়িত্ব বহন করেছেন। এহেন সিপিএমের ডাকসাইটে নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর ডানহাত ছিলেন সুজিত বসু। তবে নব্বইয়ের দশকে বেআইনি নির্মাণে প্রোমোটারদের মদত দেওয়ার অভিযোগে সুভাষ-শিষ্য সেই সুজিত বসুকে বহিষ্কার করেছিল সিপিএম। পরে ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ দমদম পুরসভার নির্বাচনে জোড়া পাতা (নির্দল) প্রতীকে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন সুজিত। তার পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে তৃণমূলে নাম লেখানো।
সুভাষের কেন্দ্র থেকেই প্রথমবার বিধায়ক
সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিশনের নির্দেশ অনুসারে, বেলগাছিয়া পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রটি ২০১১ সালে অবলুপ্ত হয়। এই বিধানসভা কেন্দ্রটি ছিল দমদম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। ১৯৭৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সাত বার এই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সুভাষ চক্রবর্তী। ২০০৯ সালে বেলগাছিয়া কেন্দ্রের বিধায়ক সুভাষ চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর সেখানে উপনির্বাচনে রমলা চক্রবর্তীকে পরাজিত করে প্রথমবার তৃণমূলের বিধায়ক হয়েছিলেন সুজিত বসু। এরপর ২০১১ ও ১৬- নির্বাচনে বিধাননগর কেন্দ্র থেকে জয়ী হন সুজিত। গতবার এই কেন্দ্র থেকে ৪৩.৮৫ শতাংশ ভোট গিয়েছিল সুজিতের দখলে। সেবার কংগ্রেসের ডাকসাইটে নেতা অরুণাভ ঘোষকে ৬,৯৮৮ ভোটে পরাজিত করেছিলেন সুজিত বসু। তার আগের বার এই কেন্দ্র থেকে সুজিত পেয়েছিলেন ৫৯.৫৩ শতাংশ ভোট। সেবার সিপিএম প্রার্থী পলাশ দাসকে ৩৫,৯২৫ ভোটে পরাজিত করেছিলেন তিনি। এবারও বিধাননগর জয়ে সুজিতের ওপরেই ভরসা রেখেছেন তৃণমূলনেত্রী।
দলনেত্রীর আস্থাভাজনের পুরস্কার
শুরু থেকেই তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'গুডবুকে' থেকেছেন সুজিত বসু। বিধায়কের পাশাপাশি ২০১০ সাল থেকে দক্ষিণ দমদমের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বও সামলে আসছেন তিনি। শোভন চট্টোপাধ্যায় দমকল দফতর থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর তাই একদা সুভাষ ঘনিষ্ঠ সুজিতকেই তাঁর আনুগত্যের পুরস্কার দেন মমতা। দমকলমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সাফল্যের সঙ্গেই কাজ করেছেন সুজিত। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে রাত-বিরেতে পৌঁছেছেন ঘটনাস্থলে। পাশে দাঁড়িয়েছেন মানুষের।
পুরভোটে তাঁর ভূমিকা নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন
বিধায়ক হিসাবে সুজিত বসু কাজ করেছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নিয়মিত এলাকার মানুষের সঙ্গে জনসংযোগেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। গত কয়েক বছরে সুজিতের হাত ধরেই আমূল বদলে গিয়েছে ভিআইপি রোড সংলগ্ন লেক টাউন, শ্রীভূমি এলাকা। তার পরেও অবশ্য তৃণমূলনেত্রী একবার 'ক্ষুন্ন' হয়েছিলেন সুজিতের ওপর। ২০১৫ সালে বিধাননগর পুর নিগমের নির্বাচনে বহিরাগত ঢোকানো, গোলমাল, সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত হওয়ার