এরাজ্যে বিজেপি নেতাদের মধ্যে সুবক্তা হিসাবে নাম রয়েছে শমীক ভট্টাচার্যের। নব্যদের ভিড়ে বঙ্গ বিজেপিতে নিজের আলাদা জায়গা ধরে রেখেছেন অতি সাধারণ চেহারার এই ভদ্রলোক। দলের মুখপাত্র হিসাবেই সংবাদমাধ্যমকে সুচারু উত্তর দিতে তাঁর জুড়ি নেই। তবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ যেমন প্রায় প্রতিদিনই বিতর্কিত মন্তব্য করতে অভ্যস্ত, শমীককে তেমন কখনই দেখা যায়নি। এবারের বিধানসভা ভোটে রাজারহাট-গোপালপুর কেন্দ্র থেকে শমীককে প্রার্থী করেছে গেরুয়া শিবির। বর্তমানে রাজ্য বিজেপি নেতাদের মধ্যে লোপ্রফাইলে থাকলেও কিন্তু শমীকের কৃতীত্ব অন্য খানে। ২০১৯-এর ভোটের পর রাজ্যে প্রধান বিরোধী হিসাবে উঠে এসেছে বিজেপি। এবার ক্ষমতা দখলের অন্যতম দাবিদার তারা। কিন্তু বাংলায় গেরুয়া শিবিরের বিজয় রথ শুরু হয়েছিল শমীক ভট্টাচার্যকে দিয়েই। তিনি বাংলায় জোট না করে একক শক্তিতে জেতা প্রথম বিজেপি বিধায়ক। চলুন দেখে নেওয়া যাক শমীকবাবুর রাজনৈতিক যাত্রাপথ।
২০১৪ সালে চমকে দিয়েছিলেন শমীক
শোনা যায় দক্ষিণ বসিরহাট থেকে বিজেপির প্রার্থী হিসাবে শমীক ভট্টাচার্যের বিধায়ক হয়ে যাওয়া এখনও নাকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাড়া করে বেড়ায়। সালটা ২০১৪। তখন কেন্দ্রে সবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রথম নরেন্দ্র মোদী সরকার। লোকসভা নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে দেশজুড়ে হাওয়া ছিল তুঙ্গে। তবে তার প্রভাব বাংলায় খুব একটা পড়েনি। কিন্তু লোকসভা ভোটের পরেই ছিল বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে বিধানসভার উপনির্বাচন। সিপিএমের বিধায়ক নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে আসনটি খালি হয়েছিল। আর সেখানেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৃণমূলের দীপেন্দু বিশ্বাসকে পরাজিত করে বিধায়ক হন শমীক ভট্টাচার্য। সেই সঙ্গে যেন ইতিহাসও গড়ে ফেললেন শমীক। কারণ সেটাই ছিলে বিজেপির একার কৃতীত্বে বাংলায় প্রথম কোনও আসন জয়। তবে শমীকবাবুর আগে বিজেপির টিকিটে এরাজ্যে প্রথম বিধায়ক হয়েছিলেন প্রয়াত বাদল ভট্টাচার্য। ১৯৯৯-এ উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়া বিধানসভা কেন্দ্রের উপ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন বাদল ভট্টাচার্য৷ সেই সময় অবশ্য এনডিএ জোটে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস৷ ফলে বাদল ভট্টাচার্যের জয়ের পেছনে অনেকটাই অবদান ছিল ঘাসফুল শিবিরের। সেদিক থেকে বাংলায় শমীক ভট্টাচার্যই প্রথম যিনি গেরুয়া শিবিরের হয়ে একক কৃতীত্বে ফুটিয়েছিলেন পদ্ম।
বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রটি বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। মোট ৭টি বিধানসভা বসিরহাট দক্ষিণ, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, মিনাখাঁ ও হাড়োয়া,বসিরহাট উত্তর ও বাদুড়িয়া নিয়ে গঠিত বসিরহাট লোকসভা। গত লোকসভা নির্বাচনে এখান থেকে বিপুল ভোটে জিতে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের নুসরত জাহান। একদা বাম গড় হলেও ২০০৯ সাল থেকে বিসরাহটের দখল রয়েছে তৃণমূলের হাতে। সংখ্যালঘু ভোটও এই কেন্দ্রে প্রচুর। সেখানেই ২০১৪ সালে বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভায় কী করে পদ্ম ফুটল তা নিয়ে সেই সময়ে চুলচেরা হিসাব-নিকেশে বসতে হয়েছিল তৃণমূল নেতৃত্বকে। কারণ সেই সময়ে , পঞ্চায়েত-ব্লক বা পুরসভাতেও বিজেপির কোনও সংগঠন সেভাবে গড়ে ওঠেনি। মাত্র ১৭ মাস বিধায়কের দায়িত্ব সামলাতে পেরেছিলেন শমীকবাবু। যদিও ষোলর নির্বাচনে প্রবল তৃণমূল হাওয়ায় দীপুন্দে বিশ্বাসের কাছে হারতে হয়েছিল শমীককে। বসিরহাট দক্ষিণ তাঁকে দ্বিতীয়বার বিধায়ক না করলেও নিজের প্রাক্তন কেন্দ্র থেকে কিন্তু মুখ ফিরিয়ে রাখেননি শমীক। গতবছর আমফানের পর বসিরহাটের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দেখা গিয়েছিল শমীককে। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেই সময় শমীককে বলতে শোনা গিয়েছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কোনও বিভাজন নয়।
