সালটা ২০০২। রাজ্যে তখন বাম শাসন। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলাকে ভেঙে দুটি ভাগ করা হয়। তমলুক, কাঁথি, হলদিয়া ও এগরা মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব মেদিনীপুর। সেই সময় জেলা সদর কাঁথি না তমলুক হবে তা নিয়ে শুরু হয় লড়াই। কাঁথিকে নয়া জেলা সদর হিসেবে ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনও হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত কাঁথির বদলে সদর হয় তমলুক। শোনা যায় শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বেই কাঁথির মানুষ তা মেনে নিয়েছিল। তখন শুভেন্দু জেলায় নিজের ভিত শক্ত করার চেষ্টায় থাকলেও রাজ্য রাজনীতিতে তেমন পরিচিত নাম ছিলেন না। তারমধ্যে ২০০১ সালে তৃণমূলের টিকিটে মুগবেড়িয়া বিধানসভা কেন্দ্রে তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দের কাছে হারতে হয়েছিল শুভেন্দুকে। ২০০৪ সালে তমলুক কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী হয়ে লক্ষ্মণ শেঠের কাছে হারতে হয়েছিল শুভেন্দুকে। তবে ২০০৯ সালে সেই তমলুক লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতেই জীবনে প্রথমবার সাংসদ হন শুভেন্দু। ২০১৪ সালেও ম্যাজিক বজায় ছিল। ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে দাঁড়ানোর আগে পর্যন্ত তমলুকের সাংসদ ছিলেন শুভেন্দু। এখন সেই দায়িত্বে রয়েছেন তাঁর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী। ফলে বোঝাই যাচ্ছে গোটা তমলুক লোকসভা জুড়ে ভালরকম রয়েছে অধিকারী পরিবারের দাপট। তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে তমলুক, পাঁশকুড়া পূর্ব, ময়না, নন্দকুমার, মহিষাদল, হলদিয়া আর নন্দীগ্রাম বিধনাসভা কেন্দ্র। এই সাত বিধানসভা কেন্দ্রের সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে অধিকারী পরিবারের দাপট। যদিও হলদিয়া বিধানসভায় ২০১৬-তে উড়েছিল লাল পতাকা। তুমুল তৃণমূল ঝড়ের মধ্যে এই আসনটি ছিনিয়ে নিয়েছিল বামেরা। তবে গত লোকসভায় এই বিধানসভা থেকেই এক লক্ষের বেশি ভোট পেয়েছেন শুভেন্দুর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী। তৃণমূলের হয়ে ভোটে লড়েছিলেন দিব্যেন্দু। ইতিহাসের শহর তাম্রলিপ্তের এবার ভোট অঙ্ক কিন্তু বেশ জটিল।
তমলুকের ইতিহাস
তমলুক বহু প্রাচীন শহর। এর অলিতে গলিতে রয়েছে ইতিহাস। পাঠান শাসনকালে বঙ্গ দেশে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য ছিল-তাদের মধ্যে তাম্রলিপ্ত ছিল স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। বৌদ্ধ সম্রাটগণের শাসনকালেও বঙ্গ দেশের পাঁচটি প্ৰধান হিন্দুরাজ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল তাম্রলিপ্ত। তমলুকের ইতিহাস তাই বাঙলার অন্যতম সম্পদ। স্বাধীনতার যুদ্ধেও নাম জড়িয়েছিল তমলুকের। প্রাচীন বন্দর শহর হিসাবে পরিচিত তমলুকের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে রুপনারায়ণ নদী এবং পশ্চিমে সুবর্ণরেখা। রূপনারায়ণ হোল দ্বারকেশ্বর এবং শিলাই নদীর যৌথ প্রবাহ। বঙ্গোপসাগর এবং এখানকার অসংখ্য নদী-উপনদী বন্দর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাম্রলিপ্তকে। বাণিজ্য, সংস্কৃতির পাশাপাশি বাইরের মানুষের সাথে যোগাযোগের নতুন সোপান তৈরি হয়েছিল। একই সাথে, নদীগুলি এই অঞ্চলে কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নে সহায়তা করেছিল। মহাভারত খ্যাত ‘তাম্রলিপ্ত’, রাজনীতির মহাভারতেও বরাবরই সংগ্রামী থেকেছে। প্রবল ইংরেজ রাজত্বে ব্রিটিশ শক্তিকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে সগৌরবে তাম্রলিপ্তের জাতীয় সরকারের ঘোষণা হয়েছিল এখানেই। তাম্রলিপ্তের ভোটযুদ্ধেও এবার যেন তাই প্রতিবাদের ঝড়।
২০১৬ সালে বামেরা দখল করে তমলুক
বাম আমলে মুকুটহীন সম্রাট লক্ষ্মণ শেঠের খাসতালুক ছিল তমলুক। ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে সেই লক্ষ্মণ শেঠের কাছেই হেরে গিয়েছিলেন শুভেন্দু। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে থাকা সাতটি বিধানসভার মধ্যে বামেরা হলদিয়া, কোলাঘাট ও তমলুক কেন্দ্রে জয়লাভ করে। প্রথমে কংগ্রেসের দখলে থাকলেও পরে লক্ষ্মণ শেঠের জমানায় লাল পতাকাই উড়েছে তমলুকে। এর মাঝেই ২০০১ সালে প্রথমবার এই আসনে জয়লাভ করে তৃণমূল। ২০১১ সালে ফের তৃণমূলের টিকিটে জেতেন সৌমেন মহাপাত্র। একুশের ভোটে সেই সোমেনকেই ফের একবার প্রার্থী করেছে ঘাসফুল। তবে ২০১৬ সালে সারা রাজ্যে ২১১ টা আসন জিতলেও তমলুক হাতছাড়া হয়েছিল তৃণমূলের। সেবার জিতেছিলেন বামপ্রার্থী অশোককুমার দিন্দা। হারতে হয়েছিল তৃণমূলের নির্বেদ রায়কে। বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়েছিলেন বিশ্বনাথ দাস। তবে বামপ্রার্থী অশোককুমার দিন্দার জয়ের মার্জিন ছিল মাত্র ৫২০ ভোট।
