২০১১ সালে পরিবর্তন দেখেছিল বাংলার মানুষ। সেই পরিবর্তনে নদিয়া জেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ২০১১ সালের মত ২০১৬ সালেও এই জেলায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। জেলার ১৭টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৩টি গেছিল ঘাসফুলের দখলে। কংগ্রেস জিতেছিল ৩টি আসন, বামেরা পেয়েছিল ১টি। যদিও কংগ্রেসের ৩ বিধায়ক পরে যোগ দেন তৃণমূলে। তাই গত বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে নদিয়া জেলাকে তৃণমূলের সেফ প্লেস বলা যায়। তবে গত ৫ বছরে জল অনেকখানি গড়িয়েছে। নানা রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে রাজ্যে। উনিশের লোকসভা ভোটে সবাইকে চমকে দিয়ে রাজ্যে বেড়েছে পদ্মের প্রভাব। এই আবহে শ্রচৈতন্য মহাপ্রভুর ভূমিতে এবার পদ্মফুল ফোটাতে মরিয়া গেরুয়া শিবির।
ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম ভূমি নদিয়া
ভারতে একসময় ইসলাম ধর্ম প্রসারের ফলে হিন্দু ধর্ম ও সমাজে অস্থিরতা দেখা দেয় । হিন্দুরা অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সেই সময় হিন্দুধর্মের কিছু কুপ্রথা ও রীতিনীতি তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল । ফলে হিন্দুদের মধ্যে এক উদারনৈতিক ধর্ম আন্দোলনের সূত্রপাত হয় । বিভিন্ন ধর্ম প্রচারক জনগণের মধ্যে প্রেম, মৈত্রী, ভালোবাসা ও ভক্তির বাণী প্রচার করতে থাকেন । এই ধর্ম আন্দোলনই ভক্তিবাদ নামে পরিচিত । আর ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে নদিয়া জেলাটির সম্পর্ক ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। এখানকার কৃষ্ণনগরেই জন্মেছিলেন কালীসাধক এবং কালীমূর্তি তৈরি করে পুজোর প্রচলন করা মাতৃসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। নদিয়া জেলায় শাক্ত ও বৈষ্ণব, দুটি ধারা প্রবাহিত হয়েছে একসঙ্গে। হরিনাম সংকীর্তনের মধ্য দিয়ে যেমন সারা বিশ্বের কাছে নদিয়া সুপরিচিত তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, তেমনই এই জেলাতে রয়েছে ইস্কন। তাই মেরুকরণের রাজনীতিতে বিশ্বাসী এই জেলা জয় করতে একুশের ভোটে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েছে গেরুয়া শিবির।
১৯৯৯-সালেই ফুটেছিল পদ্ম
১৯৯৯ সালে লোকসভা ভোটে নদিয়ার কৃষ্ণনগর আসনে বাম প্রার্থী কে হারিয়ে জয় ছিনিয়েছিলেন বিজেপি-তৃণমূলের জোটপ্রার্থী সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় ওরফে জুলুবাবু। সেবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রিসভাতেও জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি রাজ্য বিজেপির সভাপতিও ছিলেন সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়। এই জেলার উনিশের ভোটে দুই লোকসভা আসনের মধ্যে একটিতে বড় ব্যবধানে জিতেছিল বিজেপি। যদিও কৃষ্ণনগর আসনটি ধরে রাখতে পেরেছিল তৃণমূল। তবে রানাঘাট থেকে সাংসদ হয়েছিলেন বিজেপির জগন্নাথ সরকার। বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে নদিয়ার যে অংশটি পড়ে, সেখানেও বড় ব্যবধানে এগিয়েছিল গেরুয়া শিবির।