কড়া টক্কর দিয়েছিলেন লোকসভায়
উনিশের লোকসভা ভোটকে রাজ্য রাজনীতির গেম চেঞ্জার বলা যায়। এই ভোটেই বঙ্গে নিজের শক্তির আভাস পায় গেরুয়া শিবির। উঠে আসে প্রধান বিরোধী হিসাবে। আর একুশের ভোটে বাংলায় সরকার গড়াই গেরুয়া শিবিরের পাখির চোখ। গত লোকসভা ভোটে জিততে না পারলেও যে আসনগুলিতে বিজেপি কড়া টক্কর দিয়েছিল তারমধ্যে অন্যতম ছিল দমদম লোকসভা কেন্দ্র। সেবার তৃণমূলের সৌগত রায়ের কাছে হারলেও ভোট শতাংশের হিসাবে ৩৮.১১ শতাংশ ভোট গিয়েছিল বিজেপির ঝুলিতে। শমীকবাবুর প্রাপ্ত ভোট ছিল সাড়ে চার লক্ষেরও বেশি।
সুবক্তা শমীক কিন্তু স্পষ্টবাদীও
বঙ্গ রাজনীতিতে গেরুয়া শিবিরের নেতাদের বারবার দেখা গিয়েছে বিতর্কে জড়াতে। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষতো বারবার তাঁর আলটপকা মন্তব্যের জন্য সুপরিচিত। সেই তুলনায় শমীক ভট্টাচার্য কিন্তু একেবারের আলাদা। তিনি রাজ্য রাজনীতির অত্যন্ত পরিচিত মুখ। সুবক্তা হিসেবেও বেশ নামডাক। দলীয় সভা হোক কী, বিতর্ক সভা। বক্তা হিসেবে তাঁর বড় দর। বাগযুদ্ধে তাকে পরাস্ত করা বেশ কঠিন। শোনা যায় অকৃতদার শমীকবাবুকে ব্যক্তি হিসাবে পছন্দ করেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও। বিজেপি নেতাদের নিয় তৃণমূলনেত্রীকে বারবার মন্তব্য করতে দেখা গেলেও সেই দলে কখনই থাকেননি শমীকবাবু। এমনকি অভিনেত্রী তথা বর্তমানে তৃণমূলপ্রার্থী সায়নী ঘোষের উদ্দেশ্যে বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁর 'যৌনকর্মী' কটাক্ষে দলের হয়ে ক্ষমা চাইতে দেখা গিয়েছিল শমীক ভট্টাচার্যকে। সাফ জানিয়েছিলেন, এধরনের মন্তব্য দল সমর্থন করে না।
রাজারহাট-গোপালপুর ফোঁটাতে পারবেন পদ্ম?
একুশের ভোটে বিজেপির প্রার্থী তালিকায় নাম রয়েছে শমীক ভট্টাচার্যের। রাজারহাট গোপালপুর থেকে তাঁকে প্রার্থী করেছে দল। প্রথমে বহিরগত বলে তাঁকে নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ ছিল এলাকার এক শ্রেণির বিজেপিকর্মীর। আসলে শমীক ভট্টাচার্যের ইউএসপি, কখনই রাগী মুখে দেখা যায়না তাকে। তাই সেই বিক্ষুব্ধ শিবিরকেও আপাতত মানিয়ে নিয়েছেন, ঠিক যেভাবে সব দলের কাছেই তিনি প্রিয়। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের পূর্ণেন্দু বসু। মন্ত্রীও হন পূর্ণেন্দুবাবু। বামপ্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য কে ৬,৮৭৪ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন পূর্ণেন্দু বসু।। এবার তাঁকে টিকিট দেয়নি দল। তাঁর জায়গায় প্রার্থী করা হয়েছে সঙ্গীত শিল্পী অদিতি মুন্সীকে। রাজনীতির ময়দানে অদিতি নবাগত হলেও তাঁর স্বামী এই জগতেরই মানুষ। বিধাননগর মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের সাত নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার অদিতির স্বামী দেবরাজ চক্রবর্তী। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের হিসাবে দমদম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই আসনে ৭৪৩ ভোটে এগিয়ে ছিল বিজেপি। লোকসভা ভোটে সৌগত রায়ের কাছে হারলেও, বিধানসভাভিত্তিক ফলে রাজারহাট-গোপালপুরে এগিয়ে কিন্তু শমীক ভট্টাচার্য। একটা সময়ে তিনি একাই বিধানসভায় বিজেপির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। একুশের ভোটে ফের ফের নিজের পুরনো জায়গায় ফিরতে পারবেন কিনা তা জানতে অবশ্য দোসরা মে পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।