এবার ময়দানে মূলত বড় ফুল ও ছোট ফুল
শুভেন্দু পরবর্তী সময়ে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রের ওপর তমলুক পুনরুদ্বারের দায়িত্ব দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। ১৯৯৮ সালে তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই দলে রয়েছেন পেশায় অধ্যাপক সৌমেনবাবু। তিনি ছিলেন তৃণমূলের অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সভাপতি। ২০০১ সালে প্রথমবার বিধায়ক হন। ২০১১ সালে পরিবর্তনের সময় সৌমেনবাবু তমলুক বিধানসভা থেকেই জয়ী হয়েছিলেন। তারপর ২০১৬ সালে ‘অধিকারী গড়’ পূর্ব মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে পাশের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরের নিয়ে গিয়েছিল দল তাঁকে। পিংলা বিধানসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন সৌমেন মহাপাত্র। ১০ বছর পর এবার ফের একবার সৌমেন মহাপাত্র তমলুক বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী। বিধানসভা ভোটের আগে দল তাঁকে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সভাপতিও করেছে। এদিকে তমলুক বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করা হয়েছে দলের জেলা সহ সভাপতি হরেকৃষ্ণ বেরাকে। পেশায় চিকিৎসক হরেকৃষ্ণ বেরার এলাকায় যথেষ্ট স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে। ফলে লড়াই এবার হাড্ডাহাড্ডি এই কেন্দ্রে। যদিও এই আসনে গেরুয়া শিবিরের অনেকেই টিকিট প্রত্যাশী ছিলেন বলে খবর। সেইসঙ্গে আদি ও নব্য দ্বন্দ্বও যথেষ্ট ভাবাচ্ছে পদ্ম শিবিরকে।
সম্মানের লড়াই মমতা-শুভেন্দুরও
গত বিধানসভায় ১৬ আসনের পূর্ব মেদিনীপুরে ১৩টি আসন পেয়েছিল তৃণমূল। এবার অধিকারী পরিবার শিবির বদল করায় সেই আসন ধরে রাখা তৃণমূলনেত্রীর কাছে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। পূর্ব মেদিনীপুরকে যে মমতা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন তা তার জেলা সফর দেখেই বোঝা যাচ্ছে। প্রথম দফার ভোটের পর দিন থেকেই নন্দীগ্রামের রণাঙ্গণে হাজির হতে চলেছেন তৃণমূলনেত্রী। তার আগেই খেজুরি, পটাশপুর, এগরা, হলদিয়া, নন্দকুমার, তমলুক, পাঁশকুড়ায় জনসভা করে ফেলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামে প্রার্থী হলেও মমতার নজরে রয়েছে কাঁথি ও তমলুকও। কয়েক দশক ধরে এই এলাকা অধিকারী পরিবারের হাতে নিয়ন্ত্রিত। তাই এখানে তৃণমূলের শক্তিকে তুলে ধরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। একই ভাবে চ্যালেঞ্জ গেরুয়া শিবিরে যাওয়া শুভেন্দুরও। পরপর দু'বার তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ ছিলেন শুভেন্দু। কাঁথির মত তমলুকও তাঁর গড় হিসাবেই পরিচিত। ভোটের দিন ঘোষণার আগে থেকেই তিনি চ্যালেঞ্জ করে রেখেছেন একুশের ভোটে দুই মেদিনীপুরের সব আসনে পদ্ম ফোঁটাবেন। এর সঙ্গে নাম করতে হয় আরেক জনেরও। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের সময় বিধানসভা ভোটে তমলুক কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে জিতেই বিধায়ক হয়েছিলেন সৌমেন মহাপাত্র। কিন্তু ২১০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কয়েকমাস আগে তৃণমূলের একাংশের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। একটা সময়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় শাসকদলের রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে গিয়েছিলেন সৌমেন। রাজনৈতিক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়েছিল সৌমেনের। তাই এবার শুভেন্দু পরবর্তী সময় তমলুক পুনরুদ্ধার করা সৌমেনের কাছেও বড় চ্যালেঞ্জ। তবে পাঁশকুড়ার বাসিন্দা সৌমেন তমলুক বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়ানোয় গেরুয়া শিবির বহিরাগত ইস্যু করছে। আর ঘাসফুল ও পদ্মফুলের লড়াইয়ে গতবারের বিজয়ী বামমশিবির কিন্তু এবার অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। তমলুকের কাছেই রয়েছে নন্দীগ্রাম। এবারের ভোটে সবচেয়ে হাইপ্রফাইল কেন্দ্র। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ভূমিপুত্রের লড়াই। তবে জেলা শহর তমলুকের লড়াইও কিন্তু একুশের ভোটে কম রোমাঞ্চকর হতে যাচ্ছে না।