গত দুই বিধানসভায় চমকপ্রদ ফল তৃণমূলের
২০১১ এবং ২০১৬ পরপর দুই বিধানসভা নির্বাচনে নদিয়া থেকে চমকপ্রদ ফল করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১১ সালে তৃণমূলের ঝুলিতে গিয়েছিল ১৪টি আসন। আর গত বিধানসভায় বাম-কংগ্রেসের জোট হওয়ার পরেও ১৩টি আসনে উড়েছিল ঘাসফুলের পতাকা। ভোট পরবর্তী সময় কংগ্রেসের টিকিটে জেতা তিন বিধায়কই তৃণমূলে যোগ দেন। যার ফলে গোটা জেলাই কার্যত বিরোধীশূন্য হয়ে যায়। তবে তৃণমূল ধাক্কা খায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। লোকসভার ফলের নিরিখে জেলার ১৭টি আসনের মধ্যে ১১টিতে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি । তৃণমূল এগিয়ে ছিল ৬টিতে। মতুয়া অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে বিজেপির জয়ের ব্যবধান ছিল বেশি।
একুশের ভোটের আগে তৃণমূলে ভাঙন
এবারের বিধানসভা ভোটের আগে দলে ভাঙন সবচেয়ে বড় সমস্যা তৃণমূলের কাছে। সেই ভাঙন দেখা দিয়েছে নদিয়াতেও। গত বিধানসভা ভোটের পর কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন ৩ বিধায়ক। এবার ঘটছে উলট পূরাণ। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের টিকিটে শান্তিপুর থেকে জিতেছিলেন অরিন্দম ভট্টাচার্য। ২০১৭ সালের জুন মাসে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি। সেই অরিন্দম দলবদলে গত জানুয়ারিতে বিজেপির পতাকা হাতে নিয়েছেন। তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন নদিয়ার তেহট্টের বিদায়ী বিধায়ক গৌরীশঙ্কর দত্ত। ২০১৯ পর্যন্ত সাত বছর তিনি নদিয়া জেলা তৃণমূলের সভাপতি ছিলেন।
দুই দফায় ভোট নদিয়ায়
নদিয়ায় এবার দুই দফায় ভোট করাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। প্রথম দফার ভোট আগামী ১৭ এপ্রিল। সেদিন ভোট রয়েছে নদিয়ার ৮টি বিধানসভা কেন্দ্রে। সেগুলি হল-শান্তিপুর, রানাঘাট উত্তর-পশ্চিম, কৃষ্ণগঞ্জ, রানাঘাট উত্তর-পূর্ব, রানাঘাট - দক্ষিণ, চাকদহ, কল্য়াণী ও হরিণঘাটা। নদিয়ায় পরবর্তী দফার ভোট ২২ এপ্রিল। সেদিন ভোটগ্রহন হবে ৯টি কেন্দ্রে। যেগুলি হল- করিমপুর, তেহট্ট, পলাশিপাড়া, কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া, চাপড়া, কৃষ্ণনগর উত্তর, নবদ্বীপ ও কৃষ্ণনগর দক্ষিণ। লোকসভা ভোটের ফলে চাকদহ, শান্তিপুর, কল্যাণী, রানাঘাট, তেহট্ট, কৃষ্ণনগর দক্ষিণ, কৃষ্ণনগর উত্তর, নবদ্বীপের মতো এলাকাগুলিতে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। যা তৃণমূলের চিন্তার অন্যতম কারণ।
র্সবশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েছে বিজেপি
উনিশের লোকসভা ভোটের পরেই অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন এবার তাঁদের লক্ষ্য বাংলা বিজয়। আর এই বাংলা বিজয়ের ব্লু প্রিন্টে পদ্ম ফোটানোর লক্ষ্যে ঝাঁপিয়েছে বিজেপি। বৈষ্ণব ও হিন্দুদের তীর্থভূমি এই জেলায় সেই মেরুকরণের ত্রাসই খেলেছে বিজেপি। গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাজুড়ে 'পরিবর্তন যাত্রা' বার করেছিল বিজেপি। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা যার সূচনা করেছিলেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান নবদ্বীপ থেকে। বাংলায় প্রচারে এসে মায়াপুরের ইস্কনে যাওয়ার কথা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের। যদিও শেষপর্যন্ত দিল্লিতে ইজারায়েলি দূতাবাসের সামনে বিস্ফোরণের কারণে সেই সফর বাতিল করতে হয় শাহকে। তবে এবার বিজেপির নজর নদিয়া জেলার দিকে। এখান থেকেই তাই কুড়ি বছর পর প্ ফের একবার ভোটে লড়ছেন মুকুল রায়। রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকারকেও বিজেপি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ভোটযুদ্ধে।
উনিশের নির্বাচনে নদিয়ায় বিজেপির ভাল ফলের অন্যতম কারণ ছিল মতুয়া ভোট। লোকসভা ভোটের পরিসংখ্যানে রাজ্যের মতুয়া অধ্যুষিত ৩০টি বিধানসভা কেন্দ্রের বেশিরভাগেই এগিয়ে ছিল গেরুয়া শিবির। যার একটা বড় অংশ আবার নদিয়া জেলায় পড়ে। সার্বিকভাবে এই জেলার একটা বড় অংশ তফসিলি জাতির অন্তর্গত, যারা কিনা উনিশের লোকসভায় ঢালাও সমর্থন করেছে বিজেপিকে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে সামনে রেখে লোকসভায় এই জেলায় ভাল ফল করে বিজেপি। কিন্তু এই আইন কার্যকর হতে দেরি হওয়ায় মতুয়াদের একটা বড় অংশ এখন বিজেপির প্রতি রুষ্ট। যদিও রাজ্যে ক্ষমতায় এলে সিএএ কার্যকর করে মতুয়া এবং শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন শাহ। পাশাপাশি সম্প্রতি বাংলাদেশে গিয়ে মতুয়াদের তীর্থস্থান ওড়াকান্দিতে মোদীর সফর বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। তাই মতুয়া ভোট গেরুয়া শিবিরের দিকে থেকে গেলে তৃণমূলের অস্বস্তি আরও বাড়বে। তবে নদিয়ায় ফ্যাক্টর হতে যাচ্ছে সংখ্যালঘু ভোটও। গত লোকসভায় তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রের কৃষ্ণনগর জয়ের পেছনে ছিল মুসলিম ভোট। পাশাপাশি খ্রিশ্চান জনসংখ্যাও ভাল রয়েছে নদিয়াতে। ২০১৯ লোকসভায় নদিয়ায় তৃণমূলের খারাপ ফলের আরও একটা কারণ ছিল স্থানীয় নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। কিন্তু কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে জেলার দায়িত্ব দেওয়ার পর, এই দুটি সমস্যা অনেকাংশ মিটেছে বলেই তৃণমূলের দাবি। তাই সার্বিকভাবে একুশে নদিয়া জেলায় আগের বিধানসভা নির্বাচনের মতোই দল ভাল ফল করবে বলে আশা করছে তৃণমূল নেতৃত্ব। তবে ২০১১ তে ৩৪ বছরের বাম রাজত্বের পতনের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেই। সেবার ১৬টি আসন জিতেছিল তৃণমূল। এর দু’বছর পরেই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের ধরাশায়ী করে রাজ্যে ঐতিহাসিক পালাবদল ঘটিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী। এদিকে উনিশের নির্বাচনে ১৮টি আসন জিতে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিজেপি। ঠিক দু’বছর পর হচ্ছে বিধানসভা নির্বাচন। উনিশের ফলের ওপর নির্ভর করে নদিয়া জেলা নিয়ে কিন্তু নিশ্চিন্তে থাকতেই পারেন বিজেপি নেতৃত্ব। দশ বছরের তৃণমূল শাসনের পর পালাবদল ঘটতেই পারে ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম ভূমি নদিয়াতে।