জন্য সুজিতের দিকে উঠেছিল অভিযোগের আঙ্গুল। অনেকেই মনে করেন সেই কারণেই গত বিধানসভা নির্বাচনে বিধাননগরে ভোট কমেছিল তৃণমূলের। অন্যদিকে বিধাননগর পুরনিগমের মেয়র পদের দিকে নাকি নজর ছিল সুজিত বসুরও। তবে সেবার শেষপর্যন্ত শিকে ছিড়েছিল সব্যসাচী দত্তের। তাই থেকেই দুই নেতার মধ্যে চলতে থাকে চাপা দ্বন্দ্ব। ২০১৯ সালে তৃণমূল ছাড়েন সব্যসাচী। এবার রাজারহাট-নিউটাউনের বিদায়ী বিধায়ক গেরুয়া শিবিরের হয়ে লড়ছেন সুজিতের বিরুদ্ধে। তবে বিতর্ক পেছনে ফেলে বর্তমানে দলের সুনজরে রয়েছেন সুজিত।
লোকসভা ভোটের ফল বিপক্ষে যাচ্ছে
বিধাননগর বিধানসভা কেন্দ্র বারাসত লোকসভা আসনের অন্তর্গত। বারাসত থেকে ২০১৯ সালে তৃণমূলের কাকলি ঘোষ দস্তিদার জিতলেও সল্টলেকে কিন্তু বিপুল ভোটে এগিয়ে ছিল গেরুয়া শিবির। পরিসংখ্যান বলছে বিধাননগর বিধানসভা এলাকায় বিজেপির মৃণালকান্তি দেবনাথ পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮৭২টি ভোট। অন্যদিকে কাকলির ঝুলিতে গিয়েছিল ৫৮ হাজার ৯৫৬টি ভোট। অর্থাৎ প্রায় বিশ হাজার ভোটে লিড পেয়েছিল বিজেপি। ফলে এই ভোট মেকআপ দেওয়া কিন্তু সুজিতের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
জনসংযোগ অন্যতম হাতিয়ার সুজিতের
ছোটবেলা থেকে বামপন্থী হলেও পুজোর সঙ্গে বারবর যুক্ত থেকেছেন সুজিত বসু। তার জন্য কম ঝড় পোয়াতে হয়নি তাঁকে। একসময় তাঁর পুজোর সভাপতি ছিলেন স্বয়ং সুভাষ চক্রবর্তী। তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। তাঁর ক্লাব শ্রীভূমি স্পোর্টিং-এর পুজো না দেখলে নাকি দর্শকদের পুজো দেখা সম্পূর্ণ হয় না। ইতিমধ্যে শ্রীভূমির মণ্ডপ দশর্ক টানায় ওয়ার্ল্ড গিনেস বুক অব রেকর্ডসেও নাম তুলেছে। বারবারই দুর্গাপুজোয় চমক দিয়ে থাকেন তিনি। তবে কেবল দুর্গা নয় বিধাননগর এলাকায় কালী, জগদ্ধাত্রী-সহ একাধিক পুজোয় রয়েছে সুজিত বসুর পৃষ্ঠপোষকতা। স্থানীয়দের সঙ্গে জনসংযোগ বাড়াতে নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে থাকেন তিনি। মানুষের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারও সুমিষ্ট। শোনা যায় মমতার সঙ্গে মিঠুনের ঘনিষ্ঠতা বারানোর পেছনেও নাকি আসল কারিগর ছিলেন সুজিত বসু। একসময়ে সুভাষ চক্রবর্তীর একান্ত অনুগামী সুজিত তাঁর হয়ে মিঠুনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সেই যোগাযোগকে কাজে লাগিয়েই তৃণমূল সুপ্রিমোর সঙ্গে তিনি মিলিয়ে দিয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তীকে। আগামী ১৭ এপ্রিল রাজ্যে পঞ্চম দফার ভোট। যাতে উত্তর চব্বিশ পরগনার ১৬টি কেন্দ্র রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম বিধাননগর। ভোট ঘোষণার পর থেকেই দলীয় কর্মীদের সঙ্গে ময়দানে নেমেছেন সুজিত। রোড শো থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার, কোনও কিছুই বাদ দিচ্ছেন না দমকলমন্ত্রী। একদা বামপন্থী সুজিত মমতার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়ে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করেছেন। এবার কি তিনি পারবেন বিধাননগরে পদ্মঝড় আটকাতে? পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে দমকলমন্ত্রীর লড়াইটা বেশ কঠিন।